মো: সাখাওয়াত হোসেন বেলাল
মোহাম্মদ শুয়াইব
বাঙালি জাতি হিসেবে মেধাশূন্য- এ কথা মানতে আমরা নারাজ। কারণ এ দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ যুগে যুগে জন্ম দিয়েছে নানা মহারথির। তাঁদের জ্ঞান-গরিমার ব্যপ্তি দেখে সারাবিশ্ব তাঁদের পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এমন বিদ্বান মানুষের সংখ্যা কি দিন দিন কমে যাচ্ছে? যদি কমেই যায়, তবে তার নেপথ্যে কারণ অনুসন্ধান করা আবশ্যক বলে মনে করি।
প্রথমেই শিক্ষার সংজ্ঞায়ন করতে গেলে বলতে হয়- শিক্ষা হলো মানুষের অন্তরের জগতকে বিকশিত তথা আলোকিত করার হাতিয়ার। একজন শিক্ষিত মানুষ তার অন্তরের আলো দিয়ে সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের ফারাক করতে সমর্থ হন। অন্যদিকে একজন অশিক্ষিত লোক সে ক্ষমতা হতে বঞ্চিত।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখতে গিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, সরকারি বড় আমলা হওয়ার স্বপ্ন ব্যক্ত করে থাকে। কিন্তু কোন ছাত্রকে কখনো বলতে শুনিনি- আমি বড় হয়ে লেখক-কবি-সমাজসেবক হবো। এর কারণ ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার হয়ে জীবনধারণ করা যতটা সহজ, লেখক-কবি হয়ে জীবিকা নির্বাহ করা ততটাই দুরূহ এবং কষ্টসাধ্য। পিতা-মাতারাও চান তাদের সমত্মানেরা এমন পেশা বেছে নিক যার দ্বারা তারা স্বচ্ছন্দ্যে জীবনধারণ করতে পারে। একথা মানি যে, জীবনে বাঁচতে হলে অর্থের প্রয়োজন আবশ্যক। কিন্তু অর্থপ্রাপ্তিই যদি জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে ঐ ব্যক্তির কাছ থেকে দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র কিছু পাওয়া হতে বঞ্চিত হবে- এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর একটি বাণী প্রণিধান যোগ্য- আমরা সাহিত্যের রস উপভোগ করতে প্রস্তুত নই কিন্তু শিক্ষার ফল লাভের জন্য উদ্বাহু। সত্যিই তো সমাজের চিত্র এমনই যে, যদি সন্তান গল্প-উপন্যাস কিংবা প্রবন্ধ পড়ে, তবে অধিকাংশ পিতা-মাতাই তাতে দ্বিমত করেন। কারণ এসবের সাথে তারা অর্থপ্রাপ্তির কোন যোগসাজশ বোধকরি খুঁজে পান না ।
যুগের অগ্রগতির সাথে সাথে বিদ্যাশিক্ষা অর্জনের পদ্ধতিতেও এসেছে অনেক আমূল পরিবর্তন। কম্পিউটার-মোবাইল কিংবা ই-বুক রিডারে বসে এখন অনায়াসেই বই পড়া যায়। এখন প্রশ্ন হলো এই সহজসাধ্য পদ্ধতি অবলম্বন করে আমরা কতটুকু লাভবান হচ্ছি; আমাদের জ্ঞানের গভীরতাই বা কতটুকু বাড়ছে। একজন শিক্ষার্থী যখন একটি শব্দ অভিধানে খুঁজতে যাবে, তখন আরও অনেক শব্দের সাথে পরিচিত হবে। এতে তার জ্ঞানের পরিধি বাড়বে ছাড়া কমবে না বৈকি। কিন্তু একজন ছাত্র যখন ডিকশনারি সফটওয়ারে একটি ক্লিকের মাধ্যমে শব্দের অর্থ অতি সহজে জেনে যাবে, তখন ঐ শব্দের অর্থ কতদিন তার স্মৃতিতে গেঁথে থাকবে তা কিন্তু ভাববার বিষয়। কারণ, বিনা পরিশ্রমে কোন কিছু অর্জনে একদিকে যেমন কোন তৃপ্তি নেই, তেমনি অন্যদিকে এর স্থায়িত্বও অনেক কম বলে আমরা মনে করি।
বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কোন শিক্ষার্থীকে যদি প্রশ্ন করা যায়- কেন পড়াশুনা করেন? নিশ্চিত করে বলা অধিকাংশ শিক্ষার্থী-ই একই জবাব দেবে পাশ করে ভালো চাকরি করব তাই পড়ি। উত্তর যথার্থ হল কিনা সম্মানিত পাঠক বিবেচনা করে দেখবেন।
এবার আসা যাক শিক্ষকদের প্রসঙ্গে।একটা সময় দেশে হাতে গোনা কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। তখন শিক্ষকদের সময় কাটতো সকালে ক্লাস নিয়ে এবং বাকি পুরোটা সময় পড়াশুনা, লেখালেখি কিংবা গবেষণায়। প্রায় প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি করে দেশে ফিরতেন। এখন এ সংখ্যা নিতান্তই কম এবং যারাও বিদেশে যান তারা আর দেশে ফিরতে চান না। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেশিরভাগ সময় কাটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে। তাঁদের ব্যক্তিগত পড়াশুনা কিংবা গবেষণা করার সুযোগ-সময় কোনটাই মেলে না। ফলে একদিকে যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শিক্ষকদের মূল্যবান সংস্পর্শ হতে বঞ্চিত হচ্ছে; তেমনি দেশও বঞ্চিত হচ্ছে বিদগ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকপ্রাপ্তি হতে। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আনোয়ার হোসেনের মতে, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ তালিকা যতই বড় হোক না কেন, অবশ্যই লাইব্রেরির সাথে তাঁর নিয়মিত যোগাযোগ থাকা আবশ্যক। ১৯৯৭ সালে তাঁর পরিচালিত এক জরিপ থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকেরই লাইব্রেরি কার্ড নেই- এ চিত্র সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক।
এখন আসা যাক এ সংকটের সমাধান প্রসঙ্গে। প্রথমত: পিতা-মাতাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসা প্রয়োজন। তাঁরা যেন তাদের সন্তানদের ভিন্ন স্বাদের বই পড়তে উৎসাহ প্রদান করেন। এজন্য প্রত্যেক পরিবারের একটি করে লাইব্রেরির ব্যবস্থা থাকতে পারে। এর ফলে একটি শিশু শৈশব হতেই মননশীল পরিবেশে বেড়ে উঠবার সুযোগ পাবে। দ্বিতীয়ত: প্রত্যেক স্কুলে লাইব্রেরির সাথে শিক্ষার্থীর আত্মিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে; এবং শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত: শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-কমিশন গঠন করতে হবে। যাতে করে শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের কথা ভাবতে না হয়। চতুর্থত: বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের গবেষণামূলক কাজে অংশগ্রহণের হার আরও বাড়াতে হবে। এজন্য শিক্ষার জন্য সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। পঞ্চমত: দেশের মাঝেই প্রত্যেক বিষয়ের কর্মসংস্থান এমনভাবে সৃষ্টি করতে হবে যাতে করে কোন শিক্ষাার্থীকেই হতাশায় ভুগতে কিংবা মেধাপাচারের শিকার না হতে হয়।
আশা করি, উপরে উল্লিখিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে উন্নত ও জ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না।