somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ প্রদীপ নেভার আগে

২১ শে এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

২০১২ সাল

কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খুলতেই দেখি ত্রপা আধা মরা একটা এলোভেরা গাছ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাতে গাছটা ধরিয়ে দিয়ে চোখ মুখ কুচকে অভিযোগের ভঙ্গিতে এক নাগাড়ে বলে চলল, “দেখেছিস বিন্দু গাছটা কেমন মরে যাচ্ছে! বুয়াকে পইপই করে বলে যাই যেন গাছে পানি দেয়। অথচ পানি না দেয়াতে কি হাল হয়েছে দেখেছিস। আর আমিও তো একদম সময় পাইনা। অথচ তুই তো জানিস এলোভেরার রস ত্বক আর চুলের জন্য কি ভীষন উপকারী। তুই একটু গাছটাকে তোর কাছে রেখে যত্ন আত্মি কর নারে প্লিজ!”
সেদিন থেকে আধামরা হলুদ বাদামী পাতাওয়ালা গাছটাকে সকাল বিকেল পানি দেই।

সেদিন দেখি মামার বাসায় গিয়ে দেখি মামি প্রিয়তিকে ভীষন রকম বকছে আর প্রিয়তি মুখ নিচু করে কেঁদে চলেছে। বাসায় পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত্। কি নিয়ে এত চেঁচামেচি চলছে তা জানতে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করব তারও উপায় নেই। তবে মামির বকাবকিতে কিছুক্ষন পর বুঝলাম আসল রহস্য। প্রিয়তি টেস্ট পরীক্ষায় ইংরেজীতে ফেল করেছে। ওকে বোর্ড পরীক্ষায় নাকি বসতে দেয়া হবে না। অনেক চেষ্টা তদবীরের পর ওকে বোর্ড পরীক্ষা দেয়ানোর অনুমতি মিলল। পাশাপাশি ওকে ইংরেজী দেখিয়ে দেয়ার ভার নিলাম আমি।
প্রতিদিন আড়াই ঘন্টা করে প্রিয়তিকে ইংরেজী পড়াচ্ছি। টেন্সটা পর্যন্ত ভাল করে পারে না এই মেয়ে। নিজের মামাতো বোনের ইংরেজীতে এই করুন হাল দেখলে আমার নিজেরই কেমন হাসফাস লাগে। কে জানে ও পরীক্ষায় পাশ করে কিনা!

ছোটোবেলার বান্ধবী লামিয়ার সাথে আমার ইদানীং যোগাযোগ এক প্রকার নেই বললেই চলে। লামিয়া প্রেম করার আগেও ওর সাথে প্রতিদিন কথা হত। কিন্তু প্রেমে পড়ার পর আমি ফোন করলে হয়তো ও বিরক্তই হত। আমিও এক প্রকার অভিমান করে ওর থেকে দূরেই ছিলাম। সেদিন হঠাৎই ওর ফোন পেলাম। “বিন্দু আমার সাথে একটু দেখা করবি? তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে”- লামিয়ার এমন আকুতি অগ্রাহ্য করতে পারলাম না। পরদিনই ওর সাথে দেখা করলাম। লামিয়ার এমন চেহারা আমি এর আগে কখনও দেখিনি। এত হাসিখুশি মেয়েটার চোখে মুখে এত কষ্ট-কষ্ট ছাপ কেন? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম- “কিরে , কি হয়েছে তোর?”
সাথে সাথে ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ওর চার বছরের প্রেম ভেঙ্গে গিয়েছে। ওর প্রেমিক ওর সাথে ভয়াবহভাবে প্রতারণা করেছে।
সব অভিমান ভুলে লামিয়াকে সময় দেয়া শুরু করেছি। প্রতিদিন ফোনে কথা বলি, ফেসবুকে চ্যাট করি,মাঝে মাঝে দুই বান্ধবী ঘুরতে যাই। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে খেয়াল করে দেখার চেষ্টা করি ওর ঠোঁটের কোনে সেই পুরোনো হাসির রেশটা লাগতে শুরু করেছে কিনা।

কয়েকদিন ধরেই বেশ গরম পড়েছে। বৃষ্টির কোনো খোজ পাত্তা নেই। হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যায় এমন বাতাস শুরু হল কি বলব! বাতাসের তোরে সারা ঘরে বালি এসে ভরে গেল। দরজা জানালাগুলো ধুম-ধুম করে ধাক্কা খাচ্ছিল। আমি দৌড়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করতে ছুটলাম। বারান্দার দরজাটা লাগানোর আগ মুহূর্তে দেখি একটা শালিক পাখি বারান্দার মেঝেতে ছটফট করছে। আমি ওটাকে হাতের মুঠোয় তুলে নিতে নিতে খেয়াল করলাম, বেচারীর ডানা ভেঙ্গে গিয়েছে। আমার হাতে পাখিটাকে দেখে মা হেসে বললেন, “বিন্দু তোর কপালে এমন ভাঙ্গাচোরা জিনিস পড়ে কেন কে জানে?”

