কাশেম আলী রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে ১০০বার বুক ডন দেয়।তারপর কিছুক্ষন সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকে।মাঝে মাঝে বুকডন দেয়ার পর শরীরের মাসলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে। তার শরীরটা রোগা পটকা ধরনের।বেশী শারীরিক শ্রম সে করতে পারেন না। বুক ডন দেয়ার কারণে তার বুকটা কেমন যেন ধুপধুপ করতে থাকে,শ্বাস নিতে কষ্ট হয়-তারপরেও কাশেম আলী প্রতিদিন সকালে উঠে শত কষ্ট করে বুক ডন দেয়ার কাজটা করে থাকে।কারণ একটাই- সে পুরুষের মত বাচতে চায়।
আগে তার পুরুষের মত বাচা নিয়ে কোনো চিন্তা ছিল না।খেয়ে পড়ে বেচে থাকাটাই ছিল আসল ব্যাপার। কিন্তু এই বাড়ির ছোটোহুজুর তার মাথায় এই “পুরুষের মত বাচার” চিন্তাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে।
কাশেম আলী মিয়া বাড়ির লজিং মাস্টার। বড় লোকের বাড়িতে লজিং মাস্টার থাকার একটা সমস্যা হল- এরা লজিং মাস্টার আর ঘরের কাজের লোকের সাথে একই ব্যবহার করে। তবে এই বাড়িতে সেই সমস্যাটা তেমন প্রকট না। সে বেশ সুখেই এই বাড়িতে দিনাতিপাত করছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে ওঠার পর ডিম,পরোটা,কলা,চা চলে আসে। তারপর বাড়ির ছেলেমেয়ে গুলো তার কাছে পড়া শুরু করে।মিয়ারা হল যৌথ পরিবার। ছোট বড় সব মিলিয়ে প্রায় ১০/১২টা ছেলে মেয়ে কাশেম আলীর কাছে পড়ে।কাশেম আলী তাদের মুখে মুখে পড়ায় ১২ এক্কে ১২,১২ দুগণা চব্বিশ,১২ তিন গুণা ছততিরিশ!!! নামতা পড়ানোর ফাকে ফাকে কাশেম আলী উকিঝুকি মেরে এ বাড়ির কিশোরী মেয়ে তাসলিমাকে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা। তাসলিমা ইদানীং ভিতরের বাড়ি থেকে তেমন বের হয় না।তাকে বিয়ে দেয়ার তোড়জোর চলছে। এসময় মেয়েদের বাড়ির বাইরে বেশী না যাওয়াই ভাল।
ছেলেমেয়েগুলোকে পড়ানো শেষ হলে কাশেম মিয়া শরীরে সরিষার তেল মাখা শুরু করেন। এই সরিষার তেল মাখার ব্যাপারটাও আগে সে করত না।ছোটহুজুর করে,তাই সেও করে।ছোটো হুজুরের সাথে তার একটা বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। ছোটোহুজুর রুস্তম এক আজব মানুষ। কোনো কাজের ব্যাপারেই তার আগ্রহ নাই। দুনিয়ার সব হাবিজাবি কাজে এই লোকটার আগ্রহ। ছোটোহুজুরের হাবিজাবি কাজগুলো অনেকের কাছে পাগলামী তুল্য। কিন্তু কাশেমের কেন যেন সেসব খারাপ লাগেনা।
সেদিন পুকুর ঘাটে গোসলের জন্য যেতেই ছোটহুজুর রুস্তম তাকে ডাক দেয়।
-মাস্টার গোসলে যাও নাকি?
-জ্বি হুজুর।
-মাস্টার তোমারে বহুবার কইছি যে আমারে হুজুর ডাকবানা। যাই হউক, আমি এক ধরনের নতুন সাধনা শিখছি। তুমি কি শিখবা নাকি?
- কি সাধনা জনাব?
_ তাপ সাধনা। জামা কাপড় খুইলা রোদ্দুরের মইধ্যে বইস্যা থাকার সাধনা। বেশ উপকারী।
- কি উপকার হুজুর?
- এই ধর যে জামা কাপড় খুইলা তুমি চৈত্র মাসের রোদ্দুরের ভিতর বইসা রইলা তাতে তোমার খুব গরম লাগব। একসময় গরমের ঠেলায় তোমার মনে হইব যেন তুমি ঐজায়গা ছাইড়া উইঠা পানিতে ডুব দেও। কিন্তু তুমি তা করবা না। নিজেরে পরীক্ষা করবা কতটুক কষ্ট তুমি সইতে পারো। এইটাই হইল তাপ সাধনা।
কথা বলতে বলতে রুস্তম বাড়ির পিছনে এসে জামা কাপড় খুলে দ্বিগম্বর অবস্থায় সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। রুস্তমের এই আকস্মিক কর্মকান্ডে কাশেমের যেন বুদ্ধি লোপ পেয়ে বসে। লোকটার ভিতর পাগলামী আছে বটে, তাই বলে একদম জামা কাপড় খুলে শুয়ে থাকবে? কাশেমকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রুস্তম বলল- কি ব্যাপার খাড়ায়ে আছো কেন? জামা কাপড় খুইলা চিত হইয়া শুইয়া পড়। এইটাই তাপ সাধনা।
রুস্তমের কথা শুনে কাশেম কোনো ভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল- জনাব এই জামা খুলার কাজটা না করলে হয় না?
