somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বন্ধুতা (২য় এবং শেষ অংশ)

২৪ শে অক্টোবর, ২০১২ রাত ১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অরু আর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা বেশ ভালোভাবেই কাটতে লাগল । সারা মাস ঘুরে ঘুরে আড্ডা দিয়েও পরীক্ষার কিছুদিন আগে লেখাপড়া করেও পাশ করে যাচ্ছিলাম । ফার্স্ট ইয়ার,সেকেন্ড ইয়ার...। জীবনে এই প্রথম বার অরুকেও দেখলাম, আমার মত লেখাপড়ায় ঢিল দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে । প্রতিদিনই লাইব্রেরী থেকে নানা রকম বই এনে, নীলক্ষেত থেকে বই কিনে কিনে রুমটাকেই ছোটখাটো লাইব্রেরী বানিয়ে ফেলল । ক’দিন পর সিদ্ধান্ত নিলো, ছাত্র-ছাত্রী পড়াবে । নিজের জ্ঞানের চর্চাও হবে, উপরি কিছু আয়ও হবে । সব শুনে আমি হাই তুলি শুধু । আমি সাধারণ মানুষ । এইসব হাইপথেটিকাল চিন্তা-ভাবনা আমার মাথার তিন হাত উপর দিয়ে যায় । আমি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাই । আর আপনমনে আমি আমার সঙ্গিনী, মানবীকে খুঁজে বেড়াতে থাকি ।
দেখতে দেখতে থার্ড ইয়ার ফাইনালের তারিখ ঘোষণা হল । পরীক্ষা শুরু হওয়ার দেড় মাস আগে প্রায় কোমর বেঁধে পড়তে বসে যাই, বাইরে ঘুরাঘুরি তো দূরে থাক; বন্ধুদের মধ্যে কেউ পার্টি দিলেও যাই না । আর পরীক্ষা শুরু হওয়ার সাত দিন আগে থেকে টয়লেট যাওয়াও প্রায় বন্ধ করে দিলাম । মা ফোন করলে, “খুব ব্যস্ত আছি বলে” বলে অরিন্দমকে মোবাইলটা দিয়ে দেই । অরিন্দমও ধীরে-সুস্থে অনেকক্ষণ লাগিয়ে কথা বলে মা’র সাথে । আমি যখন রাতের পর রাত জেগে বই পড়তে পড়তে ঘুমানোর সময়টাও পাই না, তখন অরুর বাচ্চা অরু নাক ডাকিয়ে ঘুমায় । ইচ্ছা করছিল, কষিয়ে একটা লাথি মারি ।
সেবার কোনোরকমে সম্মান বাঁচিয়ে পরীক্ষাতে উতরে যাই ।
পরীক্ষা শেষে আবারো অবসর । এইবার আমি সিরিয়াস হয়ে গেলাম । একটা প্রেম তো করতেই হয় । আর কতদিন রিলেশনশিপ স্ট্যাটাসে “single” দিয়ে রাখা যায় ! ছোট ছোট পোলাপানের দুইটা-তিনটা করে গার্ল ফ্রেন্ড , আর আমার একটাও নাই ! এইটা তো কোনোমতেই মানা যায় না । কিন্তু আমার এই অতি উৎসাহ মাঠে মারা যায় । কারণ, আমার নিজের কাছেই কোন মেয়েকে মন মত মনে হত না । তাই শেষমেশ হতাশ হয়ে অন্যান্য বন্ধুদের তাদের ‘ইয়ে’দের সাথে “ইমারজেন্সী প্রাইভেট আলাপ” এর সময় পাহারা দিয়ে বেড়াই । এভাবেই একদিন রাফির ‘অবিবাহিত স্ত্রী’ এর সাথে দেখা করার জন্য রাফির সাথে আমাকে যেতে হল ঢাকা মেডিকেলে । ‘পাহারাদার’ হিসেবে । আমি হাই তুলতে তুলতে সেই ‘গুরুদায়িত্ব’ পালন করে যাচ্ছিলাম । আর তখনই দেখা হয় একটা মেয়ের সাথে । আর জীবনে প্রথমবারের মত হা করে তাকিয়ে থাকলাম কোন মেয়ের দিকে । সেদিন প্রথম দেখা হয় । এরপর আরও অনেক জায়গায় মেয়েটার সাথে দেখা হতে থাকে আমার । আর আমিও নিজের উপর সব রকমের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাকিয়ে থাকি মেয়েটার দিকে । একদিন আমি আর অরু শাহবাগের দিকে যেতে গিয়েও হঠাৎ করেই মেয়েটার সাথে দেখা হয়ে গেল আমাদের । আমি যথারীতি ভ্যাবলার মত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করি, মেয়েটাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে । একসময় আমার দিকেই আসতে লাগল ! সত্যি বলতে আমি বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম । নিজের চোখ দুটোকে গালাগাল