১
পাশ করে কোথাও যখন কোন চাকুরী হচ্ছিল না তখন বোন জামাই্-ই প্রস্তাব দিলেন তার ঠিকাদারী ব্যবসায় যোগ দিতে। রাসেলের স্বপ্ন ছিল সরকারী চাকুরী করবে। আর তা না পেলে অন্তঃত বেসরকারী কোন প্রতিষ্টানে। ব্যবসার কথা সে কোনদিনও চিন্তা করেনি। অথচ তাকে শেষ পর্যন্ত ব্যবসায় যোগ দিতে হলো। তাও আবার বোন জামাইয়ের ঠিকাদারী ব্যবসায়। এজন্যই বলে মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।
কিছুদিনের মধ্যেই রাসেল দেখে তার দুলাভাই এ লাইনে অনেক কামেল লোক। তার নীতি হলো প্রথমে কৌশল অবলম্বন কর, দেখ কাজ হয় কি না; না হলে বল প্রয়োগ। আর তাতেও না হলে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দাও। প্রথম প্রথম এসব দেখে রাসেলের ভয় হতো। খারাপ লাগত। একসময় অবশ্য সব গা সয়া হয়ে যায়। অনুভূতিগুলো ভোতা হতে যতক্ষণ সময় লাগে আর কি।
২
কোন এক ভর দুপুরে বাসা থেকে খাবার খেয়ে বের হওয়ার সময় রাসেলের দুলাভাইয়ের উপর হামলা হয়। হামলাকারীরা নিশ্চিত করে যাতে তাকে আর হাসপাতালে নিতে না হয়। বিভিন্ন পত্রিকা আর চ্যানলের সাংবাদিকার আসেন। সাংবাদিকদের দেখে মনে হয় তারা বেশ খুশী হয়েছেন। একজন নামকরা ব্যবসায়ীর রক্তে ভেজা শরীরের ছবি আর খবরে আগামী কয়েকদিন পত্রিকা আর চ্যানেল গরম থাকবে হয়তো এই ভাবনায়। পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা আসেন। সাথে আসেন রাসেলের দুলাভাইয়ের ঘনিষ্ট কয়েকজন ব্যবসায়ী। তারা রাসেল, তার বোন এবং চার বছরের ভাগ্নী রায়না কে আশ্বাস দেন..খুনি যেই হোক, তাকে ধরা পড়তেই হবে। ফাসীর কাষ্টে না ঝুলিয়ে তাকে তারা ছাড়বেন না।
ঘঠনার কয়েকদিন পর্যন্ত পুলিশ এবং ডিবির লোকজন নিয়মিত আসা যাওয়া করত। আশে পাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করত। যদিও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছিল না, মাঝখান থেকে পাড়া প্রতিবেশীরা রাসেলদের উপর বিরক্ত হচ্ছিল। একসময় অবশ্য সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসে। শুধু স্বাভাবিক হতে পারে না রায়না। এখনো সে খাবার টেবিলে বাবার জন্য অপেক্ষা করে। এখনো মায়ের বকুনি খেয়ে মুখ লুকিয়ে কাঁদে আর অপেক্ষা করে কখন বাবা আসবে, মায়ের নামে নালিশ করবে। কখনো কখনো ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে মাঝ রাতে চিৎকার করে উঠে, অজ্ঞান হয়ে যায়। রায়নার কথা ভেবে রাসেলের খুব খারাপ লাগে। কষ্ট হয়। আবার মাঝে মাঝে মনে হয় রায়না কি তার বাবার কর্মফল ভোগ করছে?
