somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রেহাম খান

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



রেহাম খানের আত্মজীবনী ‘রেহাম খান।’ প্রকাশিত হয়েছে গত জুলাইয়ে, লন্ডন থেকে। পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ নাগরিক তার আত্মজীবনীতে তার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সমাজ সম্পর্কে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। প্রকাশের পর থেকেই বইটির পক্ষে-বিপক্ষে অনেক কথা উঠছে।

১৯৮৫’র গ্রীষ্মকালটা ছিলো স্মরণীয়। বারো বছর বয়সী মেয়েটা শেষ পর্যন্ত নিজের রুম পেলো। যে স্বাধীনতার জন্য সে দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিলো, এতে কেবল সেই স্বাধীনতার স্বীকৃতিই মিললো না, বরং অভিনয়ের জন্য আমার যে প্রবল আগ্রহ ছিলো, শেষ পর্যন্ত সেটারও দরজা খুলে গেলো। আমি বাচ্চাদের একটা শোতে চান্স পেয়ে গেলাম।
এর বছরখানেক আগে দেশের একমাত্র টেলিভিশন নেটওয়ার্ক পিটিভি’র একজন মহিলা প্রযোজক আমাকে আবিষ্কার করেন একটা মঞ্চ নাটকে অভিনয়রত অবস্থায়। পেশোয়ার ক্লাবে প্রদর্শিত সে নাটকের প্রযোজক ছিলেন আমার মা। নাটকটার উদ্দেশ্য ছিলো সেনা বাহিনীর জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। প্রযোজক বুশরা রফিক আমার অভিনয়ে এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে, তিনি আমাকে খুঁজে বের করে জানতে চাইলেন নতুন একটা পাপেট শো’র অডিশনে আমি অংশ নেবো কি না। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তিনি এটা শুরু করতে যাচ্ছিলেন। এর আগে তিনি প্রতিভাবান কমেডিয়ান এবং পাপেটার ফারুক কায়সারের সাথে কাজ করেছিলেন। বাচ্চাদের প্রোগ্রামের জন্য তাদের একজন উপস্থাপকের দরকার ছিলো।
বুশরা আমাকে সম্পূর্ণ মেকাপ নিয়ে নাটকের মূল ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখেছিলেন। অভিনয় করেছিলাম বল গাউন পরে। কিন্তু ফ্রক পরে বেণী দোলাতে দোলাতে যখন তার সামনে এলাম, তিনি অবাক হয়ে গেলেন। তাদের একজন তরুণীর দরকার ছিলো, বাচ্চা শিশু নয়। আবার আমার মধ্যে মেয়েলী ভাবও ছিলো না। আমার আদর্শ ছিলো আমার বড় ভাই। সে আমাকে বেশ স্নেহ করতো। তাকে আদর্শ মানার কারণে সম্ভবত আমার চেহারায় ওয়ার পেইন্ট দেখা যেতো। এভাবে পুতুল খেলা কিংবা মেকাপ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বদলে আমি খাঁটি আমেরিকান সেজে সেখানকার পশ্চিমা বনাঞ্চলে কল্পযুদ্ধ চালানোর চেষ্টা করতাম। তবুও তিনি বাচ্চাদের একটা গল্পের বই থেকে একটা অংশ আমাকে পড়তে দিলেন। আমি আমার নিজের মতো সেটা পড়লাম। লোকজন বলে যে, আমি যখন কোনো গল্প বলি, তখন শুধু গল্পের চরিত্রগুলোর কণ্ঠই নিয়ে আসি না, বরং পূর্ণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করি এবং তাতে ডুবে যাই। মেধার ব্যবহারের বিষয়টা যখন এলো, বুশরা খুব সৃজনশীলতার পরিচয় দিলেন। তিনি আমাকে উপস্থাপক পদটা পাইয়ে দিতে টেলিভিশনের বসদের সাথে লড়াই করলেন।
আমি যখন সেটে এলাম, আমাকে নিজের পোশাকের উপরে পরার জন্য একটা দোপাট্টা দেয়া হলো। এরপর আমাকে মেকাপে পিণ্ডীভূত করা হলো। আমার বয়স তখন বারো। কিন্তু দেখে অনেক পরিপক্ব মনে হচ্ছিলো। আশোলে ৪৪-এ এসে আমাকে যে রকম দেখাচ্ছে, বারোতে তার চেয়ে খুব একটা ভিন্ন মনে হয়নি। কিন্তু শরীরে চর্বি জমে যাওয়াতে সেই কোমলতা তো অবশ্যই হারিয়েছি। মেকাপ (বিশেষ করে চোখের মেকাপ) অপছন্দ করতাম বলে মেকাপ শিল্পীদের কাছে আমি ছিলাম দুঃস্বপ্নের মতো। পিটিভি’র উর্দু স্ক্রিপ্টরাইটারদের কাছেও আমি একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিলাম। কারণ আমি উর্দু ভালো করে পড়তে পারতাম না, বড় শব্দগুলো ভুল শুনাতো। সে জন্য আমাকে আবৃত্তির মতো উচ্চারণ করতে হতো। টেলিভিশনে এ উর্দু যায় না। আমার উর্দু ছিলো সমসাময়িক এবং ইংরেজির মতো। কিন্তু দর্শকরা এটা পছন্দ করতো। আমার ডায়ালগ সে সময় বিখ্যাত হওয়ার কারণ ছিলো সেটে আমার উচ্ছলতা। প্রথম দিন প্রধান পাপেটিয়ার (আমাকে সতর্ক রাখতে) আমার ডাকনাম গেয়ে উঠলেন।
‘মিস রিইইইইইইইইইইইইইমা!’