করতে গিয়ে দেখি মেয়েটা আমার ঠিক সামনেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে । আমি প্রায় বলেই ফেলেছিলাম যে আমি আমার আচরণে দুঃখিত । কিন্তু তার আগেই দেখি মেয়েটা হাসিমুখে অরিন্দমের সাথে কথা বলছে । আমি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেই অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম, অরু এই মেয়েকে চিনে কিভাবে ! নিজেদের মাঝে কিছুক্ষণ কথা বলা শেষে অরু আমাদের মাঝে পরিচয় করিয়ে দিল । মেয়েটার নাম জানলাম । ফারিয়া । ঢামেক এ এবছর ভর্তি হয়েছে । অরু, ফারিয়ার প্রাইভেট টিউটর ছিল । তাই অরুকে “স্যার” সম্বোধন করছিল ফারিয়া । পরিচয় পর্বের সময় মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে এতো সুন্দরভাবে একটা হাসি দিল যে, আরেকটু হলেই আমি ঐ রাস্তাতেই পড়ে যেতাম । কিছুক্ষণ পর মেয়েটা চলে যেতেই আমি অরুর শার্টের হাতা ধরে টানতে লাগলাম ।
“দোস্ত...”
“ফারিয়ারে দেখলে তোর সার্ভার হ্যাং মারে... এই তথ্য কি তাহলে সত্য ?”
“তুই জানলি কিভাবে !?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি । অরু তখন হেসে উত্তর দিল, “এতো বছর তোর সাথে আছি... আর এইটা না বোঝার কি আছে ?!”
আমি তখন অনুনয়, বিনয় শুরু করে দিলাম, ফারিয়াকেই চাই । অরু তখন বিশাল ভাব মেরে বলল, “সবুর কর...সবুর কর । সবুরে ফারিয়া ফলে ।” আমি ‘সবুর’ করলাম । ফারিয়াও ‘ফলল’ । ঝগড়া-ঝাঁটি, খুনসুটির মধ্যে দিয়ে প্রেম চলতে লাগল আমাদের । আমিও বুয়েট থেকে পাস করলাম । চাকরী পেলাম । এই প্রথম অরু আর আমার কর্মক্ষেত্র আলাদা হল । অরু আমার থেকে আরও ভালো চাকরী পেল, সেটাই স্বাভাবিক ছিল । ঐদিকে বাবার সম্মতিতে মা আর অরুকে দিয়ে ফারিয়ার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হল । ফারিয়ার বাবা-মাও তাতে দ্বিমত করেন নি ।
--------------------------------------------------------
পুরোহিত এসে একবার চারপাশে তাকালেন । অস্তগামী সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে মন্ত্র পড়া শুরু করলেন । চন্দন কাঠ আনা হয়েছে । অরিন্দমের এক মামাতো ভাই এসেছেন । পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ এর মত বয়স । একটু পর পর রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছে নিচ্ছেন । বিরক্ত মনে হল তাঁকে । মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে একবার তাকালেন, অবাক চোখে । তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও সেদিকে তাকালাম । অনেক অনেক মানুষ । সবাই একবার অরুকে দেখতে চায় । একজন একজন করে এসে দেখেও যাচ্ছে । আমি সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার অরুর মামাতো ভাই এর দিকে তাকালাম । ভদ্রলোকের নাম অভিজিৎ । স্বর্ণের ব্যবসায়ী । অথচ অরুর সাথে কোনোদিন তাঁকে যোগাযোগ করা তো দূরে থাক, কথা বলতেও দেখিনি । আমার হঠাৎ করেই রাগ উঠতে লাগল লোকটার উপর......প্রচণ্ড রাগ......প্রচণ্ড ।
পুরোহিত বলার পর কিছু লোক এসে অরিন্দমকে চিতার উপরের কাঠের উপর শুইয়ে দিয়ে গেল । অভিজিৎ এর হাতে একটি মশাল ধরিয়ে দেয়া হল । পুরোহিতের সাথে তিনি মন্ত্র পাঠ করতে লাগলেন ।
“ওঁ দেবাশ্চাগ্নিমুখা এনং দহন্তু ”
