somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনন্ত দশকের কবি শোয়েব শাদাব এবং প্রতিদিন পাখির সিম্ফনি

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ ভোর ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘যদিও ঘোড়ার লিঙ্গের মতো ভয়’ আমাদের অন্তরে অস্তিত্বশীল তবু এ-যাত্রা কিছুতেই যেন থামাতে পারিনা। এ-দিবসে ‘মধ্যাহ্ন আকাশের রং পোড়া ভাতের মতো’ মনে হচ্ছে; অদূরে দৃশ্যমান ‘নীলিমার কোলে ছিন্ন ভিন্ন নীল ঈগলের ডানা’। যাত্রারম্ভ হতে পারে আশির দশকের কবি শোয়েব শাদাবের গ্রাম ময়মনসিংহের ত্রিশালে। ঐখানে ‘রৌদ্রের তাপে বরফ গলে সিংহের কান্নার মতো’। আমরা অজ্ঞাত নই- শোয়েব শাদাবের সান্নিধ্যের জন্য যদিও ত্রিশাল আমাদের গন্তব্য কিন্তু অবশ্যম্ভাবীভাবে যেতে হবে অশেষ প্রস্তর যুগে, কখনোবা এই পৃথিবীর অনেক অনেক বাইরে। রক্ত ও মাংসের শোয়েব আমাদের কাছে সয়ম্ভূ অনেকটা এ-রকম- ‘রক্তের গভীরে যেনো ঘাই মারে বিষধর শিং। ঊরুর আগুনে চেপে যৌবন বল্লম/কেঁপে উঠি মধ্যরাতে/স্বপ্নের ডানার মতো নেমে আসে সংখ্যাহীন সিল্কের বালিশ।’
আমরা জানি, আশির দশকের এই কবি ১৯৯২ থেকে অসুস্থ হয়ে শেকলবদ্ধ জীবনযাপন করছেন তাঁর নিজ গ্রাম ত্রিশালে। সুস্থাবস্থায় কবি নিজ হাতে পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন- অশেষ প্রস্তর যুগ, প্রকৃতি ও রং তুলি। ২০০৯ সালে উলুখড় কর্তৃক শোয়েব শাদাবের কবিতা সংগ্রহ প্রকাশের পর যা আমাদের কাছে দ্বিরুক্ত হয়- সংখ্যা নয়, মানই হচ্ছে কবিতার মানদণ্ড। শোয়েবের কবিতা এতোই শক্তিশালী যে- পাঠশেষে অন্তরে অজস্র প্রতিকবিতার অস্তিত্ব টের পাই কিন্তু গদ্যের ভেতর ঘোড়ার গতি জুড়ে দেয়া প্রায়-অসম্ভব মনে হয়; যেহেতু তাঁর কবিতায় গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে অজস্র বিন্দু এবং উপবিন্দুর উত্থান। আমাদের যাত্রাপথে তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে তাকে বহুবিধ পথের রেখা, আগুনের ভেতর আগুন রঙা জিহ্বার গান। ত্রিশাল যাত্রা কি থামিয়ে দেয়া যায়! ‘জল কুকুরের ডাক/শোনা যায় সন্ধ্যার বাতাসে/আরো দূরে/অরণ্য কিনারে/সিংহের ক্রন্দন/হেডিসের গতি।’
‘শিবচিহ্নিত মাথা/রক্তের পেছনে ঘুরবে, কালাকাল।’‘হাঁসগুলো ভেসে চলে নদীর উজানে/পিছে পিছে সাপ,গোখরার ফণা’