আমি মুচকি হেসে সাথে সাথে গানের সুরে জবাব দিলাম, ‘জিইইইইইইইই হাঁ।’ কেবল একটা সকৌতুক হ্যাঁবোধক সাড়া; সাধারণ টানে বলা একটা শব্দ এবং সুরের সাথে বলে ওঠা ‘হ্যাঁ।’ কিন্তু এটাই খুব অল্প সময়ে দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে গেলো। এবং জনপ্রিয় ডায়লগ হয়ে উঠলো।
একটা অস্থির বাচ্চার জন্য লম্বা কথা এবং লম্বা রেকর্ডিং সহজ বিষয় ছিলো না। কিন্তু সিনিয়ররা আমাকে প্রমাদ আর বিস্কুটের স্রোতে ব্যস্ত রাখতেন। এই রেওয়াজ এখনো চালু আছে। আপনি যদি মিস খানকে প্রাণোচ্ছল রাখতে চান, বিস্কুট আনতে থাকুন!
পিটিভিতে বড়দের মধ্যে যাদের সাথে আমি কাজ করতাম তাদের সাথে ইতিবাচক এবং নিরাপদ বিবাদে জড়াতাম। আমি আবিষ্কার করলাম, প্রযোজকদের মধ্যে মরহুম ফারুখ বাশির সাহাব এতটাই পিতৃসুলভ ছিলেন যে, তিনি আমার ভক্তদের কাছ থেকে আসা সব চিঠি আমার কাছ থেকে দূরে রাখতেন। কারণ এগুলোর বেশির ভাগই ছেলেদের কাছ থেকে আসতো। স্টুডিওর এক প্রান্তে বসে আমার মা আমাদের কার্যকলাপের উপরে বাজপাখির দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতেন। পুরো গ্রীষ্মকাল তিনি আমার সাথে কাটাতেন। আমি অনেক পরে এর মূল্য বুঝেছি এবং এর জন্য তাকে কৃতিত্ব দিয়েছি। তবুও খুবই অধ্যবসায়ী এবং অতিমাত্রায় সাবধান একজন মা হওয়ার পরও তিনি জানতেন না যে, আমরা আমাদের বাচ্চাদের ব্যাপারে যে ঝুঁকির কথা চিন্তা করি তার চেয়ে তারা অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকে। তিনি হয়তো অনুভব করতেন মিডিয়া শিকারীতে ভরপুর। সে কারণেই তিনি টিভি স্টুডিওতে সদা সতর্ক থাকতেন। কিন্তু আশোল কথা হলো কুটিল লোকেরা সব রকমের ছদ্মবেশে আসে।
পাকিস্তানে বাচ্চারা প্রায়ই বাড়ির সহায়তায় যৌন হেনস্থার শিকার হয়। এখনো পর্যন্ত বিষয়টা অসতর্ক অথবা মর্যাদা সচেতন মা-বাবা এড়িয়ে যায়। আপনার বাচ্চার জন্য একজন কাজের লোক রাখা প্রেস্টিজের প্রতীক। একটু সচেতন মা-বাবাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়তো তার বড় সন্তানকে দায়িত্ব দেন ছোটটার উপরে নজর রাখার জন্য। তারা শুধু বিশাল দুর্ঘটনার ব্যাপারে নয়, বরং সেই ছোটদের হাতে যৌন হেনস্থার শিকার হওয়ার কোনো ধারণাও রাখেন না। আমরা যখন বেড়ে উঠি, তখন পিডোফিলিয়া বা শিশু যৌন নিগ্রহের ধারণাটা ছিলো না। আমাদের মা-বাবারা চান আমাদের মন যাতে দূষণের শিকার না হয়। সে জন্য কি না আমরা বাচ্চারা যে বিপদের সম্মুখীন হতে পারি তা থেকে আমাদের তারা প্রায়ই আমাদেরকে অরক্ষিত রাখেন।
আমার মা সব সময় আমার অভিনয় দক্ষতায় উৎসাহ যোগাতেন। আর আমি যেহেতু একজন আগ্রহী গায়িকা ছিলাম, তিনি আমাকে পেশোয়ারের প্রতিষ্ঠিত আব্বাসিন আর্টস কাউন্সিলে সংগীত প্রশিক্ষণের জন্য পাঠালেন। এখানে একটা হলের মধ্যে আরো অনেক শিশু আর কিছু সংগীতজ্ঞের সাথে সম্মিলিত চর্চা করতে হতো। সব দিক থেকে এটাকে নিরাপদ কর্ম বিবেচনা করা যেতো। সন্দেহমুক্ত, ভাবনাহীন নয় বছর বয়সী বাচ্চারা, নৈপুণ্যে প্রদর্শনে আত্মবিশ্বাসী। চিল্ড্রেন’স অ্যাকাডেমির সভাপতির মেয়েকে আমাদের বস আবার প্রাধান্য দিতেন। সবাই তাকে সম্মান করতো। সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন শিক্ষিত পেশাদার। বড়দের প্রতি ব্যাপক শিষ্টাচারের শিক্ষা নিয়ে আমি বেড়ে উঠি। আজকাল এই শিষ্টাচার একটা বোঝা। কারণ যে সব লোক আমাকে বিরক্ত করতে করতে মেরে ফেলে তাদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়াটা দেখি কঠিন। মিটিং সংক্ষিপ্ত করা দেখি কঠিন। কিন্তু আমাদের বাচ্চাদেরকে অবশ্যই দিতে হবে—যদি তারা অস্বস্তিতে পড়ে যায়, তখন আর বিনয় দেখানোর দরকার নেই।
