জুয়েল মৃধা / ফয়সল ইসলাম : বড় ভয় ও সমস্যার কথা। শনিবার দুপুর ২টায় হঠাৎ শরীরে আগুন লাগা গরম। এরপর জ্বালা-যন্ত্রনা। আস্তে আস্তে সারা শরীরে খিঁচুনি দিয়ে আসে। খিঁচুনির কারণে বুক ও ঘাড়ে ব্যাথা শুরু হয়। একপর্যায়ে দম আটকে আসার উপক্রম। এরই মধ্যে স্তন চুপসে যেতে শুরু করে। শরীরের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করেন শাকিলা। এসময় বাড়ির সকলে তাকে ধরে পুকুরে নামিয়ে দেন। দুপুর পৌনে ২টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত পুকুরেই গলা অবধি ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। কিছুক্ষনের জন্য উপরে এলে আবারো শুরু হয় জ্বালা পোড়া। সর্বশেষ আবারো তাকে পুকুরে নামানো হয়। ভোর সাড়ে তিনটা পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন শাকিলা। শুধু পানিতে দাঁড়ানো নয় এসময়ের মধ্যে এলাকার সকল ফ্রিজের পানি, এমনকি বরফ সংগ্রহ করে তার মাথায় ঢালা হয়েছে। এভাবে তার শরীর ঠান্ডা করতে লেগেছে বরফের বড় বড় ৭টি চাক। বর্তমানে শাকিলার শরীরে গরম নেই। কিন্তু দুর্বলতা এসে ভর করেছে। চলছে গ্রাম্য চিকিৎসকের চিকিৎসা।
এভাবেই নিজের সমস্যার কথা বর্ণনা করলেন শার্শা উপজেলার ডিহী ইউনিয়নের নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের গৃহবধূ শাকিলা খাতুন (২২)। কি রোগে ভুগছেন শাকিলা; কেউ জানে না। এ সমস্যা শুধু শাকিলার নয়। শার্শা সীমান্তবর্তী লক্ষণপুর, ডিহী, বাহাদুরপুর ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামের অসংখ্য বাসিন্দার। এ রোগের কারণে সর্বত্র আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। আতংক এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, নিরাপদ থাকতে তাবিজ, পানি পড়া, ঘরবন্ধসহ নানা ফিকির নিচ্ছেন সকলে। তিনটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা সকলের হাতে ঝুলছে তাবিজ।
গত ৪/৫দিন ধরে যশোরের শার্শা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে আকস্মিক এ রোগের প্রকোপ শুরু হয়েছে। স্থানীয়দের ভাষ্য মতে, ভারতের গাঙ্গুলিয়া নামকস্থানে এ রোগের উৎপত্তি। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সকাল থেকে রাত সর্বত্র এ রোগ নিয়ে আলোচনা। কোথাও কেউ আক্রান্ত হলে ছুটে যাচ্ছেন সকলে। পুকুরে নামিয়ে ঠান্ডা করার দৃশ্য দেখছেন। বাড়ি ফিরে তাদেরই কেউ আবার এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
নারকেলবাড়িয়া গ্রামের অসুস্থ শাকিলার শাশুড়ী শাহিদা বেগম জানান, শাকিলা অসুস্থ হওয়ার পর তার পাশে যারা বসেছেন সকলেই গরম অনুভব করেছেন। মনে হয়েছে উননের পাশে বসে আছেন। শরীরে পানি দিলে বাস্প উড়েছে। প্রতিবেশী পারভীন, কুলসুম বেগম ও সুফিয়াসহ আরো অনেকে এর সত্যতা নিশ্চত করেন।
শাহিদা বেগম আরো জানান, শাকিলাকে প্রায় ১৫ ঘন্টা পানিতে রাখা হয়। এছাড়া প্রায় ৫ মন বরফ দেয়া হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় তার এতটুকু সর্দি লাগেনি।