-বোকার মত কথা বলবা না মাস্টার। তাপ সাধনার নিয়মই এইটা।
কাসেমের ভীষন হাসফাস লাগে। এটা কেমন নিয়ম? কোনোভাবে তাসলিমা যদি এইদিকে এসে তাকে দ্বিগম্বর অবস্থায় দেখে ফেলে তাহলে কি ভয়াবহ লজ্জার ব্যাপার হবে তা ভেবে কাসেমের কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হতে শুরু করে।
আবার রুস্তম বলে ওঠে- মাস্টার দেরী না কইরা যা করতে বলছি কর।
-জনাব আমার পেচ্ছাব পাইছে। পেচ্ছাব করব।
একথা বলে কাসেম মাস্টার তাড়াতাড়ি কোনো ভাবে রুস্তুমের কাছ থেকে এক প্রকার পালিয়ে আসে।
এবাড়িতে কাসেম খারাপ নেই। গত দুই বছরে সে খুব বেশী তার নিজের বাড়িতেও যায়নি। ইদানীং এবাড়িটাকে তার নিজের বাড়িই মনে হয়। বাড়ির মানুষগুলোও বেশ ভালো। তাসলিমার প্রতি দূর্বলতা যেন এই বাড়ির প্রতি তাকে আরো বেশী মায়া ধরিয়ে দিয়েছে। কাসেমের দিনের বেশ খানিকটা সময়ই কাটে তাসলিমার কথা ভেবে। সেদিন রুস্তুমের কাছ থেকে পালিয়ে আসার সময় তাসলিমা দেখল পুকুর ঘাটে পানির দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে। কোকড়া চুলগুলো তাক-তাক হয়ে পিঠজুড়ে ছড়িয়ে আছে। কাসেমের বুকের ভিতরটা কেমন হুহু করে ওঠে এই মেয়েকে দেখে। কেন যে তার এই মেয়েকে দেখলে এমন লাগে? এই মেয়েকে বিয়ে করা তো দূরের কথা চোখ তুলে তাকানোর সাধ্যও কাসেমের নেই। নিজের অক্ষমতার জন্য বিধাতার উপর বড় বেশী রাগ হয় কাসেমের।
এদিকে তসলিমার বিয়ের কথা মাঝে মাঝেই কানে আসে। কিছুদিন আগে তসলিমার সব থেকে বড় ভাই সোলায়মান মিয়া কাসেমকে সাথে নিয়ে এক পাত্রের বাড়িঘর অবস্থা দেখে এসেছিল। পাত্রের ঘর বাড়ি,বংশ, টাকা পয়সা বেশ ভালো। মনে হয় সম্মন্ধটা আগাবে। এসব জায়গায় কাশেমের যেতে ইচ্ছা করে না। নিজেকে কেমন অসহায় লাগে। তাও কিছু করার নেই।
কাশেমের ইদানীং বেশ অস্থির লাগে। রুস্তম তাকে “পুরুষের মত বাঁচা” শীর্ষক বক্তৃতা দেয়। তাও তার শুনতে ইচ্ছা করেনা। আচ্ছা তাসলিমার বড় ভাইয়ের কাছে গিয়ে বলে যে সে তাসলিমাকে বিয়ে করতে চায় তাহলে কেমন হয়? নাহ ব্যাপারটা ভীষন রকম দুঃসাহস হয়ে যায়। মিয়া বাড়ির লোকজন এমনিতে সজ্জন হলেও নিজের স্বার্থে টান পড়লে যা খুশি তাই করে ফেলতে পারে। কিছুদিন আগে এক চোরকে ন্যাড়া করে মাথায় কালি মেখে ছেড়ে দিয়েছিল। সেই হিসাবে কাসেম যদি তাসলিমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে যায় তাহলে হয়তো তার গলায় জুতোর মালা পরিয়েও গ্রামে হাটাতে দ্বিধা করবে না। কাসেমের এই দৃশ্য ভাবলেও বুক ধরফর করে।
তসলিমার বিয়ের বেশ তোড়জোড় চলছে। পাত্রপক্ষ আগামী কাল তাসলিমাকে দেখতে আসবে। বাড়িতে কেমন উৎসব উৎসব ভাব! যেন তারা জেনেই গিয়েছে তাসলিমাকে পাত্রপক্ষ পছন্দ করবে। তাসলিমাকে অপছন্দ করারও কারণ নেই। কাসেমের এই বাড়িটাকে আজকাল অসহনীয় মনে হয়। এই বাড়িতে থাকাটা তার জন্য ভীষন কষ্টকর হয়ে গিয়েছে ইদানীং। কাসেম তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো আস্তে আস্তে গুছিয়ে ফেলতে শুরু করে।
কাসেম মাস্টার সোলায়মান মিয়ার কাছে এবাড়ি ছাড়ার অনুমতি চাইতে গেলে সোলায়মান কিছুটা অবাকই হল।
-কাসেম মাস্টার যাইতে ইচ্ছা করলে যাইতে পারো। কিন্তু তার আগে বল, তুমি কি গোস্বা কইরা এই বাড়ি ছাড়তেছো?