এই ‘চাচা’র একটা দিক আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতো। কিন্তু আমি পুরোপুরি বুঝতে পারতাম না সেটা কী। তার ওফিশে তিনি বিস্কুটের অফার দিতেন। সেটা সফলভাবে এড়িয়ে যাওয়ার পর আমি আবিষ্কার করলাম কেন আমি তাকে সে দিন পছন্দ করিনি। দিনটা ইকবাল দিবস নামে পরিচিত ছিলো। সে দিন পেশোয়ারের পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলে আমাদের দলটা তাদের সংগীত নৈপুণ্য প্রদর্শন করছিলো। সাহিত্য বোদ্ধায় হল ছিলো ভর্তি। আমরা সবাই পারফরমেন্সের জন্য গ্রাউন্ড ফ্লোরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ‘আংকেল’ আমাকে নেয়ার জন্য সেখানে এলেন। তিনি আমাকে বললেন তিনি আমাকে উপরে নিয়ে যেতে চান। কারণ অনুষ্ঠান একটু দেরি হবে। তিনি আমাকে একটা চকোলেট বার দিলেন। টাকলু, বয়স্ক আমলার কাছ থেকে আমি চকোলেটটা নিয়ে লিফট পর্যন্ত তার সাথে হেঁটে চললাম। নয় বছর বয়সী একটা মেয়ের কাছে মুক্তি পাওয়ার পরিকল্পনা করার জন্য এটুকু পথের সময়টা ছিলো খুব সংক্ষিপ্ত। লিফটে পা দেয়ার পর আমার অস্বস্তি বোধ বাড়তে শুরু করলো। দরজা বন্ধ হওয়ার পর তিনি বললেন, ‘আমি তোমাকে এত ভালোবাসার কারণ কী বলে তোমার মনে হয়?’
আমি জবাব দিলাম, ‘হয়তো আপনার নিজের কোনো সন্তান নেই বলে।’
তিনি বললেন, ‘কেন, বুদ্ধিমতী খুকী?’
পরের ত্রিশ সেকেন্ডের কথা আমি মন থেকে কোনো দিনও মুছতে পারবো না।
তিনি বাঁকা হলেন। আমি টের পেলাম তার মুখ আমার ঠোঁটে। এটা ভাবলে আমার চামড়ায় আজো শিরশিরে অনুভূতি হয়। এটা এমন এক ভয়াবহ অনুভূতি ছিলো যে, দৃশ্যটা মনে এলেও মাথা থেকে সরিয়ে দিতে হয়। সেই গা ছমছম করে দেয়া লোকটার ছবি, টাক মাথার পিছনে সেই আফ্রিকান স্টাইলের কোঁকড়ানো চুলওয়ালা লোকটার ছবি আমার স্মৃতিতে খোদাই হয়ে আছে। মা-বাবা এবং বাচ্চাদেরকে আমাদের বলা দরকার যে, শিশু যৌন নিগ্রহকারীরা স্যুট পরেও আসে।
আমার সৌভাগ্য ছিলো যে, লিফটটা দ্বিতীয় তলায় থেমে গেলো। সামান্য সময়ের এই সম্ভ্রমহানি আমাকে বছরের পর বছর ধরে পীড়া দিয়েছে। আমি মঞ্চে পারফর্ম করার জন্য চলে গেলাম, সেখান থেকে এক কদমও বের হলাম না। কিন্তু আমি আমার সংগীত শিক্ষা আজীবনের জন্য ছেড়ে দিলাম। কী ঘটেছে তা আমি বুঝতে পারিনি। আমি এর নাম জানি না। কিন্তু আমি জানতাম যে, এটা একটা বড় অন্যায় এবং এটা থেকে, তার হাত থেকে আমার নিজেকে রক্ষা করা উচিত ছিলো। এটা নিয়ে আমি বড়দের কারো সাথে কথা বলতে পারিনি। এ ঘটনার লজ্জা এত বেশি ছিলো যে, তা পাপ স্বীকারের জন্য যথেষ্ট ছিলো না। আমার কপাল ভালো ছিলো যে, আমি ইচ্ছামতো পলায়ন করতে পেরেছিলাম, কঠিন হতে পেরেছিলাম। কিন্তু অনেক বাচ্চারই এ সুযোগটা থাকে না। তারা তাদের মা-বাবার কঠোরতার কারণে গণিত অথবা ধর্ম শিক্ষা এড়াতে পারে না। তাদের কি কথা বলার মতো আর কেউ আছে?