রামচন্দ্রপুর গ্রামের মহসিন আলীর মেয়ে রেখা খাতুন। স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ হবার পর পিতার বাড়িতে থাকেন। একমাত্র সন্তান ঢাকায় পড়াশুনা করে। রোববার বিকেলে হঠাৎ তিনি এ রোগে আক্রান্ত হন। এরপর জ্বালা পোড়া, শ্বাস কষ্ট, খিঁচুনি ও ব্যাথা শুরু হয়। উপায়ন্ত না পেয়ে অন্যদের মত একমাত্র চিকিৎসা নিতে পানিতে নেমে পড়েন। চার ঘন্টা পানিতে থাকার পর গরম কমলে উঠে আসেন। সরজমিনে দেখা যায়, তাকে শুইয়ে মাথায় অনবরত পানি ঢালছেন তার মা ও বোন। স্থাণীয় চিকিৎসক আব্দুল কাদের এসে ব্যবস্থাপত্রও দিয়েছেন।
রেখা খাতুনকে দেখে গিয়ে একই রোগে আক্রান্ত হন তার চাচাতো বোন খালেদা (১৬)। প্রতিবেশি খাদেজাসহ আরো অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন। যারা এ রোগে আক্রান্ত হননি তারা নিরাপদে থাকতে ব্যবহার করছেন তাবিজ, হুজুরের পড়ে দেয়া সাদা সুতা ইত্যাদি।
এ রোগে আরো আক্রান্ত হয়েছেন লক্ষণপুর গ্রামের শহিদুর রহমান, খামারপাড়ার লিটন আলী, জাহাঙ্গীর, তুষার, সোনিয়া, রাসেল ইকবাল, ফরহাদ রেজা, বাকী বিল্লাহসহ অনেকে।
খামারপাড়া গ্রামের সোনিয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। দুর্বলতার কারণে মুষড়ে গেছেন তিনি।
আক্রান্তরা সকলেই ৩ থেকে ৬ ঘন্টা পানিতে নেমে শরীরের গরম নিবারন করেছেন। প্রত্যেকেই গ্রাম্য চিকিৎসকদের দেয়া পথ্য গ্রহণ করেছেন। কেউ আবার ফিকির নিয়ে সুস্থ আছেন বলে দাবি করেছেন।
লক্ষণপুর গ্রামের শহিদুর রহমান ও খামারপাড়ার রাসেল ইকবাল জানান, অজ্ঞাত এ রোগে আক্রান্ত হবার পর শরীরের খিঁচুনির সাথে সাথে পুরুষাঙ্গ সংকোচিত হতে থাকে। পানি থেরাপী নেবার পর এখন কোন সমস্যা নেই।
রহিমপুর আলীম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ শহিদুল্লাহ, আব্দুল গনি মেম্বারসহ আরো অনেকের সাথে শিকারপুর বাজারের শফিকুল ইসলামের চায়ের দোকানে এ নিয়ে কথা হয়। তারা সকলেই বিষয়টিকে আতংক নয়, ভাইরাস জনিত রোগ আখ্যায়িত করেছেন। গনি মেম্বার জানান, প্রতিদিনই তারা খবর পাচ্ছেন। কিন্তু করার কিছুই নেই। পানি থেরাপী দিয়ে নিরাময়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
চা দোকানদার শফিকুল ইসলাম জানান, তার ভাইপো জাকিরও এ রোগে আক্রান্ত হয়। তাকেও পানি থেরাপী দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে। তিনিও পুরুষাঙ্গ সংকোচিত হওয়ার বিষয়টি জানান।
নাভারণ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা জানান, তার গ্রাম খামারপাড়ায় অনেক বাড়িতে এ রোগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সন্ধ্যা হলে আক্রান্ত হচ্ছে সকলে। এরপর সারারাত তাদের পানিতে নামিয়ে রাখা হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, সন্ধ্যা হলেই সকলের মাঝে আতংক বেড়ে যাচ্ছে।
লক্ষণপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহরম আলী জানিয়েছেন, রামচন্দ্রপুর গ্রামে ৩৫ জন, দুর্গাপুর গ্রামে ২৫ জন, সালতা গ্রামে ৪জন, খামারপাড়া গ্রামে ১২জন, লক্ষণপুর গ্রামে ৩জন, বেদেপুকুর গ্রামে ৪জন কারিকরপাড়ায় ১০জন, বেলতা গ্রামে ৪জন এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন। তিনি আরো জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কিন্তু কার্যকরী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
