ভ্রমনের সেই স্মৃতিচারণ অভিজ্ঞতার কথা আজও অনেক বেশি মনে পড়ে । আর মনে হয় বিখ্যাত সেই মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের কথা ‘পৃথিবীতে যদি কোথাও স্বর্গ থাকে, তবে তা এখানেই আছে, এখানেই আছে এবং এখানেই আছে।’ এমন জায়গায়টি তে কে না যেতে চায়? আসলেই তাই প্রকৃতির অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেখানে হাতছানি দিয়ে থাকে , সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট ওপরে সবুজ উপত্যকা আর শান্ত হ্রদে ঘেরা জায়গাটিকে কেনই বা সম্রাট এমন উপমায় আখ্যায়িত করবে না । আমার চোখে এখনও বর্ণনাতীত এক জায়গায় নাম এটি । হয়তবা এই জন্যেই লোকমুখে শুনি এই জায়গাটি কে পৃথিবীর স্বর্গ বলা হয় । হাঁ এমনি একটা জায়গায় নাম কাশ্মীর । অপূর্ব সৌন্দর্যের এক তীর্থভূমি ।এখনও যেন সমস্ত স্মৃতিচারণ চোখে লেগেই আছে ।
সবকিছু ছিল ছবির মতো। কোটি কোটি বুনো ফুলে ঢাকা উপত্যকায় ছুটে বেড়ানো ঘোড়ার দল, পাইন, ফার, বার্চগাছের সারি, নীল আকাশে মাথা গুঁজে থাকা পর্বতজুড়ে মেঘেদের খেলা, সেখান থেকে নেমে আসা দুরন্ত ঝরনার নাচ, পর্বতমালার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা রাস্তা, কখনো মাটি থেকে হাজার হাজার ফুট ওপরে, কখনো বা ঢাল বেয়ে সটান নিচে, কখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতরে, আবার কখনো রাস্তার ধারালো বাঁকে গভীর গিরিখাদের নিচে উন্মত্ত পাহাড়ি নদী। সব মিলিয়ে যেন একটা স্বপ্ন দেখার মতো অভিজ্ঞতা ছিল। প্রথমেই বলি আমার এই অভিজ্ঞতার সঙ্গী ছিল আমার দুজন বন্ধু রাফি ও ফয়সাল . ওরা দুইজনই ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ যদিও একটা ব্যাপারে তারা সর্বদা এক আর সেটা হচ্ছে ভ্রমন । সেই ছোট থেকে দেখে আসছি ওদের এই একটি ব্যাপারে সবসময় একাগ্রতা প্রকাশ করে আসছে এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি । প্রতিবারের মতন এইবারও আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম ...... কিন্তু এইবার গন্তব্য একটু সীমাহীন
যেভাবে গিয়েছিলাম : প্রথমে আমরা সকালের নাস্তা সেরে কলকাতার হাওড়া স্টেশন থেকে জম্মুর উদ্দেশে ছেড়ে গেল আমাদের ট্রেনটি । প্রায় ৩৭ ঘন্টার পর আমরা পৌঁছালাম জম্মু রেল স্টেশনে । তারপর সেখানে কিছুটা সময় থাকার পর জম্মু থেকে শ্রীনগরের উদ্দেশে রওনা হলাম । যেহেতু জম্মু থেকে শ্রীনগর যাবার সারাসারি রেল যোগাযোগ নেই তাই আমরা বাধ্য হয়ে হুইল জিপে করে শ্রীনগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম । প্রায় আনুমানিক সাত ঘন্টার রাস্তা পার হবার পর আমরা আমাদের গন্তবে পোঁছালাম ।
যেখানে ছিলাম : জিপ থেকে নেমেই লোকমুখে শুনি বোটহাউসের কথা রাজকীয় রাত কাটানোর স্থান নাকি সেটা । আসলেই অপূর্ব হ্রদের তীরে ঘেঁষে আছে সারি সারি বোটহাউস । দেখতে ছোট খাটো লঞ্চের মতো । তারপরও পানির মধ্যে যেহেতু তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম রাত থাকব না কিন্তু উপভোগ করব এই সৌন্দর্য।
আমরা একটা ছোট হোটেল ঠিক করলাম । হোটেলে ফিরে গিয়ে রেস্ট নিয়ে আমরা বিকালে বের হব কিন্তু বিকালে প্রচন্ড বৃষ্টিতে সমস্ত পরিকল্পনা পন্ড করে দিল তারপরও আমরা তিনজন বারান্দা থেকে পুরো পরিবেশটা উপভোগ করলাম নিজেদের মতন করে । আমার বন্ধু রাফি ওর বর্ননা একটু দিয়া যাক খুব চা পাগল প্রতি মূহুর্তে তার চা ছাড়া চলে না ফয়সাল ঠিক তার উল্টাটা অনেক পরিষ্কার পরিছন্ন সবসময় গুছিয়ে চলতে পছন্দ করে অনেকটা মেয়েদের মতন নেকা স্বভাবের এই জন্য অনেকের কাছে কথা শুনে তারপরও পরিবর্তন হয়না ।