-জ্বিনা হুজুর। আপনারা আমারে যথেষ্ট ভালোবাসছেন। কিন্তু এখন আমার এইখানে মন টিকে না।
-আচ্ছা যাও তাইলে। যদি কোনোদিন কোনো কাজে লাগে তাইলে কোনো দিকে না তাকায়ে আইসা পইড়ো।
কাসেমের আকস্মিক বিদায়ে পুরো মিয়া পরিবার বেশ অবাকই হল। গত দুই বছরে কাসেম হয়ে উঠেছিল পরিবারেরই একজন। সাতেপাচে না থাকা নীরিহ এই মানুষটার প্রতি সবারই একটা টান ছিল।
কাসেম যে রাতে মিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে আসছিল সে রাতে ছিল টুপটাপ করে ফোটাফোটা বৃষ্টি অবিরাম ঝরছিল। মিয়া বাড়ির সবাই বারবার অনুরোধ করছিল যেন আজ রাতটা থেকে যায়। কিন্তু আর একটা মুহূর্তও কাসেমের এবাড়িতে থাকতে মন সায় দিচ্ছিল না। কাসেম যখন চলে যাচ্ছিল তখন রুস্তম তাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেদেছিল। বাড়ির মানুষজন তাকে বিদায় জানাতে উঠানের বাইরে এসে দাড়িয়েছিল। কিন্তু সেসব একটা বারের জন্য কাসেম পিছন ফিরে দেখেনি। নিজের ভালবাসাকে উপলব্ধি করতে কাসেমের মত বুদ্ধিহীন লোকেরা এত বেশী ব্যস্ত থাকে যে অন্যের ভালবাসাটুকু অনুভর করার সময়টা আর পাওয়া হয় না তাদের।
----------------------------------------------------------------------
১২ বছর কিংবা তার কিছু পরের কথাঃ
কাসেম নামক বোকা মানুষটা এখন নীলগঞ্জের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। চালের আড়ত আছে তার। ১২ বছর আগের সেই খানিকটা বোকা কাসেম এখন অনেক বেশী বুদ্ধিদীপ্ত। চোখে মুখে প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে। আজকাল কাজের চাপ এত বেশী থাকে যে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। আজও দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে বেশ দেরী হয়ে গেল। একে তো রাত তার উপর টুপটাপ বৃষ্টি পড়েই চলেছে। এরকম বৃষ্টি হলেই কাসেমের ১২ বছর আগের সেই রাতের কথা মনে হয় যে রাতে সে মিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল। সেদিনের রাতটার কথা ভাবলেই কাসেমের অবাক লাগে। সেদিন রাতে ট্রেনের জন্য স্টেশনে পৌছানোর কিছুক্ষন পরেই সে দেখলো সোমায়মান মিয়া সব মিয়া বাড়ির আরো কিছু লোক স্টেশনে হাজির হয়েছে। সোলায়মান মিয়া একপ্রকার ধমক দিয়েই তাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গেল। কেন এভাবে হঠাত বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেই প্রশ্ন করার সাহসই কাসেম পেল না।
বাড়িতে এনে বিস্মিত কাসেমকে আরো অবাক করে দিয়ে সোলায়মান মিয়া করুন গলায় বলেছিল, “কাসেম মাস্টার, আমার একমাত্র বোনটা তোমারে পছন্দ করে। তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে সে এক নাগাড়ে কানতেছে। তুমি তারে বিবাহ কর। তুমি বিনিময়ে যা দাবী করবা আমি তাই দিমু।”
কাসেম মাস্টার তাসলিমাকে বিয়ে করার বিনিময়ে সেদিন কিছুই দাবী করেনি। দাবী করার মত কিছু ছিলও না। কারণ যা সে চেয়েছে তার সবটাই তার পাওয়া হয়ে গিয়েছে। সমগ্র জীবনে কাসেম এরচেয়ে ভয়াবহ ভাবে আর কিছুই আকাঙ্ক্ষা করেনি। এর চেয়ে বেশী কিছু বাকি জীবনে কাসেমের প্রয়োজন নেই।
(উৎসর্গ লুলু আপুকে যে কিনা সুখের সমাপ্তি পড়তে ভীষন ভালোবাসে)
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:৩৭