মন্ত্র পাঠ শেষে একটি মাটির তৈরি হাঁড়ি অভিজিৎ এর কাঁধে বসিয়ে দেয়া হল । তারপর সেটির পেছনের অংশটি ভেঙ্গে দেয়া হল । অরুকে মাঝখানে রেখে তিনি সেই হাঁড়িটি নিয়ে চারপাশে ঘুরতে লাগলেন, আর হাঁড়িতে থাকা পানি পড়তে লাগল । পুরোহিত এবং অভিজিৎ দুজনেই মন্ত্র পড়তে লাগলেন ।
“ওঁ কৃত্বা তু দুষ্কৃতং কর্ম জনতা বাপ্যজনতা ।
মৃত্যুকালবশং প্রাপ্য নরং পঞ্চত্বমাগতম ।
ধর্মাধর্মংসিমাযুক্তং লোভমোহসমাবৃতম ।
দহেয়ং সর্ব্বগাত্রানি দিব্যান লোকান ম গচ্ছাতি ।”

আকাশের কালিমা হঠাৎ করেই সরে গেল । ঠাণ্ডা, মৃদু-মন্দ বাতাস আমাদের গায়ে এসে লাগল । আমি অরুর দিকে তাকালাম । শেষ বিকেলের আলো এসে পড়ছে ওর মুখে । শান্তির ঘুমে মগ্ন অরু ।
----------------------------------------------------------------
ফারিয়ার সাথে আমার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করা হল । মা-বাবাকে ততদিনে আমি ঢাকায় নিয়ে এসেছিলাম । আমি , অরু আর বাবা-মা । আমি, মা আর অরু কেনাকাটার জন্য যাই মার্কেটে । কেনাকাটার ফাঁকেই জিজ্ঞেস করছিলাম, “তোর পছন্দের কোন মেয়ে থাকলে বল ... দুই দোস্ত একসাথে বিয়ে করে ফেলি ।”
অরু হাসতে হাসতে বলল, “তোর নিজের বিয়ের ব্যবস্থা করলাম আমি । আর তুই শালা আমার বিয়ের পাত্তা লাগাস ...”
“সেইটা ঠিক । কিন্তু তোর একটা বিয়ে দিয়ে দিলে ভালো হয় । দেখে-শুনে রোবট টাইপ একটা মেয়ের সাথে বিয়ে । যাকে নাম জিজ্ঞেস করলে থার্মোডিনামিক্সের সূত্র বলবে... তুই যখন বলবি ‘আই লাভ ইউ’... তখন মেয়েটা বলবে, আইন্সটাইনের সূত্রে ভুল আছে । ...তোর তো এমন বউই দরকার যে তোর গবেষণায় সাহায্য করবে ।”
“তোরে রে... ”
আমি তখন দৌড়ে পালাই । মা আমাদের কাণ্ড দেখে হাসেন । একসময় কেনা-কাটা শেষ হয় । বাড়ি ফেরা হয় । আমাদের আত্মীয়-স্বজনে বাড়ি পূর্ণ । তারা সবাই বাসা সাজাচ্ছে । এছাড়াও আরও নানা কাজে ব্যস্ত । আমি আর অরু একসাথে বসে আড্ডা দেই । রাতে ঘুরে বেড়াই ।
অরুর মাথায় তখন নতুন ভূত…. রাতে রাস্তায় হেঁটে হেঁটে চাঁদ দেখা ।
সেদিন আকাশে চাঁদটাও ছিল বেশ বড় । আজ পূর্ণিমা নাকি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে দেখি অরু প্রায় হা করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে । ‘জোছনা-পাগল’ নামে একটা শব্দ আছে বাংলা সাহিত্যে । অরিন্দমকে দেখে আমি শব্দটার যথার্থতা পাই । এমনভাবে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় যেন, অজানা কোন এক আকর্ষণে অরু আটকে আছে । অরুর দেখাদেখি আমিও একসময় হা করে জোছনা গিলি ।

পরদিন গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান । সকাল থেকেই অরু ব্যস্ত হয়ে গেল আলোকসজ্জার ব্যবস্থা সহ আনুষঙ্গিক অন্য সব কাজে । আর আমি একা একা বসে আকাশ দেখতে লাগলাম । গায়ে হলুদের সময় আমার অনেক বন্ধু, কাজিন আর অরু মিলে আমাকে নিয়ে ফাজলামি করতে লাগল । আর আমি চুপচাপ বসে বসে সব সহ্য করছিলাম । একটা সময় বাবা এসে সবাইকে চ্যাঁচামেচি কম করতে বললেন । বাবার কথায় কাজ হয় না, সবাই আরও চিৎকার করতে থাকল ।
সেদিন রাতে পূর্ণিমা ছিল । অরুর কাছ থেকে জেনেছিলাম । আমরা দুই বন্ধু আর সবার চিৎকার থেকে আলাদা হয়ে চাঁদ দেখতে ছাদে চলে গেলাম । অরু আজও তন্ময়ের মত তাকিয়ে আছে আকাশের চাঁদের দিকে । আমিও তাকিয়ে থাকি একমনে । সত্যিই...কেমন যেন একটা আকর্ষণী শক্তি আছে এই চাঁদের । আমরা হা করে জোছনা গিলতে থাকি । একসময় অরুই নীরবতা ভাঙ্গে ।
“রাহাত...তোর সাথে মনে হয় আজই আমার শেষ জোছনা দেখা ।”
“শেষ মানে ? আমি কি মরে যাচ্ছি নাকি !”