আমরা ঐ গ্রামে যাবো যার গল্প তিনি শুনিয়েছেন এইভাবে-
‘সে এক গ্রামের কথা শোনাবো তোমাকে/ধরো আঁকাবাঁকা নীল আকাশের রেখায়/তুমি এসে দাঁড়িয়েছো স্তম্ভিত, আফ্রোদিতি।’ গ্রাম-১
‘কাশবন থেকে ভেসে আসে যে প্রাকৃত সুর/প্রতিদিন সন্ধ্যায়/ প্রতিদিন পাখির সিম্ফনি-বেহেস্তের সিম্ফনি’
গ্রাম বিষয়ে আমাদের মধ্যে যে যাত্রা তৈরি হয়, আর যখন যাত্রা শুরু করি, বিভ্রান্ত হই, সব গন্তব্য নিমিষে নাই হয়ে গেলে মনে হতেই পারে- নক্ষত্রের ঐপারে আরও নতুন কিছু নক্ষত্রের জন্ম হল যেন! চলে যেতে হয় যুগ হতে যুগে, অশেষ প্রস্তর যুগে- ‘সেই গ্রাম পৃথিবীর বাইরে কোথাও/হয়তোবা নীল পরীর দেশে। গ্রাম-২
‘আমার পিতার একটি উজ্জ্বল রংমহল ছিলো/আমাদের নিঃসন্তান মায়েরা সেখানে নাচতো/ঘুঙুরের শব্দে অসীম বৃষ্টি ঝরাতো আমাদের নিঃসন্তান মায়েরা/ কিংবা চাবুকের সপাং সপাং ্আাঘাতে/নগ্ন শরীর থেকে/ রক্তের লাল নীল ঝরণা বহাতো/আমাদের নিঃসন্তান মায়েরা/আর প্রতিরাতে অন্ধ খোঁজার সঙ্গে সঙ্গমে মিলতো/আমাদের নিঃসন্তান মায়েরা (রঙমহল)
‘সিংহের ক্রন্দন/শোনা যায়/দূর বনে (অশেষ প্রস্তরযুগ)

০২
একজন্মে মানুষ কবিতা লিখতে পারে না, মানুষ কবিতা লেখে মৃত্যুর পরে। এ-রকম আত্মবিধ্বংসী অনুভূতি থেকেই কি শোয়েব শাদাব লিখলেন- যে ছবি আঁকেনি কেউ/কবরে আঁকবো আমি সেই ছবি (কালো মেয়ে)। যেহেতু মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নিয়ে জগতে কেউ কিছু রচনা করেনি বা করতে পারে না তারপরও মৃত্যু, প্রেম, সূর্য, নারীসূর্যে যিনি বুঁদ হয়ে থাকেন, শেষবিন্দু স্পর্শের জন্য যিনি বিধ্বংসী অথচ সৃষ্টিশীল তিনিই কি কবি! নিজের কবিতা নিয়ে শোয়েব যেন সত্য বললেন-‘নক্ষত্র, সে যদি সমুদ্র হয়/আমার কবিতা হবে ইতিহাস/আর ইতিহাস যে তো হাজার নক্ষত্র/কিংবা জিসাসের ঘুমন্ত আত্মা।’ কবিতার জন্যই শোয়েব তেজাব তীব্র হলেন-‘আজ আমি শুদ্ধতম শিল্পের বারোটা বাজাবো/সত্য ও মিথ্যার বুক চিরে খেয়ে নেবো সবটুকু হৃদপিণ্ড’‘আজ আমি হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে জাগাবো বেদনা/অবশেষে ছুঁড়ে দেবো একমুখ থু থু।’
