রাত বারোটা নাগাদ বাসায় ফিরলাম।
শুনলাম মা'র গলার ভেতর একটা ছোট-মাছের কাঁটা আটকে আছে। আজ দু'দিন ধরে চেষ্টা করছেন বের করার জন্য। অর্ধেক ভেঙে বাকিটা মাংসের ভেতর গেঁথে আছে।
কাছে গিয়ে বললাম, "দুই দিন ধরে গলায় কাঁটা আটকে বসে আছেন, আমাকে জানান নি কেন? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম।"
হেসে বললেন, "ভাবলাম এম্নি এম্নি চইলা যাইবো। তাই জানাই নাই। তাছাড়া তুই অনেক ব্যস্ত থাকস সারা দিন।"
"তাই বলে গলায় কাঁটা নিয়ে বসে থাকবেন দুই দিন ধরে? চলেন এখন যাই।"
"কই যাবি এত রাইতে?"
"হাসপাতালে যাবো। ইমার্জেন্সি বিভাগে গিয়ে ডাক্তার দেখাবো।"
"সারাদিন পরিশ্রম করছস, এখন যা, হাত-মুখ ধুইয়া খেয়ে শুয়ে পর। তোর চোখ লাল হইয়া আছে। কাল সকালে যামু নে।"
"তাড়াতাড়ি বোরখা পড়ে নেন, আমি গাড়ি বের করছি।"
"এখন গেলে অনেক রাত হইবো। তোর ঘুমের সমস্যা হইবো। কাল যামু নি। যা খাইতে যা..।"
..এই হলেন মা, ছেলের সামান্য ঘুমের সমস্যার কথা ভেবে সারারাত গলায় কাঁটা নিয়ে বসে থাকবেন। বহু কষ্টে গলার ভেতর ঢোক গিলবেন। তবুও চাইবেন না তার জন্য ছেলের রাতের ঘুমের সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটুক। সেই ছোটবেলায় যখন পেশাব করে বিছানা ভিজিয়ে ফেলতাম। তখন নিজে ভেজা জায়গায় শুয়ে আমাকে আস্তে করে টেনে তুলে নিজের শুকনো জায়গায় শোয়াতেন। খুব আস্তে করে টেনে তুলতেন আমায়, যেন ঘুম থেকে জেগে না যাই। যেন বিন্দু মাত্র ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে আমার...।
অত:পর এক প্রকার জোর করে হাত ধরে নিচে নামিয়ে গাড়িতে বসালাম।
রাতের ব্যস্ত শহরে মাকে গাড়িতে চড়িয়ে শাঁ শাঁ বেগে গাড়ি ছুটিয়ে চলছি। মনে হলো তিন মিনিটে সাত কিলো দূরের হাসপাতালে পৌঁছে যাই।
সোডিয়ামের হলুদ আলোয় মায়াবী শহরটাকে যেন আরো মায়াবী ঠেকতে লাগলো।
মা বললেন, "এমন পাগলের মতো ছুঁটছিস কেন? আস্তে চালা। আস্তে চালা।"
এমন সময় আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বিখ্যাত "বীরপুরুষ" কবিতার দুটো লাইন মনে পড়ে গেল-
"মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।"
হাসপাতালে কাজ শেষে বাসায় পৌঁছারবার সময় ঘণ্টায় বিশ কিলো বেগে গাড়ি চালাতে লাগলাম। মা বললেন, "কি রে এত আস্তে চালাইতাছস কেন? আরো জোরে চালা। কী চালাইতাছস?"
"গাড়িতে সমস্যা হইছে মা। স্পিড উঠছে না।"
মিথ্যে বললাম। কেন না মা যতই বলুক, গাড়ির গতি বাড়াতে ইচ্ছে করছিল না আমার। মনে হলো, রাতের এই মায়াবী শহরে আরো কিছুটা সময় মাকে গাড়িতে নিয়ে ঘুরে বেড়াই। আরো কিছুটা সময়...। আরো কিছুটা সময় মা আমার একান্ত সান্নিধ্যে থাকুক। আমি আর মা আমরা দুজন একান্তে কাটাই আরো কিছুটা সময়....।
বাসার কাছে আসতেই চোখ দুটো জলে ভরে এলো। এত আস্তে গাড়ি চালালাম। তবুও এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম! কখনো কখনো সময় সত্যি ওল্কার বেগে চলে যায় যেন! মা বললেন, "তোর চোখ দুইটা একদম লাল হইয়া গেছে, যা যা খাইয়া শুয়ে পড় তাড়াতাড়ি।"
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিফট এর দিকে এগুতে লাগলাম....।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:৩৮