তারপর দিন সকালে ৮. ২৫ মিনিটে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে আমরা লাদাখ উদ্দেশে রওনা হলাম । লাদাখ শব্দটি কানে আসলেই চিরসুন্দর প্রকৃতি থেকে শুরু করে চিরসুখী মানুষদেরও কল্পনা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অবশ্য এই রূপকল্পটা যে খুব একটা অতিরঞ্জিত, তা কিন্তু নয়। মুঘল সম্রাট শাহজাহান বলেছিলেন, পৃথিবীতে যদি স্বর্গ বলে কোনো স্থান থাকে তবে সেটি কাশ্মীর। কিন্তু শাহজাহান যদি একবারও লাদাখ ঘুরে আসতে পারতেন তাহলে নিশ্চিত তার স্বর্গের ঠিকানা পাল্টে যেত। আসলেই তাই আর এক অপূর্ব সুন্দর জায়গা লাদাখ । আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা আর মরুর এক দেশ যেন লাদাখ । যখন সেখানে পৌঁছালাম তখন মনে হল সপ্ন যেন হাতের মুঠোয় আমাদের । আর এবার স্বপ্নের শেষসীমায় যাত্রা , ভারত এবং চীন সীমান্তবর্তী বিখ্যাত প্যাংগঙ্গ লেক । স্বচ্ছ নীল পানির এই হ্রদের পাশে বসে থাকাটা ছিল আমাদের জীবনের একটা স্মরনীয় মুহুর্ত । যা সত্যেই ভাষায় প্রকাশ করার সম্ভব নয় । জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি যেন এক মুহুর্তে লাঘব হয়ে গিয়েছিল ।এবার আমাদের উদ্দেশ্য স্বপ্নের আরেক জায়গা কাশ্মীর । কাশ্মীরের আবহাওয়া সম্পর্কে আগে থেকেই আমাদের একটু জানা শুনো ছিল তাই পর্যাপ্ত পোশাক আশাক নিয়ে আমরা রওনা হলাম । কাশ্মীর মানেই তো বরফের রাজ্য , এত বছর শুধুমাত্র তুষার- আবৃত কাশ্মীরের বিভিন্ন ছবি দেখে এমন ধারনাই জন্মে ছিল আমাদের সবার কিন্তু সেখানে গিয়ে অবাক তুষারপাত কই , আমাদের তো মাথা খারাপ অবস্থা একি ..!!! পরে স্থানীয় লোকজনের থেকে জানতে পারলাম ভরা- গ্রীষ্মে শুধুমাত্র সোনমার্গই বরফে আচ্ছন্ন থাকে । শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিলোমিটার হবে । কিন্তু বিপদগামী পাহাড়ী রাস্তা হাওয়াতে সময় লাগলো একটু বেশি । সোনমার্গ পার্কিং গিয়ে আরেক অবাক কান্ড চারদিকে শুধু ঘোড়া আর ঘোড়া । এ যেন ঘোড়ার রাজ্য । সোনমার্গ লোকাল ভিউ দেখতে হলে সোনমার্গের বাইরের থেকে আসা কোনো গাড়িতে যেতে দেওয়া হয়না । এটা সেখানকার নিয়ম ছিল তাই স্বাভাবিকভাবেই আমরা মার্কা টাটাসুমো ভাড়া করলাম । এরপর আমাদের ঘুরা শুরু হল কিছুক্ষন পরই দেখা মিলল আমাদের সেই সপ্নের তুষার ছাওয়া পর্বত চূড়ার , তবে অনেক উচুতে . যা অধরাই থেকে গেল ।
রাফি তো রীতিমত বলেই বসল কেন আসলাম এখানে কিন্তু ওইযে একটা প্রবাদ ; অপেক্ষার ফল সু-মধুর হয় ; হয়তবা তাই আমরা নিরাশ না হয়ে শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম আর তার ফলও পেলাম হাতে নাতে। অবশেষে সত্যেই দেখা মিল তুষার আর বরফের সংমিশ্রিত এক মনমুগ্ধকর পরিবেশ । আমরা যেন শৈশবের সেই ছোট বেলায় হারিয়ে গেলাম , সমস্ত বাঁধা -বিপত্তি, লাজ- লজ্জাকে পিছনে ফেলে যে যার খুশি মতন বরফ নিয়ে একে অন্যর গায়ে মারছিলাম ।সেই বরফ যেন আজও গায়ে মেখে আছে , এখনো বার বার মনে হয় সেই স্বপ্নের পথযাত্রার কথা ..... মনে হয় সেই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আবারও সেই স্বপ্নের দেশে হারিয়ে যায় ....... যেখানে খুঁজবে না কেউ ..... থাকবে না হাজারোও বাঁধা -নিষেধ ..... রইবে না প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির মাঝে বিরাট শূন্যতা ...... শুধুই রইবে প্রকৃতির নির্মল ভালবাসা......
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:২০