৩
ব্যবসার পুরো দায়িত্ব রাসেলের হাতে আসার পর সিদ্বান্ত নেয়, সে আর যাই করুক খুন খারাবীতে জড়াবে না। বরং আরো কৌশলী হবে। কিন্তু কিছুদিন পর সে টের পায় এই লাইনে কাজ করা অত সহজ না। পুলিশ থেকে শুরু করে স্হানীয় মাস্তান, নেতা, পাতি নেতা, সাংসদ এমনকি মন্ত্রী পর্যন্ত খাওয়াতে হয়। খাওয়ানোর এই লম্বা শেকল দেখে সে কিছুটা হতাশ হয়। অনেকে আবার খাওয়ার পরও বেইমানি করে।
রাসেলের দুলাভাই মারা যাবার আগে 'রোডস এন্ড হাইওয়েস' এর একটা কাজ পেয়েছিলেন। প্রায় এগারোশে কোটি টাকার কাজ। কাজটা উনি শুরুও করে দিয়েছিলেন। প্রাথমিক কাজ হওয়ার পর ইন্সপেকশন হয়। ইন্সপেক্টর সাহেব কে যথাসাধ্য খাওয়ানো হয়েছে। উনি খুশী মনে ভালই রিপোর্ট দিয়েছেন। তারপরও প্রাথমিক কাজের বিল আটকে আছে। মন্ত্রী সাহেব না কি স্বাক্ষর করছেন না। উনি রাসেল কে একটা বিশেষ জায়গায় তার সাথে দেখা করার কথা বলেছেন।
৪
স্যার, এটা আমার পক্ষ দেয়া অসম্ভব। আপনি আমাকে আরেকটু বিবেচনা করুন, রাসেলের করুন আর্তি মন্ত্রী সাহেবের কাছে।
এগারোশোর মাঝে চাইছি মাত্র চারশো কোটি। তারপরও তুমি আমারে বিবেচনা করতে কও? তোমার তো মিয়া দেখি ইনসাফ নাই। খালি একলা খাইতে চাও।
স্যার, অনেক জায়গায় দিতে হয়। সব জায়গায় দিয়ে যে টাকা থাকবে সেটা দিয়েতো কোন কাজই করতে পারব না।
তো..তুমারে কাজ করতে কইছে কেডায়। মন্ত্রী সাহেব ধামকি দিয়ে বলেন। মন্ত্রী সাহেব বয়সে নবীন, স্বাস্হ্যটাও বেশ ভাল। উনার ধামকিতেও বেশ জোর আছে।
কি বলেন স্যার! এখন জনগণ অনেক সচেতন। কাজ না করলে পরের ইলেকশনে তো জনগণ আপনাদের ধরবে।
ধরবে মানে?
ভোট দেবে না।
দুর মিয়া...পাবলিক কি আর রাস্তাঘাট দেখে ভোট দেয় না কি? তারা দেখে মার্কা। পাবলিকরে নিয়া আমি তাই টেনশন করি না। আমার টেনশন হইল গিয়া নমিনেশন। এজন্য তুমাদের কাছ থেকে যা নেই, তার বড় একটা অংশ পার্টি ফান্ডে দিয়া দেই।
স্যার..তারপরও আমাদের কথাটা একটু বিবেচনা করেন। তা না হলে তো এই লাইনে ঠিকতে পারব না।
মন্ত্রী সাহেব কোন কিছু চিন্তা না করেই বলেন, কাজটা কয় মাসে করতে হবে?
এক বছরে।
এক কাজ কর..তুমি এটাকে টেনে টেনে তিন বছরে নিয়া যাও। প্রজেক্ট কস্ট কিভাবে বাড়াতে হয় সেটা আমি দেখছি। ঠিকাছে?
এই না হলে মন্ত্রী। মন্ত্রীর বুদ্বি দেখে রাসেল অবাক হয়। পার্টিতে এত ভাল ভাল অভিজ্ঞ নেতা থাকা স্বত্তেও এসব লোক কে মন্ত্রী করা হয় কেন রাসেলের কাছে তা পরিষ্কার হলো।
মন্ত্রীর প্রস্তাবে রাসেল মনে মনে বেশ খুশী হয়। তবে বাইরে সেটা প্রকাশ করে না। শুধু বলে, আপনি যা বলবেন স্যার, সেটা কি আর আমি না করতে পারি?
মন্ত্রী হেসে বলেন, এতক্ষনতো মিয়া না না ই করতেছিলা। যাইহোক আমার টাকাটা জায়গামতো পৌছে দিও।
মন্ত্রীর হাসি দেখে রাসেল কিছুটা সাহস পায়। সে সাহস করে বলেই ফেলে..স্যার, আপনি রাজনীতি না করে ব্যবসা করলেই ভাল করতেন।
তাই? তাহলে রাজনীতি থেকে ভাল কোন ব্যবসা থাকলে তার নাম বল। আমি সেটাই করব। মন্ত্রী সাহেবের তড়িৎ জবাব।
মন্ত্রীর সাথে দেখা করে গভীর রাতে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রচন্ড শীতেও রাস্তায় নগ্ন প্রায় মানুষজন দেখে রাসেলের মনে হয়, মন্ত্রী সাহেব ঠিকই বলেছেন, রাজনীতির চেয়ে ভাল ব্যবসা কি আর হতে পারে। অন্তঃত যতদিন এই সব গরীব লোক কে কেনাবেচা করা যাবে।