বড় হয়ে আমি এটা নিয়ে সক্রিয়ভাবে, যে উপায়েই হোক প্রচারণা চালালাম। শিশুদেরকে রক্ষা করার এই প্রচ- ইচ্ছার শিকড় ছিলো অন্য একটা পরিবর্তনের মধ্যে। ১৯৮৫’র গ্রীষ্মে আমি আমার চরিত্রের আরেকটা বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করলাম : বাচ্চাদেরকে আমি কতটা ভালোবাসি। আমার প্রথম বাচ্চা ছিলো আমার প্রথম ভাগ্নে। তার নাম আবু বকর খান। সে আগস্টে জন্ম নেয়। তার কারণে আমি মাতৃত্বের সুযোগ পেয়ে গেলাম। মনে হলো আমার কাছে প্রাকৃতিকভাবে সন্তান লালন-পালনের বিষয়টা চলে এলো। খবরটা যখন আসে, তখন আমরা বাড়িতে অপেক্ষা করছি। আমরা যখন হাসপাতালে পৌঁছলাম, দেখলাম আমার বোনজামাই খালিদ ভাই হাসপাতালের সিঁড়িতে বসা। মনে হলো লম্বা মানুষটা সংকুচিত হয়ে আছে। আমি তার কাঁধে হাত রেখে নির্ভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম। টের পেলাম তিনি ভয়ে কম্পিত। আমরা সিঁড়ি বেয়ে উপরের তলায় গেলাম। ডাক্তার আবু বকরকে দেখিয়ে দিলেন। বাচ্চাটার মাথা চার কোনা আকৃতির। সে উচ্চরোলে তার বুড়ো আঙ্গুল চুষছিলো। আমি তৎক্ষণাৎ তাকে কোলে নিলাম।
ব্যাপারটা আমার কাছে না ছিলো কঠিন না ছিলো ভীতিকর। তার নখ কাটা থেকে শুরু করে ওষুধ খাওয়ানো পর্যন্ত সব যত্ন আমি নিতাম। বছরের পর বছর আবু বকর আর আমি ছিলাম অবিচ্ছেদ্য। আমার একটা ছোট ভাইয়ের যে আকুল কামনা ছিলো, সে জায়গাটা সে পূরণ করলো। তাকে লালন-পালন করতে গিয়ে আমি যে শুধু একক অভিভাবকত্বের জন্য প্রস্তুত হলাম শুধু তা-ই নয়, বরং অল্প বয়সেই আমার মাতৃত্বের পরিচয় জোরদার হলো। আমার সাতজন ভাগ্নে-ভাগ্নীর প্রত্যেকের কাছেই আমি প্রিয়। আমরা একসাথে ঘুরতে বের হতাম। যখন সফর শেষ হতো, সত্যি সত্যিই মর্মবেদনাপীড়িত একজন খালার ভূমিকা নিয়ে ফিরতাম।
লোকজন আমাকে প্রায়ই উচ্চাভিলাষী হিশাবে বর্ণনা করে। কিন্তু আমার শিক্ষকরা সব সময় আমাকে বলেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আমার জীবনের উদ্দেশ্য ছিলো কখনো কাউকে পরাজিত না করা। কে প্রথম হলো সেটা নিয়ে আমি কখনো মাথা ঘামাইনি। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো আমি নিজের জন্য যে লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেছি সেটা অর্জন করা এবং একজন ব্যক্তি হিশাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া। নম্বরের দিকে আমার কখনো নজর ছিলো না। আমি সব সময় বেশি গুরুত্ব দিতাম বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার উপরে। সব কিছু জানা ছিলো আমার প্রণোদনা। অন্য মেয়েদের মতো আমি কখনো সিনিয়রদের খাতা অথবা আগে থেকে তৈরি করা উত্তর পড়তাম না। আমি যা পড়ছি সেটা বুঝতাম। আমি শিখতে চাইতাম।
বস্তুগত সাফল্যের পিছনে দৌড় মানুষকে রিক্ত এবং অসুখী বানিয়ে দেয়। হীরার যে আংটিটা আপনাকে পরতেই হবে সেটা আপনার বন্ধুর সাথে আপনার কেবল দূরত্বই তৈরি করবে এবং আপনার বন্ধু কখনো আপনাকে উষ্ণ আলিঙ্গন করবে না। খেলোয়াড়দের মতো মেডেল জেতা এবং ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়ার কোনো দাম আমার কাছে ছিলো না। আমি জিততে চেয়েছি সত্যিকার সম্মান এবং ভালোবাসা। আমি আমার চারদিকে গুটিকয় লোক চেয়েছি, যাদের সাথে কয়েক কাপ কফি আর কেক নিয়ে হাসিতে মেতে উঠতে পারবো। তোষামোদকারীদের কাছ থেকে দূরে থাকুন। তারা বিরক্তি উৎপাদন করবে, আপনাকে কখনো ভালো পরামর্শ দেবে না। ক্ষমতালোভী, আত্মপ্রচারকারী লোকদের চারদিকে থাকে তাদের চেয়েও লোভী অনুচর। আর এরা জাহাজ ডোবার আলামত দেখা মাত্রই লাফ দেয়। আমরা মা-বাবা এবং সমাজের অবস্থান থেকে অর্জনের উপরে খুব বেশি জোর দিই। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে শিখাই : ভালোবাসা শর্তনির্ভর। ‘আমাকে একটা ট্রফি এনে দাও, তোমাকে আরো বেশি ভালোবাসবো।’ আমার মাকে এ সব মা-বাবার কাতারে ফেলা যায়। তিনি চাইতেন আমরা মেডেল নিয়ে আসি। কিন্তু ভালো হওয়া এবং সুখী হওয়ার বাইরে আর কিছু না চাওয়া ছিলো আমার বাবার শান্ত প্রভাব। এটা তার বস্তুগত প্রত্যাশার লম্বাকে তালিকা দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে।
টিভিতে তিন মাসের সামান্য পারদর্শিতায় আমি ষষ্ঠ পিটিভি অ্যাওয়ার্ডে সেরা শিশু তারকা হিশাবে নির্বাচিত হই। অ্যাওয়ার্ডটা চলে গেলো তিন বছর বয়সী এক শিল্পীর কাছে। সে ছিলো বিখ্যাত টিভি তারকা লায়লা জুবেরির মেয়ে। আমি যেহেতু মিডিয়া পরিবার থেকে আসিনি, যে সব তারকাকে আমরা দূর থেকে দেখি তাদের সংস্পর্শে আসাটা ছিলো দারুণ আনন্দের। আমি যখন চোখ বড় করে আবেদনময়ী সেলিব্রিটিদেরকে দেখতে থাকতাম, আমার মা নজর দিতেন পুরস্কারের দিকে। ফলাফল ঘোষিত হলে আমি কখনো তার ক্রোধ বা হতাশা বুঝতে পারতাম না। মনে মনে অবশ্যই আমি পুরস্কারের আশা করতাম, তবে না জিতলেও খুব একটা প্রভাব পড়তো না। মূলত আমি জীবনের জন্য একটা শিক্ষা পেয়েছিলাম : কখনো কখনো আমরা সত্যিই আমাদের প্রিয় কিছু জিনিশ বা ফলাফল চাইবো। কিন্তু যদি সেগুলো না আসে এবং সেগুলো আসবে না, সময় চলে যাবে, আমরা প্রায় সব সময় পিছন ফিরে সেগুলোর দিকে চাইবো আর আমরা কতটা উত্তেজিত হয়েছিলাম তা ভেবে মুচকি হাসবো। কারণ কোনো কিছুই আশোলে ব্যাপার না। এক দিন আপনি হয়তো কারো একটা ফোন কল বা মেসেজের জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করবেন। কিন্তু কয়েকটা মাস গেলেই আপনি উপলব্ধি করবেন যে, আপনি যে এটা ছাড়া শুধু যে বাঁচতে শিখেছেন তা-ই নয়, বরং আপনি যে (ব্যক্তি, চাকুরি অথবা অন্য কিছু) পাওয়ার জন্য এত উৎসাহী ছিলেন, হয়তো সেটার আর কোনো আবেদন আপনার কাছে নেই। এটা অবশ্যই সত্য যে, আপনার কল্পনার চেয়েও ভালো জিনিশ আপনার জীবনে আছে। একমাত্র শর্ত হচ্ছে আপনি অধ্যবসায় চালিয়ে যাবেন। সেই সাথে একটা মুচকি হাসি বাঞ্ছিত। প্রতিটি হতাশা থেকে নতুন আশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকুন। কারণ সামনের বিষয়গুলো ভালোই হবে। সব সময় হয়।
শিশু হিশাবে টিভিতে আমার সংক্ষিপ্ত পারদর্শিতার মানে ছিলো রাতারাতি আমার বন্ধু বেড়ে গেলো। এত দিন আমি সহপাঠীদের নির্যাতন আর শিক্ষকদের উৎসাহমূলক মন্তব্য পেয়ে এসেছি। একবার 'object' শব্দটা ব্যবহারের কারণে নাদিয়ার হাতে আমি হেনস্থা হয়েছিলাম। তখন আমি ফাইভে পড়ি। সে জোর দিয়ে বলতে লাগলো, ইংরেজিতে এ শব্দটা নেই। আমার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। আমি কান্নায় ফেটে পড়লাম। তার ছলনায় অনেক হতাশ হলাম। শিক্ষকদের বিষয়টা ছিলো আবার ভিন্ন। একটা বড় সমস্যা ছিলো রাজনীতিবিদদের সন্তানদের প্রতি তারা স্থূল পক্ষপাতিত্ব দেখাতেন। তখন স্থানীয় রাজনীতি এবং ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিলো সাইফুল্লাহ পরিবারের হাতে। তবে তাদের চারপাশে যে রকম চাটুকারেরা ছিলো সে দিক থেকে চিন্তা করলে সাইফুল্লাহ পরিবারের মেয়েরা ছিলো সুন্দর এবং