শোয়েব শাদাবের নারী এবং তারঙ্গিক সূর্যের ভেতর দাউ দাউ করা ডিম ও যোনি ও ঊরুর অস্তিত্বে শুধু বিস্মিত হই না, গভীরতম বিন্দুবোধে লক্ষ্য করি রক্ত সূর্য ও মাংসের ক্রমরূপান্তর। জাজ্জ্বল্যমান যে নারীসূর্যে রক্তের দাগ লেগে থাকে ক্রমে তা ঘনীভূত হয়ে, ডিম হয়ে, স্তন-ঠোঁট-নাভীর মতো সয়ম্বূ হলেই কেঁপে ওঠে আমাদের মন, মগজ, মনস্তত্ত্ব। অজান্তেই যেন উচ্চারিত হয়- হে মন হে বিহঙ্গলতা। শিকার সমাপ্ত হলে / হাড় ভেঙে মজ্জা খাওয়ার ধূম।/স্পন্দমান আদি সরীসৃপ/রক্তের অবিদিতি টোটেম-বিস্ময়ে / খোলস ধরায়/ নালী সূর্যের ডিমের ভেতরে।(জন্মান্তর) ‘শিকার করেছো পাখি এমুপাখি/ যে পাখি ডিমের কুসুমের / অর্থাৎ সূর্যের(এমু)
দেবী / তোমার শরীর তুলোর পাহাড়/স্তন/ঠোঁট/আর নাভী/ অতলে অনন্তে সমুদ্র(অশেষ প্রস্তর যুগ; দ্বিতীয় পর্ব)‘তুমি ছিলে গুপ্ত গন্ধের ভেতরে/ আমার অন্তরে (প্রেমের কবিতা) ‘যোনির সমুদ্রে/ সাঁতার কাটতে কাটতে পার হবো জন্মের দ্রাঘিমা(এই পরাজয় মানি না মানি না) ‘ আর্য রূপসীরা ঢেলে দেয় মধু রসকুম্ভ থেকে/ঘুমের ভিতরে আমি বেড়াল তখন/ধীরে ধীরে উঠে পাই এক রূপসীর স্তনে/ মনে হলো স্তন নয় প্রকৃত পর্বত/ স্বপ্নে যাকে দেখি মাঝে মাঝে/ ঘন লোমে ঢাকা তার স্তন মনে হলো দুটি নৌকো/ বৈঠা পাল / একটাতে আমি অর্থাৎ এখন বেড়াল/ আর অন্যটায় সে, অর্থাৎ আমার (খোলস) মুখোশ/ অনাগত দুধের নহরের (আর্য রূপসীরা) ‘চর্বির প্রদীপের আলোয়/বোবা জীবনের শিল্প ফোটে শক্ত তুলির আঁচড়ে/নারী তার ছায়া/রাত্রিভর জেগে থাকে পাশে/হাতে নিয়ে মৃত্তিকার রঙে ভরা পট।/গলায় তার বাঘের দাঁতের মালা/পাখির পালক কালো চুলের খোঁপায়। (অশেষ প্রস্তর যুগ-১)‘আখের পাতার মতো ধারালো শরীর/দুলিয়ে দুলিয়ে নাচে পাহাড়িয়া নারী/ পুড়িয়ে পশুর মাংস পুড়িয়ে আগুনে/অবিরাম ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে/অরণ্যের অতল জ্যোৎস্নায়(অশেষ প্রস্তর যুগ-২)। মেয়েটিকে চিনতাম আমি/বলো তো কী নাম?/তার চুল ছুঁয়ে থাকতো পাথরের ঘর/মুখখানি কবরের মতো ভাঙাচোরা। (প্রকৃতি-১)’‘তার পা দুর্দান্ত সিংহের কেশরে দুলতো(প্রকৃতি-৩)’।
পরম কস্তুরী ঘ্রাণ আর রমণীর রক্তাভ নাভীর কাছে কেমন আছেন শোয়েব শাদাব! এ-জিজ্ঞাসা ক্রমবর্ধিত হলে আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়-জন্মান্ধ ঈগল তার স্বয়ংক্রিয় ডানার আগুনে চিতার লাশের মতো দৃশ্যকে পোড়ায়,/ধ্বংসের পাহাড় গড়ে/কালো কালো কয়লার বিক্ষিপ্ত পাহাড়/এবং পাহাড়ে মৃত্যু অপেক্ষমান।’ সোনার কোদাল দিয়ে দুর্গম অন্ধকার খোঁড়ে খোঁড়ে আপনি কি ক্লান্ত এখন! আপনার রচনায় অক্লান্ত আমরা রাস্তার দু’ধারে দেখে নিই বঙ্কিম সাপের ফণা, যেমন মাছরাঙা দেখে দীঘির নীলত্ব। ত্রস্ত পদক্ষেপে আমরাও যাবো, পেয়ে যাবো জননী ও বেহেস্ত ও নরকের পার্ক। ‘আমার জননী ছিলেন মহামাতা মেরীর মতন অনূঢ়া কুমারী। আমি তার উৎপন্ন অগ্নিপি-।’‘কাশবন থেকে ভেসে আসে যে প্রাকৃত সুর/প্রতিদিন সন্ধ্যায়/প্রতিদিন পাখির সিম্ফনি;/তার মর্মরিত মূর্তির দেশ/হিমায়িত রক্তের কণায় তোলে ঢেউ/অন্ধকার আকাশের নিচে/তার কোনো রূপরেখা তোমার ছিলো না।(বেহেস্তের সিম্ফনী)‘কী চরম শাস্তি নিঃশেষে করতে হবে পান।/তা ছাড়া অগ্নির জুতো/অনন্ত শৃঙ্খলবেড়ি পরাবে পায়/তাছাড়া অগ্নির জুতো।(নরকচিত্র)কবিতার সংকেতবীজগুলো অনুধ্যায়ী অন্তরে অংকুরিত হলে বিস্তার, অন্তর্গত হিমায়িত আগুন। বিবর্তিত জল ও পাথরের ঘোড়ায় চড়ে যাত্রা তো থামাতে পারিনা। ঐ পথে আগ্নেয় পাথর কর্তিত মাথার মতো বিছানো। আমরা বিচলিত বোধ করি। রক্তে কুকুরের আত্মার গন্ধ পাই। আমরা ছুটে চলি‘এই রাত্রি,ট্যাবু,ভালুকের পিছনে চলে এস্কিমোর মতো।’ ‘যদিও জৌৎস্নার আকাশ থেকে অজস্র ধারায় চিত্রল হরিণ নেমে আসে কিন্তু ঘোড়া ও সিংহের উপস্থিতি এএতাই বিস্তৃত যেনো তাদের ভেতরেই সূর্যডিম একবার ভেসে ওঠে তারপর ডুবে যায়। এইসব ঘোরগ্রস্ত কবিতার পাশাপাশি কিছু স্নিগ্ধ সরল কবিতাও দুর্লক্ষ্য নয়- আমার জীবনে/স্বপ্ন নেই/সূর্য নেই/শূন্য মরুভূমি।/জলের তৃষ্ণা/পরাজিত আত্মায়/আমি কি মিথ্যা?/আমার জীবনে/বৃক্ষ নেই/সত্য নেই/শূন্য ভূমি।(অশেষ প্রস্তর যুগ;দ্বিতীয় পর্ব ১৭) কবিতা পাঠের এক পর্যায়ে আমাদের বারান্দায় হঠাৎ দাঁড়াতে পারে রাতের জিরাফ। গ্রীবা বাঁকিয়ে তাকাতে পারে মৃত্যু। ‘ওরে পাখি পায়ে তোর কে পরালো বেড়ি/ওগো মৃত্যু!মানবীর রূপ ধরে এসো দেবী, ডেকে/ নাও শয্যায় তোমার...অনন্ত রমণে আমি গলে/মিশে যাবো অনন্ত তোমর মাংসে মজ্জায়। (দৃশ্যভূক চোখ)’ ‘ক্রমশ বেড়েই চলে অযোনিজ যন্ত্রণা/দিনের দ্যোতনা আনে মৃত্যুর মন্ত্রণা/হাড়ে হাড়ে মজ্জায় শীতের কী কাঁপুনি/চুমুকে রক্ত খায় নারীরূপী বাঘিনী’ (অযোনিজ)। ‘ঘোড়াটি হঠাৎ তাকালো পেছনে/দুটি চোখ তার আগুনের থালা/এবং বড়োই রহস্যময়/ঘোড়াটি অমন তাকারো কেন মধ্যপথে?(কাঠের ঘোড়া)।’ ‘গড়িয়ে গড়িয়ে যাই/বুকে হাঁটা যেমন একজন পা-কাটা মানুষ/নিমখুন(আবহমান)।

০৩.