পাখিটাকে নবজাতক শিশুর মত পরম যত্নে বাচিয়ে তোলার চেষ্টা করছি। এ যাত্রায় বেচে গেলেও আকাশে ওড়ার মত ক্ষমতা হয়তো আর থাকবেনা ওর।



২০১৩ সাল

এলোভেরা গাছটা কি যে সুন্দর করে বেড়ে উঠেছে। সকালের রোদ বারান্দায় এসে পড়লে এলোভেরা পাতার ছোটো ছোটো কাটাগুলো সোনালী-রূপালী আলোয় ঝিলমিল করে। ঘুম ভেঙ্গেই মন ভালো করার জন্য এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্যের দরকার আছে বলে মনে হয় না।
এরই ভিতর একদিন ত্রপা এসে আবার সেই আগের মত ছটফটে কন্ঠে বলে-“দেখেছিস আমার চুলের কি হাল হয়েছে? এলোভেরার রস যদি লাগানো যেত তাহলে আর এমন হত না। কইরে দেখি এলোভেরা গাছটার কি অবস্থা?”
ত্রপাকে বারান্দায় নিয়ে যেতেই ওর চোখদুটো চকচক করে উঠল। তাড়াতাড়ি ড্রাইভারকে উপরে ডেকে টবসহ গাছটা নিয়ে গেল। গাছটা যে স্থানে ছিল ওখানের মেঝেতে বহু পুরোনো জল আর মাটি শক্ত হয়ে লেগে আছে। আমি একটা কাপড় ভিজিয়ে এনে ডলে ডলে মাটিটা উঠানোর চেষ্টা করি। সবটা ওঠাতে পারিনা। কিছুটা মাটির দাগ লেগে থাকে মেঝেতে।

কয়েকদিন ধরেই প্রিয়তি নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে শুধু জায়নামাযের পাটিতে বসে থাকে। ওকে শত চেষ্টা করেও খাওয়ানো যায় না। বেচারী দুশ্চিন্তা দেখে আমার নিজের এসএসসি পরীক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। আমার নিজেরও প্রিয়তির জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। শেষদিকে ও এত পরিশ্রম করেছে! অবশেষে প্রিয়তির রেজাল্ট আসলো। যে মেয়ে টেস্টে ফেল করেছে সে নাটকীয় ভাবে এ প্লাস পেয়ে বসে আছে। ও রেজাল্ট পেয়েই আমাকে জড়িয়ে ধরে লাফাতে শুরু করলো। আমার যে কি হল জানিনা। আমি নিজেও এমন ভাবে প্রিয়তির সাথে হৈ-হুল্লোর শুরু করলাম যেন আসলে প্রিয়তির না। আমারই রেজাল্ট দিয়েছে!


লামিয়ার সাথে গত কয়েক মাস সেই ছোট্টবেলার মত হেসেখেলে পার করেছি। একদিন ও জানালো, ওকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। পাত্র অস্ট্রেলিয়ার কোন একটা ইউনিভারসিটির শিক্ষক । ওকে পছন্দও করেছে। এরপর কোনো এক শুভদিনে লামিয়ার বিয়ে হয়ে যায়। বউয়ের সাজে ওকে মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে ভুল করে নেমে আসা কোনো পরী। সব মিলিয়ে আমার মনে হল- লামিয়ার জীবনটা যেন রূপকথার কোন রাজকন্যার জীবনে পরিণত হয়েছে যার অতীত কেটেছে ভীষন দুঃখে আর সামনের ভবিষ্যতের দিনগুলো “অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল”-এমন পরিণতি পেয়েছে। বিয়ের পরপরই স্বামীর সাথে অস্ট্রেলিয়া বাসা বাধল। যাওয়ার আগে আমার গলা জড়িয়ে ধরে কাদল খুব করে। আমি তখন শুধু বলতে চেয়েছি, “লামিয়া তুই ভাল থাকিস!” কিন্তু আমার গলার কাছে একটা কান্নার দমক এত বিশ্রীভাবে আটকে গেল যে আর সে কথাটা বলা হল না।

পাখিটা সুস্থ্ হয়ে গিয়েছে। ইদানীং ওর ডানা ঝাপটানো দেখে হা করে তাকিয়ে থাকি। পাখিটার ডানা ঝাপটানো দেখলে মনে হয় যেন কোনো যুদ্ধজয়ী রাজা!

২০১৪

প্রতিটা সকালে উঠে আমি অভ্যাসমত বারান্দাতে গিয়ে দাড়াই। যে জায়গাটায় এলোভেরা গাছটা ছিল সেখানটায় চোখ পড়ে যায় নিজের অগোচরেই। একসময়ের ঠেকায় পরে করা কাজটা আমার যখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল, তখন সেটা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছি।

প্রিয়তি কলেজে উঠেছে। নতুন মোবাইল পেয়েছে। মাঝে মাঝে ওকে ফোন দিলে ওর দারুন ব্যবস্থার ফিরিস্তি শুনতে হয়। মাত্র এক বছরে একটা মানুষ কত বড় হয়ে যায়-ভাবতেই অবাক লাগে!

লামিয়া সংসার নিয়ে ভীষন ব্যস্ত!ঘরে নতুন অতিথি আসবে। লামিয়া কি এর আগে কখনও এতটা সুখে থেকেছে?

একদিন সকালে খাঁচাটা খুলে পাখিটাকে বের করে আনলাম। পাখিটা কিছুক্ষন ইতস্তত পায়ে বারান্দার এদিক ওদিক হাটল। তারপর একসময় ডানা মেলে উড়ে চলে গেল। একবারও পিছনে ফিরে তাকালো না। কি অদ্ভুত! এত স্বার্থপরতা ও কই শিখেছে?

আজকাল আমার অখন্ড অবসর। কোনো কাজ নেই। কোনো এক অজানা কারণে আমার শরীরটা একটু একটু করে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার কোনো কারণ খুজে পায়নি।দিনের পুরোটা সময় এখন আমাকে একা থাকতে হয়। কেউ কোথাও নেই! আমি ভীষন রকম একা। আমার ভয়াবহ নিঃস্ব লাগে!!












সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১১:১৮
৫৭টি মন্তব্য ৫৬টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×