ভদ্র। আমি আশোলে এটা নিয়ে খুব গভীরভাবে চিন্তা করিনি। কিন্তু অতীতের দিকে তাকালে বুঝি আমি স্পষ্ট বুঝতে পারতাম যখন আপনি আচমকা সৌভাগ্য এবং খ্যাতির অধিকারী হন তখন মানুষের আচরণ কীভাবে বদলে যায়। আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাহীন শিশু ছিলাম। আমার বিকাশ ঘটে দেরিতে। ছেলেদের প্রতি অথবা রোমান্সের দিকে কোনো আগ্রহ ছিলো না। এগুলো অনেক পরে আসে। অন্য মেয়েরা কথাবার্তার মধ্যে ছেলেদের এবং যৌন কটাক্ষের বিষয়গুলো তুলতো। সেগুলো বুঝতে আমার অনেক কষ্ট হতো।
ছেলেদের সামনে আমি সব সময় একেবারে স্বাভাবিক থাকতাম। এক দিন টিভি সেটে এক তরুণ বিশাল স্টুডিওর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে গেলো। সে একটা বই তোলার ভাণ করলো। আমি একটু আগে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বই তুলতে এসে সে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘তুমি কেমন আছো?’ এ রকম সমাজে শালীন মেয়েরা কথা বলতো না। অবশ্যই এটা ছিলো গায়ে পড়ে কথা বলা। আমি অবাক হয়ে তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকালাম। সে আর এ চেষ্টা চালালো না। বাস্তবে আমি এটা বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমার ভিতরের নৈতিক পাহারাদার এ রকমের চাপা ব্যবহার খুব একটা পছন্দ করলো না। আমার মা তার যত সব পশ্চিমা হাবভাবের কারণে আমাদেরকে কঠোর নীতিপরায়ণতা শিখিয়েছেন। সে কারণে আমার কৈশোর মোটেও ঘটনাবহুল ছিলো না। টিভি সিরিজে কাজ করে আমি শুধু শৃঙ্খলাই শিখিনি, বরং অল্প বয়সেই মেকাপ দেয়া শিখেছি। আমি এতটাই দক্ষ হয়ে উঠি যে, আমাদের সামাজিক বৃত্তের সবার বিয়ের সাজ, ওয়াক্সিং, চোখের ভুরু এবং চুলের সাজ আমিই করি। মা দেখলেন নিজের হাবভাব ঠিক রাখা বাদ দিয়ে আমি অন্যদের চেহারা সুন্দর করতে গিয়ে এত সময় এবং শ্রম দিচ্ছি—এটা তো বিরক্তিকর। আমার সেরা বান্ধবী নাদিয়ার চুল ছিলো সোনালী বাদামী। সে তার ডাচ মায়ের কাছ থেকে এটা পেয়েছে। কিন্তু আমরা দুজনে পুরো গ্রীষ্মকাল সুইমিং পুলে কাটাতাম বলে ক্লোরিনে তার চুল নষ্ট হয়ে যায়। সতর্ক আচরণের ফলাফল পাওয়া গেলো। শীঘ্রই পুরো পেশোয়ার তার দ্যুতিময় লম্বা চুলের আলোচনায় অতি উৎসাহে যোগ দিলো।
নাদিয়ার সাথে আমার সারা জীবন একটা দীর্ঘ জটিল সম্পর্ক ছিলো। আমার মা যখন একটা তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানে আমাকে স্নো হোয়াইটের ভূমিকায় অভিনয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন, নাদিয়ার ভূমিকা ছিলো দুষ্ট রানীর। তার অভিনয় ছিলো দারুণ। কিন্তু আমার মনে হয় না মূল ভূমিকা নেয়ার কারণে সে কখনো আমাকে ক্ষমা করেছে। আমার মা খুব যত্নের সাথে পুরো বিষয়টার কোরিওগ্রাফি করলেন, কিন্তু তার স্বজনপ্রীতির মূল্য হিশাবে স্কুলে আমাকে কয়েক বছরের তিক্ততা অর্জন করতে হলো। চূড়ান্ত পর্যায়ে বিএফএফ হতে আমাদের কয়েক বছর লাগে। ১৯৮৫’র গ্রীষ্মে নাদিয়া এবং আমি আনুষ্ঠানিকভাবে বেস্ট ফ্রেন্ড হই। স্কুলের বাইরে প্রথম দিন থেকেই আমরা ছিলাম অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু আমার টিভি ক্যারিয়ারের মতো বন্ধুত্বটাও দীর্ঘ বিরতিতে এমন হয়ে দাঁড়ালো যে, সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা ছিলো অসম্ভব।