we murder to dessect- এদুয়ার মানের স্মরণযোগ্য কথাটির বীজ যেন শোয়েব শাদাবের কবিতায়ই অঙ্কুুরিত হয়। আশির দশকের কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, বিষ্ণু বিশ্বাস, শান্তনু চৌধুরী, শোয়েব শাদাব প্রমুখ কবিরা নিজকে ব্যবচ্ছেদ (anatomise) করেছেন উপরতলস্পর্শীভাবে নয়,নিগূঢ়ভাবে; নিরন্তর বিধ্বংসী হয়েছেন- এ কথার অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় গত পঁচিশ বছরের বাংলা কবিতায় অনুধ্যায়ী হলে। নার্সিসিজম নয়, মরবিডিটির এমন তীব্ররূপ তৎপরবর্তী দশকে প্রায়-অনুপস্থিত বললেও অত্যুক্তি হবার কথা নয়। নিগূঢ়ার্থে, শোয়েব শাদাবকে দশকের জলাবদ্ধতায় চিহ্নিত করা অযৌক্তিক মনে হলে আমরা তো বলতেই পারি- শোয়েব শাদাব অনন্ত দশকের কবি। শোয়েব সম্পূর্ণই আলাদা ষাট,সত্তরের কবিদের চেয়ে; শুধু প্রতীক রচনা, ভাষা প্রয়োগ বা চিত্রকল্প সৃষ্টিতেই নয় বরং সমূহ কবিত্বের বিচারে, জীবন যাপনের বিচারে। শোয়েব কোনো একঘেয়ে কবিতা রচনা না করলেও কিছু কিছু কবিতায় পূর্বতন কবিদের মতো গল্প বলার প্রবণতা দুর্লক্ষ্য নয়। অবশ্য গল্পস্থিত ছায়া ও ছায়ার ক্রমরূপান্তরে শাদাবের স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্যণীয়। যে ছায়ার কথাই আমরা বলিনা কেন হঠাৎ যেন সাপ হয়ে ফণা তোলে, তারপর ছায়ার ভেতরে দৃশ্যমান হয় স্তরে আকৃতি। আমরা ইমপ্রেশনিস্ট পাঠে উদ্বুদ্ধ হই বা বাধ্য হই ‘একটি শেয়ালের গল্প তোমাদের বলবো।/ভাগ্যের চক্রে রং বদল হলো তার। তারপর সে নিজেকে ঘোষণা করলো বনের রাজা (কুপোকাত) সে ছিলো নিরস্ত্র, শিকারি/ গুহার ভেতরে তার যাবতীয় সরঞ্জাম/ ছবি আঁকার পাত্র/শরীর ঢেকে আছে সিংহের ছালে/ পশমে আলোর বন্যা চিত্রা নক্ষত্রের/ সভ্যতা জানো কতো দূর সময়ে? হঠাৎ গর্জন/কোথাও আগ্নেয়গিরি ফাটে/ধেয়ে আসে আগুন লক্ষ্যচ্যুত/সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়/বল্লমে রোখা যায় বাঘ বা বিদ্রোহ/আগুন হারে না। (আগুন)

আমরা যাইনি মরে আজো- তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়:/ মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোস্নার প্রান্তরে;/ প্রস্তর যুগের সব ঘোড়া যেন- এখন ঘাসের লোভে চরে/ পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর পরে।’ জীবনানন্দ দাশের প্রস্তর যুগের সঙ্গে শোয়েব শাদাবের অশেষ প্রস্তরযুগ তথা ঘোড়া ও সিংহের শব্দগত অর্থগত মিল কখনো কখনো প্রকট হলেও জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কাব্যে শোয়েবই যে তেজাব তীব্র আত্ম বিধ্বংসী তা সয়ম্ভূ হয় শাদাবের নির্মাণ প্রকৌশলসহ আত্ম স্বাতন্ত্র্যবোধে, ছায়া থেকে ছায়া পৃথক করার অসাধারণত্বে। হেগেল যখন রসোপলব্ধিকে পরাবিদ্যার প্রাথমিক ও অধস্তন স্তর বলতে দ্বিধান্বিত হননি, শাদাবের কবিতায় পৌরাণিক আলো –অন্ধকারের অস্তিত্বে হেগেলের দ্বিধার স্তর নিয়ে কিঞ্চিত সন্ধিহান হই এবং রস ও রসবোধের দৃষ্টিভঙ্গিও যেন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়। নিজকে বিলিয়ে দিয়ে পুনরায় খুঁজে পাওয়ার বিস্ময়ের মধ্য দিয়ে শাদাবের রচনায় ইয়েটস এর কথার সত্যতা খুঁজে পাই। We begin to live only when we have conceived life as tragedy. শাদাবের মাইক্রোসকপিক অন্তদৃষ্টি Unconventional spark of brilliance এবং সর্বোপরি সেন্স এন্ড সিম্পলিসিটি ভয়ঙ্কর রকম মর্মস্পর্শী। ‘‘শ্রাবণ বৃষ্টিতে ভিজে গেলে পথ ফিড্রার মৃত চোখ স্মৃতিতে ভাসে কবর থেকে জাগা দুটি কবুতর। উল্লেখিত তিনটি চরণ নিয়ে উপমা এবং তুলনার যোগসূত্রসহ জ্যাকবসনের ল্যাঙ্গুয়েজ ডিসঅর্ডার, ভাষায় নিহিত দুটি বৈশিষ্ট্য- সিলেকশন এন্ড কম্বিনেশন ইত্যাদি বিষয়ে অনুপূঙ্খ আলোচনার সুযোগ যদি শুধু ইঙ্গিতের ভেতরই দাফনা দিয়ে যাই তবু বলতে দ্বিধান্বিত নই- শোয়েব শাদাব একজন্মে যা কিছু পাঠ করেছেন তা তিনি ধারণ করেছেন, অনুকরণের বদলে আত্মস্থ করেছেন এবং সত্তাজুড়ে মানুষীয়ানার গভীর সংরাগ কখনোই যেন অনুজ্জ্বল নয়, অত্যুজ্জ্বল এবং অনুভূতিগুলো সৎ ও হৃদয়সংবেদী বিধায় কবিতায় শব্দ বাক্যের বাহাদুরির বদলে দৃশ্যমান হয়- প্রচণ্ডরকম অন্তর্মূখীনত্ ানিয়ে ভাবের জৌলুস, প্রতিদিন জন্মের সঙ্গে মৃত্যু সূত্রগুলি এককার হয়ে যাওয়ার সূক্ষèানুভূতি। আমরা কি বলতে পারি- শিল্পমূল্যের কাছে জীবনের মূল্য তুচ্ছ করে দিতে সবাই জানে না, শোয়েব শাদাব জানেন ।

আশির দশকের আরেক শক্তিশালী কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ারের মুখে বহুবার শ্র“ত হয়েছি শাদাবের নাম। তারা পরস্পর বন্ধু ছিলেন। উভয়ের কবিতার বহিরাঙ্গের সঙ্গে অন্তর-অঙ্গেরও মিল পাওয়া যায় কোথাও কোথাও । কিশওয়ারের কবিতার প্রায় প্রতি ছত্রেই রয়েছে সত্ত্বা, অস্তিত্ব, ঈশ্বর, আল্লাহ নিয়ে বিবিধ জিজ্ঞাসা। অকাল প্রয়াত কিশওয়ার মৃত্যুর ক’বছর আগ থেকেই হামদ, না’তও লিখেছেন। শাদাবের কয়েকটি কবিতায় আধিবিদ্যাকেন্দ্রিক উপকরণ দৃশ্যমান।
