
মব, নাকি পুর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা?
ইউনুসের হাতে বাংলাদেশ এখন এমন এক অবস্থায় যাকে অনেকে বলেন 'মবতন্ত্র', যেখানে রাজনীতি মানে উন্মত্ত জনতার আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন। তবে, সব সহিংসতাকে মব বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। এই ধরনের উন্মত্ত জনতার অংশগ্রহনে মব সহিংসতা গুলোর আড়ালে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সহিংসতার একটি স্পষ্ট ও ভয়ানক ধারা দেখা যায়। একদল মানুষ মিলে সহিংসতা করলেই সেটিকে “মব অ্যাটাক” বলে ঘোষণা দেওয়াটা ইউনুস সরকারের একটা চালাকি যার দ্বারা এই অবৈধ সরকার এসব নৃশংসতার দায় ও জবাবদিহিতা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
২০২৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি যাদুঘর ও হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িঘরে হামলার ঘটনার কথাই ধরা যাক। ২০২৫ সালের ৫-৬ ফেব্রুয়ারির যে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছিল, তা কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া স্বতঃস্ফূর্ত মব-সহিংসতা ছিল না। এই হামলা চালানো হয়েছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি গোষ্ঠীর কর্মী-সমর্থকদের মাধ্যমে—যার মধ্যে ছিল স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট ডিসক্রিমিনেশন (SAD) মুভমেন্ট, জামায়াতে ইসলামী, এমনকি বিএনপিও। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট: অপরাধমূলক ভয়-ভীতি দেখিয়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতা শেখ হাসিনাকে স্তব্ধ করে দেওয়া।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এই হামলাগুলোকে উস্কে দেওয়া হয়েছে এবং সামাজিক মাধ্যমে খোলাখুলিভাবে উদযাপনও করা হয়েছে। এমনকি সরকারের উপদেষ্টারাও এতে অংশ নিয়েছিল। হামলাকারীরা নিজেরাই তাদের অপরাধমূলক কাজ লাইভস্ট্রিম করেছে। আর পুলিশ ও সেনারা দাঁড়িয়ে থেকেছে সাধারণ দর্শকের মতো। বুলডোজার ও ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে ভবন ভাঙচুর করা হয়েছে। এটা কোনো হঠাৎ ঘটতে থাকা মব-সহিংসতা ছিল না। বরং পুরো ঘটনাটি যে পরিকল্পিত ও সমন্বিত আক্রমণ, সেটা স্পষ্ট ছিল।
একইভাবে ২০২৪ সালের আগস্ট ও অক্টোবরে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দু’বার অবরুদ্ধ হয়েছিল। সেখানে কোনো হঠাৎ জড়ো হওয়া ভিড় ছিল না, বরং সমন্বিতভাবে সংগঠিত তথাকথিত 'জনতা' হাজির হয়েছিল প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারকদের পদত্যাগের দাবিতে। এই কর্মসূচি সাজানো হয়েছিল এসএডি মুভমেন্টের (SAD Movement) রাজনৈতিক নির্দেশনায়, যেখানে বিএনপি-জামায়াত ঘনিষ্ঠ আইনজীবীরাও সহযোগিতা করেছিল। জনতার ক্ষোভের নাটকীয়তা ব্যবহার করে বিচার বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হয় যাতে— দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও তাদের রাজনৈতিক মিত্রদের পরিকল্পনার পথে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় পার্টির অফিসে হামলাগুলোও ছিল সংগঠিত রাজনৈতিক সহিংসতা, যার উদ্দেশ্য ছিল ভয়-ভীতি ছড়িয়ে দেওয়া। গণঅধিকার পরিষদের কর্মী ও সমর্থকেরাই এই হামলার জন্য দায়ী। অন্তত ১২টি জেলায় জাতীয় পার্টির কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এসব হামলা সমন্বিতভাবে চালানো হয়েছে। উত্তেজিত মবের নাটক সাজিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণই ছিল আসল উদ্দেশ্য—আর তা হয়েছে ইউনুস সরকারের নীরব সমর্থনেই।
ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত সহিংসতাকেও মব-সহিংসতা বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—ইউনুস সরকারের আমলে বাংলাদেশজুড়ে একশোরও বেশি সুফি মাজার ও দরবার শরীফে হামলা হয়েছে। এগুলো ভাঙচুর করা হয়েছে, আগুন দেওয়া হয়েছে, লুটপাট চালানো হয়েছে। কোথাও কোথাও আবার খাদেমদের ওপর হামলা হয়েছে, এমনকি তাদের হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। এইসব নৃশংসতা চালিয়েছে চরমপন্থী ইসলামপন্থীরা, যারা নিজেদের “তৌহিদি জনতা” নামে পরিচয় দিচ্ছে।
বাস্তবে তথাকথিত “তৌহিদি জনতা” আসলে হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জামায়াতে ইসলামি এবং এমনকি বিএনপি-ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন গোষ্ঠীর কর্মী, অনুসারী ও সমর্থক ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের উদ্দেশ্য হঠাৎ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো নয়, বরং পরিকল্পিত ধর্মীয় নিপীড়ন। সুফি আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে তারা ভ্রান্ত বা ভিন্ন মতবাদ হিসেবে দেখে, আর সেটিকেই টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে। এ ধরনের আক্রমণকে সাধারণ মব-সহিংসতা বলে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না—এগুলো মূলত পূর্বপরিকল্পিত সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক দমন।
ইউনুস সরকারের প্রতিক্রিয়াও এসব ঘটনায় অনেক কিছু প্রকাশ করেছে। ওপরের উল্লেখিত রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলোতে ইউনুস সরকার নিন্দা জানানো তো দূরের কথা, কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থাও নেয়নি। বরং রাজনৈতিকভাবে এসব হামলাকে তারা ন্যায্যতা দিয়েছে। ইউনুস নিজেও এই পরিকল্পিত সহিংসতাকে বলেছেন “বিপ্লবী চেতনায় সংঘটিত কাজ”। তার প্রেস অফিস আবার “মব” শব্দটিকে নতুন করে সাজিয়ে বলছে “প্রেসার গ্রুপ”। অন্য কিছু ঘটনায় আনুষ্ঠানিকভাবে নিন্দা জানানো হলেও কথার সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক স্পষ্ট। হামলার সকল প্রমাণাদি থাকার পরও গ্রেপ্তার ও বিচারপ্রক্রিয়া পিছিয়ে আছে, যাতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে সরকার হয় নীরবে এসব সহিংসতা মেনে নিচ্ছে, নয়তো লোকদেখানো প্রতিক্রিয়া দেখানোর কৌশল নিচ্ছে।
একাধিক কারণে, বিশেষ করে মিডিয়াকে সতর্ক থাকতে হবে যে সংগঠিত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সহিংসতাকে মব-সহিংসতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা যাবে না, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
* এটি সরকারের উপর রাজনৈতিক ও নৈতিক জবাবদিহিতা এড়ানোর সুযোগ তৈরি করে।
* এটি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ ও অনাস্থাকে অবমূল্যায়ন করে।
* এটি রাজনৈতিক বা ধর্মীয় যেকোনো পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞকে দায়মুক্তভাবে চালানোর সুযোগ দেয়।
যদিও “মব অ্যাটাক” শব্দটি সমসাময়িক বাংলাদেশের অনেক বিশৃঙ্খলার দৃশ্য বর্ণনা করতে পারে, এটি সত্যিকে ভয়ঙ্করভাবে আড়াল করে। ইউনুস সরকারের আমলে যে সহিংসতার একটি বড় অংশ ঘটেছে, তা গভীরভাবে সংগঠিত, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, এবং কৌশলগতভাবে পরিচালিত।
#Bangladesh #Yunus
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ২:১৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