তিনি বলেন, রোগীদের অতিরিক্ত পানি ও বরফ দিয়ে ভেজানো হলেও কেউ সর্দিতে ভুগছেন না।
রোগ নিয়ে ব্যবসা
এ রোগকে পুঁজি করে চলছে কোয়াক চিকিৎসক, কবিরাজ ও হুজুরদের রমরমা ব্যবসা। কোয়াক চিকিৎসকরা গ্রাম ঘুরে ঘুরে এ রোগের ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দিচ্ছেন। সর্বত্র আতংক থাকায় সুযোগ সন্ধানী এসব চিকিৎসকরা মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। নারিকেলবাড়িয়া গ্রামের শাকিলাকে সর্বসাকুল্যে ২শ' টাকার ওষুধদিয়ে এক হাজার টাকা বাগিয়ে নিয়েছেন কথিত ডাক্তার সাজ্জাদ হোসেন। তিনি যেখানেই রোগী দেখেছেন সেখানেই সমপরিমান টাকা নিয়েছেন বলে জানান স্থানীয়রা।
এবিষয়ে সাজ্জাদ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওষুধের দামসহ ফি গ্রহণ করেছি। তিনঘন্টা সময় ব্যয়ের তো একটা ফি আছে তাই না।
এছাড়া আতংকিত মানুষ রোগ নিরাময় ও নিরাপদ থাকতে ছুটছেন স্থানীয় হুজুর ও মৌলভীদের কাছে। স্থানীয়রা জানান, সীমান্ত বুলবুলী হুজুর নামে খ্যাত মিজানুর রহমান ফারুকী, গাতীপাড়া গ্রামের হাফেজ ফজলুর রহমান ও তার ছেলে হাফেজ ক্বারী আবু তালহাসহ স্থানীয় অনেক হুজুর এ রোগের ফিকির দিচ্ছেন।
হাফেজ ক্বারী আবু তালহা জানান, আল্লাহ রোগ দেবার মালিক। এ রোগ আগে কখনও দেখা যায়নি। আখলাক (চরিত্র) এর অবনতির কারণে আল্লাহর তরফ থেকে গজব নাজিল হয়েছে। হেফাজতে থাকার জন্য তিনি ঘর বন্ধ, পানি ও সুতা পড়া এবং তাবিজ দিচ্ছেন। খুশি হয়ে যে যা দিচ্ছেন হাদিয়া হিসেবে তা রাখা হচ্ছে।
মসজিদগামী সকলে
আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছে তাই রোগাাক্রান্ত ও পরিবারের সদস্যরাসহ এলাকার সকল মানুষ নামাজ-কালামে মনযোগী হয়েছেন। এখন প্রতিদিনই এলাকার মসজিদ গুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। নামাজের পর বিশেষ মোনাজাত ও গজব থেকে পরিত্রান পেতে আল্লাহর করুণা কামনা করছেন বলে জানান রহিমপুর আলীম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ শহিদুল্লাহ। এমনকি দোয়া মাহফিলও করা হচ্ছে রোগাক্রান্তদের বাড়িতে।
চিকিৎসকরা যা বলছেন
এবিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন ডা. তরুণ কুমার শিকদার জানান, এটা কোন রোগ নয়, স্রেফ ভাওতাবজী। এরকম রোগ বলতে কিছুই নেই। ভারতের অপপ্রচার ও কথিত কবিরাজদের স্বার্থের কারণে এ আতংক ছড়ানো হয়েছে। যে কারণে সীমান্তবর্তী মানুষ মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। তিনি আরো বলেন, আতংক মেটাতে স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম জোরদার করা হচ্ছে। এছাড়া আজ একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে যাবে এবং রোগাক্রান্তদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন। তিনি সকলকে গুজবে কান না দেবার জন্য আহবান জানিয়েছেন।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