‘কর্ম তোমার সঙ্গে যাবে/ আধহাত সূর্যের উত্তাপে গলে যাবে মাথার মগজ।/প্রকৃতির সমস্ত কলতান থেমে যাবে অদৃশ্য ইঙ্গিতে/ আনত গোলাম যেভাবে দাঁড়ায় সেভাবেই দাঁড়াবে তুমি স্রষ্টার সম্মুখে। (কবিতা ১৯৯১)‘ ‘নফসের নিগড়ে বন্দি আত্মা/দেখবে না স্রষ্টার মূর্তি/প্রকৃত শিল্পের সমূহ কীর্তি/(শিরোনামহীন)
শোয়েব শাদাবের কবিতা মাথার উপর দিয়ে চলে যায়- এ রকম অভিযোগও বন্ধুদের কাছ থেকে শ্র“ত হয়েছি কবিতা বিষয়ক আলাপচারিতায়। অনুযোগের সূত্র ধরেই বলা যায়- শাদাবের অনেক কবিতা মাথার উপর দিয়ে যায় না বলেই তা ঋজু কিছুটা দুর্বলও বটে। বোধ করি মাথার উপর দিয়ে গেলেই অনন্ত দশকের কবি হিসেবে তাঁর অবস্থান আরও দৃঢ়মূল হতো। উদাহরণ দেয়া যাক- তোমার মৃত্যু আছে নিশ্চিত পাথরে/কিংবা সে ভয়াল আগ্নেয়গিরি ঘুমন্ত এখন/তার জেগে ওঠা বিপুল অগ্নুৎপাতে(শিরোনামহীন)‘পাখির ডাকে নক্ষত্রের মিল থাকে/সমুদ্র যখন হারিয়ে ফেলে নীল সৌন্দর্য/নক্ষত্রের রূপ তার তৃষ্ণা মেটায়
চরণগুলোতে শুধু কার্যকারণই উপস্থিত নয়, আগ্নেয়গিরির পূর্বে ভয়াল, সৌন্দর্যের পূর্বে নীল, রোদের পূর্বে রূপালী বিশেষণগুলো মেদ মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শোয়েব যেন চোখে আঙুল দিয়ে চোখের ভেতরে বসে দৃশ্যাতীত বিষয়গুলোকে দৃশ্যমান করেন। সৃষ্টির ডাক দিয়ে চলে গেলো উড্ডীন আগুনের চিতা/ তার চাইয়ে আমি পড়ি ঢাকা /এ রকম উপসংহার সম্বলিত চরণ কী করে আয়ত্তাতীত। যেহেতু তিনি নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের কৃতদাস কবিও নন, তাঁর কবিতা অব্যহৃতরূপে সার্বজনীন হবে এ রকম প্রত্যাশা করা অনুচিত । তবে আত্মচৈতন্যের প্রসার ও ঘণীভবনের জন্য শোয়েব শাদাব পাঠ করা এবং পুনঃপাঠ করা জরুরি- এ কথার সঙ্গে কাব্য-কৈবল্যবাদীদের মতানৈক্যের বিশেষ কোনো কারণ আপাতত দেখছি না। এখন বরং আমাদের ত্রিশাল যাত্রা আরো কয়েক লক্ষ বর্গমাইল দীর্ঘ হতে পারে। পথিমধ্যে বাতাসের গর্তগুলো হা করে তাকিয়ে থাকবে এবং নারীসূর্য ভেদ করে করে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে আমরা যখন ত্রিশাল পৌঁছাবো, হয়তো দৃশ্যমান হবে শোয়েব শাদাবসহ সৌরচুল্লি হতে বেরিয়ে আসা কবি ও মোমের আকৃতি; হয়তো জেনে যাবো - সকল কবি এক মানবজন্মে নিজের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না, শোয়েব শাদাব তো মাতৃজরায়ন থেকেই আপন কঙ্কালের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।





সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১:৫২
৯টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×