“বিয়ে মানেই তো দ্বিতীয় মৃত্যু ।” অরু হাসতে হাসতে বলল । আমিও হাসতে লাগলাম ।
“তাহলে তো তোকেও মেরে ফেলা দরকার । পছন্দের মেয়ে থাকলে বল । তোর বিয়ে দিয়ে দেই ।”
“আমার পছন্দের কেউ থাকলে তো তুই জানতিই রে আহাম্মক ।” একটু থেমে অরু আবার বলতে লাগল, “তোকে একটা কথা বলা হয় নাই ।”
“লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছিস নাকি ?” অবাক হওয়ার ভান করলাম আমি । অরু আবারো হাসতে লাগল, “তোর নিজের বিয়ের সময় এসে মাথার মধ্যে শুধু বিয়ের কথাই ঘুরে । ফারিয়াকে ফোন কর ।”
আমি এবার চুপ মেরে গেলাম । চাঁদটা মেঘের আড়ালে ঢেকে গেল । আবার উদয় হল । লুকোচুরি খেলছে যেন । আমি অরুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি কথা বলিস নাই ?” অরু তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আমাকে একটা স্কলারশিপের অফার করেছে তারা ।” আমার খুশিতে প্রায় বাকরোধ হয়ে গেল । “এইরকম ভালো একটা খবর তুই চেপে রাখিস কেন ?!”
“আগামীকালই আমাকে ভিসার কাজে ঢাকা যাওয়া লাগবে । আর কালই তোর বিয়ে । তাই এতদিন কিছু বলিনি ।” সব শুনে আমি বললাম, “হুর...বিয়ে ক্যানসেল । আমার বিয়ে তে তুই না থাকলে বিয়ে করারই দরকার নাই । কয়েকদিন পর বিয়ে করলে কিছু হবে না ।” এরপর অরুর প্রবল আপত্তির পর ঠিক করা হল, অরু কাল বিয়ের সব অনুষ্ঠানের পর খুব ভোরে রওনা হবে । তারপর আমরা ছাদ থেকে নেমে রাতের খাবার খেতে চলে গেলাম ।
বিয়ের দিনটাতেও বলতে গেলে অরুই মাতিয়ে রাখল সবাইকে । কঠোর মানুষিকতা, নিয়মানুবর্তিতার মানুষ আমার বাবা । অরু বাবাকেও হাসিয়ে ছাড়ল । বিয়ের গেট থেকে শুরু করে রান্না-বান্নার নজরদারিও অরু একাই করল । অরুর কর্মদক্ষতা সেদিন সবাই টের পেয়েছিল ।
বিয়ের বাদ বাকি সব কাজ শেষে অরু রাতেই চলে যেতে চাইলো । কিন্তু আমি বাধা দেই । রাতের বেলা বের না হয়ে ভোর পাঁচটা-ছয়টার দিকে রওনা দিতে বলি অরুকে । সারাটা জীবন অরু আমার নানা রকম অন্যায় আবদারও হাসিমুখে পালন করে গেছে । আমার মত এই অচ্ছুতের জন্য শেষ আবদারটুকু পালন করতেও তাই আপত্তি করেনি সে ।
পরদিন আটটা সাঁইত্রিশ ।
একটা ফোন আসে আমার নাম্বারে । আমার সারা পৃথিবী থমকে দাঁড়িয়েছিল যেন সেই সময়টাতে । দু’পায়ে আর জোর পাইনি আমি । হাঁটু মুচড়ে পড়ে যাই ।
-----------------------------------------

সাতবার প্রদক্ষিণ শেষে অভিজিৎ মশাল হাতে এগিয়ে আসলেন ।অরুর উপর চন্দন কাঠের টুকরোগুলো রাখা হল । পুরোহিতের সম্মতিতে আগুন ধরিয়ে দিলেন তিনি অরুর মুখের দিকটাতে । ... হঠাৎ-ই বৃষ্টি শুরু হল । মা আমাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছেন । বাবাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না; আজ বাবাও কাঁদছেন । ফারিয়াও একপাশে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলতে লাগল । কাঁদছে আরও অনেকেই । কাঁদছে আকাশের মেঘ । শুধু কাঁদছি না আমি । এক সময়কার ছিঁচকাঁদুনে আমি ... আজ কাঁদতে পারছি না । আমি একমনে অরুর পুড়তে থাকা দেহটার দিকে তাকিয়ে আছি । বৃষ্টিতে আগুন কমছে না । বাতাস পেয়ে আরও বাড়ছে মনে হচ্ছে । আগুনের শিখাটার দিকে আমার নানারকম কথা মনে হতে লাগল । মনে হচ্ছিল, এই পুরো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের একদিন সৃষ্টি হয়েছিল শূন্য থেকে । আমাদের ফিরেও যেতে হবে একদিন এই শূন্যের পথে । দুইটা শূন্যের মাঝে আমরা বাস করছি । এই জীবনের কোন মূল্য নেই । একটুও মূল্য নেই । তা নাহলে, যে মানুষটার কারণে আমি জীবনে সবচেয়ে বেশী খুশি হতাম, যার মুখ না দেখে আমার ঘুম ভাঙ্গত না ...যে ছেলেটার কারণে আজ আমি এই অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত – আজ সেই মানুষটাকেই কেন সৃষ্টিকর্তা বেছে নিবেন ‘ফিরে না আসার দেশ’ এ পাঠাতে ? এই জীবনের তো কোন মূল্যই নেই । নেই নেই...একটুও নেই ।
আমি আস্তে আস্তে অরুর দিকে যেতে লাগলাম । আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল অরু এখনি উঠে আসবে । আবার আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলবে । আমাকে ধরে বলবে আমি যা দেখছি সব ভুল । সব দুঃস্বপ্ন । অরু মারা যায় নি । অরু আগের মতই আছে । পূর্ণিমা রাতে আমরা দুই বন্ধু আবার একসাথে জোছনা গিলব । রাত জেগে লাইট জালিয়ে লেখাপড়া করার জন্য অরুকে গালাগাল করব । ভার্সিটির ক্যান্টিনে খেয়েদেয়ে অরুর হাতে বিল ধরিয়ে দিয়ে পালাব । অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমরা ফোনে আড্ডা দিব ।
কিন্তু... না । অরু উঠে আসে না । আমার ঘোর ভাঙ্গে । নিজের আবেগের কাছে পরাজিত হই আমি । চিৎকার করে বলতে থাকি, “অরু দোস্ত ... তুই উঠে আয় । আমার জ্বর হলে তুই ছাড়া আর কে রাত জেগে আমার মাথায় পানি ঢালবে ? তুই ছাড়া আর কে আমাকে আমার ভুলগুলো ধরিয়ে দিবে ? নিজে অসুস্থ থেকেও কে হাসিমুখে আমার সব আবদার মেনে নিবে ? ... অরু............দোস্ত......... তুই উঠে আয় । তুই সবাইকে বল, যে তুই আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে চলে যেতে পারিস না ... দোস্ত......... তুই...” আর বলতে পারি না আমি । আমার কণ্ঠস্বর জড়িয়ে যায় । আমি শুধু তাকিয়েই থাকি ।

ছেলেটার নাম ছিল অরিন্দম । অরিন্দম সাহা । আর কখনোই তাকে কেউ অরু বলে ডেকে উঠবে না ।

[......অরু উঠে আসে নি । প্রকৃতির কান্নার সাথে রাহাতের সেই আর্ত-চিৎকার মিশে যায় । রাহাত তাকিয়ে থাকে অরুর পুড়ে যাওয়া দেহটার দিকে । শেষ বিকালের বৃষ্টি মুছে দিতে চায় যেন সবার চোখের অশ্রু । এতোগুলো মানুষকে কাঁদিয়ে যে মানুষটা চলে গেল, তাকে আর কখনোই পাওয়া যাবে না...কক্ষনোই না । বড়ই অদ্ভুত এই পৃথিবী । ......... ]

পরদিন দেশের প্রায় সবগুলো জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতার নিচের দিকে প্রকাশিত হয়:
“ঘাতক ট্রাক কেড়ে নিলো মেধাবী অরিন্দমের প্রাণ” ~সমাপ্ত~
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×