আমার টিভি মেকাপ অপছন্দ করার পিছনে আরেকটা অভাবিত সমস্যা ছিলো। বয়সের তুলনায় আমাকে অনেক বড় দেখাতো। অন্য দিকে ভক্তদের চিঠি যেহেতু বাড়তে লাগলো, টিভির ব্যাপারে আমার সম্প্রসারিত পরিবার থেকে আপত্তিও বাড়তে লাগলো। আমাকে বলা হলো এতে আমাদের পরিবার থেকে যেমন সমালোচনা আসছে, আবার আমাদের পরিবারের ব্যাপারেও বাইরের লোকেরা সমালোচনা করছে। আমাকে টিভি উপস্থাপনা বন্ধ করে দিতে বলা হলো। সুতরাং আমি তাই করলাম। আমি টিভিতে কাজ করা বন্ধ করে দিলাম। সকল পুরুষের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম, তাদের বয়স যা-ই হোক না কেন। আমি এ পরিস্থিতির দায় চাপালাম আমাদের সমাজের পুরুষদের উপরে। সে কারণে আমি পুরুষদের সাথে যে কোনো প্রকারের যোগাযোগের উপরে নিজেই একটা সেন্সরশিপ আরোপ করলাম। এর মানে দাঁড়ালো কেউ যদি দূর থেকেও আমার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়, সে আমাকে খুঁজে পাবে না। আমার কাছে আসতে পুরুষেরা কতটা আতঙ্কিত থাকতো সেটা কয়েক দশক পর আমার পুরুষ বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারলাম। এর ফলে জীবনের এ সময়টাতে রোমান্টিক টাইপের সামান্য কয়েকটা প্রস্তাব আমি পাই। সত্য কথা বলতে কী, যারা আমার পিছনে লেগেছিলো একজন বাদে তাদের প্রত্যেককেই আমি বিয়ে করেছি (তাকে প্রায় বিয়ে করে ফেলেছিলাম)।
আমার কৈশোরে যতটা রোমান্স জড়িত ছিলো, সে জীবন ছিলো ততটাই ঘটনাহীন। কিন্তু আমার কাছে যৌনতার তাত্ত্বিক জ্ঞান ছিলো : নিভৃতে আমি হবো আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এর শুরু আমার প্রথম পিরিয়ড দিয়ে। আমার পিরিয়ড শুরু হয় স্বাভাবিক বয়সের অনেক পরে। এ ব্যাপারে আমাকে কেউ কিছু বলেনি। তো আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে গিয়ে How To Tell Your Child About Sex নামে একটা বই নিলাম। আমি বুঝতে পারলাম আমার মা এত স্বাধীনচেতা হওয়া সত্ত্বেও শারীরিক পরিবর্তন এবং যৌনতার মতো সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নিজের থেকে বলতে পারেননি। সুতরাং আমি নিজেই ব্যাপারটা সামলালাম। স্যানিটারি ন্যাপকিন কেমন হয় সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা ছিলো না। আমি নিজেই বানিয়ে নিলাম। একজন সার্জনের বাড়িতে থাকার কারণে এটা সহজ হলো। কয়েক মাস পরে মায়ের চোখে আমার পিরিয়ডের বিষয়টা ধরা পড়ে। তার কথাটা এখনো আমার মনে আছে, ‘আরে বেটি, মায়ের কাছে না বললে কার কাছে বলবে?’
এই হলো কাহিনী। স্যানিটারি ন্যাপকিনের একটা প্যাকেট আমার জন্য বাথরুমে অপেক্ষা করতো। বার্ডস অ্যান্ড বিস টক আর কখনো দেখা হয়নি। আমার মিস সবজান্তা হওয়ার পিছনে একটা কারণ ছিলো। আমাকে এর সব জানতে হয়েছে, কারণ আমার নিজেকেই এর সব করতে হয়েছে। সব সময় এ এমনটাই ঘটেছে।
গর্ভধারণ থেকে শুরু করে জন্মবিরতি, প্রতিলক্ষণ পর্যন্ত সব কিছুই আমি নিজে নিজে শিখেছি। অবসরে কোনো আগ্রহী শ্রোতাকে এ সব জ্ঞান আবার নিরপেক্ষভাবে জানানো হয়েছে। মেয়েরা আমাকে ‘মর’ (পশতু ভাষায় এর মানে হচ্ছে মা) উপাধি দিয়েছিলো। চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং সঠিক তথ্যের উপরে ভিত্তি করে আমি লেকচার দিতাম। লেকচার হতো বাস্তবতার উপরে ভিত্তি করে, সেখানে মেয়েলি কোনো হাসাহাসি থাকতো না। আমার মনে আছে, ক্লাশ নাইনে এক দিন আমি একটা কনডম নিয়ে গেলাম—যৌন শিক্ষা ক্লাশে আমার যে সব উৎসুক অনুসারী ছিলো, তাদের উপর্যুপরি অনুরোধে। আমার বাবা আফগান শরণার্থীদের জন্য ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প চালাতেন। তার কাপবোর্ডে আমি হঠাৎ কনডমের বিশাল কার্টন পেয়ে গেলাম। বাচ্চা হিশাবে সৌভাগ্য যে, আমি যেহেতু এর আশোল উদ্দেশ্য জানতাম না, মনে আছে আমি সেগুলো দিয়ে বেলুন ফুলাতে লাগলাম। এবার সেই বইয়ের জ্ঞান থাকার কারণে আমি বড় বড় চোখের শ্রোতাদের সামনে প্যাকেটটা খুললাম। আমরা একটা রুলার দিয়ে এটার দৈর্ঘ্য মাপলাম। হয়তো এটা সুবুদ্ধিপূর্ণ ছিলো না। ফলে আমার মনে হয় আমরা সবাই একমত হলাম আমরা কুমারী থাকবো এবং কখনো যৌন মিলন করবো না। ঘটনাক্রমে আমাদের গ্রুপের এক ফাজিল মেয়ে ক্লাশ টিচারকে বিষয়টা বলে দেয়। তিনি আমাকে ডেকে এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। আমার কাছেও অবশ্যই একটা রেডিমেড যৌক্তিক জবাব ছিলো। সব সময়ের মতো আমার মীমাংসার দক্ষতা ছিলো ব্যতিক্রম। আমি মিস লিনাকে বুঝাতে সক্ষম হলাম যে, বিষয়টা তারই উচিত ছিলো আমাদেরকে বলা। দেখলাম আমাদের পাকিস্তানী মা-বাবাদের তুলনায় গির্জার আইরিশ ক্যাথোলিক সিস্টাররা আরো বেশি রক্ষণশীল। মেকাপ অথবা অলঙ্কার পরে আসার কোনো অনুমতি আমাদের ছিলো না। স্কুলে কোনো রকম ফ্যাশন অথবা শোবিজ ম্যাগাজিন নিয়ে আসা ছিলো বেআইনী। স্কুল বাসে পর্যন্ত চুইংগাম চিবানো ছিলো নিষিদ্ধ। মিলস অ্যান্ড বুলসের মতো বিখ্যাত রোমান্টিক উপন্যাসগুলো নিয়মিত হানা দিয়ে বাজেয়াপ্ত করা হতো। আমার আরেক অনানুষ্ঠানিক বেস্ট ফ্রেন্ড সাওদা (সে সারা জীবন আমার চমৎকার সাহায্যকারী ছিলো), সে ছিলো এমঅ্যান্ডবি’র বইয়ের আগ্রহী পাঠক। এ নিয়ে আমাদের দল যদি কোনো সমস্যায় পড়তো, উদ্ধার পাওয়ার জন্য সে আমার উপরে নির্ভর করতো। আমি ছিলাম সিস্টার জেসিন্টা’র লাইব্রেরি অ্যাসিস্ট্যান্ট। তিনি আমার পাঠাভ্যাসের কথা জানতেন। আমার কখনো বাজে রোমান্টিক উপন্যাসের দিকে ঝোঁক ছিলো না। আমি ডুবে থাকতাম দর্শন, রাজনৈতিক ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস অথবা জীবনী গ্রন্থে। কনফুসিয়াস থেকে শুরু করে মাইন ক্যাম্ফ পর্যন্ত সবই আমি পড়েছি।
সুতরাং জানুয়ারির সেই ঠাণ্ডা দিনটাতে সিস্টার যখন আচমকা হানা দেয়ার কথা ভাবলেন, জানতাম সন্দেহের তালিকায় আমার নাম সবার শেষে থাকার কারণে অন্যদের মতো আমি ততটা তল্লাশির মুখোমুখি হবো না। আমাদেরকে যখন ক্লাশরুম থেকে ব্যাগ রেখে খালি হাতে বেরিয়ে যেতে বলা হলো, আমি দ্রুত আমাদের বাস্কেটবল খেলোয়াড় টিমের সদস্যদের কোটের ফিতা খুলে নিয়ে বইগুলো লুকিয়ে ফেললাম। এগুলো নিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। এভাবে মিলস অ্যান্ড বুনসের এক বছরের জন্য নেয়া বই কীভাবে ক্লাশ টেনের ক্লাশরুম থেকে গায়েব হয়ে গেলো সেটা চিরদিনের জন্য গোপন রইলো।
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের মা-বাবা এবং সমাজ শরীর অথবা যৌনতা সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু না জানতে দিলেও সেই বছরই আমাদের দুজনের বিয়ে হয়ে গেলো। আমাদের মূল গ্রুপের সবার বিয়ে হলো পরের দুই বছরের মধ্যে। এই তালিকায় যার থাকার সম্ভাবনা ছিলো সবচেয়ে কম, সেই আমিও অন্তর্ভুক্ত হলাম।

এখানে অধ্যায় ২-এর প্রথম পার্ট দেয়া হলো। শুরু থেকে পড়তে লেখকের টাইমলাইন ফলো করতে পারেন। http://www.facebook.com/habib.kaium.bd
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৩৯
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×