somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই পর্যালোচনা - স্বাক্ষী ছিল শিরস্ত্রাণ (লেখকঃ সুহান রিজওয়ান)

০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফ্ল্যাপে লেখা দুটো লাইন দিয়েই শুরু করি,
“এই কাহিনি একটি যুদ্ধোত্তর দেশের । সেখানে বহুমাত্রিক সব জটিল গণিত, আলোকের যত অনন্তধারার সঙ্গী দুর্ভাগ্যের অন্ধকার । ‘স্বাক্ষী ছিলো শিরস্ত্রাণ’ – এই দুই সর্পিল সময়ের পটে দাঁড়ানো একজন সরলতম মানুষের গল্প ।”
– সেই মানুষটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে সাধারণ জ্ঞানের বইয়ের পাতার ‘বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ’ । ইতিহাস খোড়াখুড়ি করে এরকম একজন প্রচারবিমুখ মানুষকে খুঁজে বের করাটা লেখকের জন্য যথেষ্ট দুঃসাধ্য ছিল এবং বইটা না পড়ে কেবল প্রচ্ছদে চোখ বুলিয়ে আর পৃষ্ঠা সংখ্যার দিকে তাকালেই সেই কষ্টের জন্য প্রশংসাটা আপনাআপনিই চলে আসে ।

এবার বইটার ভেতরের পাতাগুলোয় প্রবেশ করা যাক । শুরুর কিছু অধ্যায় বেশ সিনেমাট্যিক । হঠাৎ ফ্ল্যাশব্যাক, তারপরেই আবার ফিরে এসে এগিয়ে যাওয়া । তবে লেখনীতে একটা ‘ইদানিং-বেশ-নতুন’ ধারা দেখা গেছে, ব্যাপারটাকে ঠিক কী বলে নামকরণ করা হয়েছে জানি না; আমি এটাকে বলবো ‘ফ্ল্যাশ-ফিউচার’ বলে । যেমন, “এই তাজউদ্দীন—হয়ে উঠবেন উনিশশো একাত্তরের নিঃসঙ্গ সেনাপতি।”, “নিউ ইয়র্ক টাইমস কয়েকদিন পরেই ছাপবে সেই অবিশ্বাসের হেডলাইন” – বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভিন্ন সময়ের বর্ণনায় ভবিষ্যদ্বাণীর ভঙ্গিমায় ফুটে উঠেছে এই বিশেষ ধরণের লেখার ঢং যেটা এর আগে কেবল শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্ণেল’- এ দেখেছিলাম ।
উপন্যাসজুড়ে লেখার অলংকরণ আর উপকরণের মধ্যে আলোচনা যদি করা হয়, তাহলে উপকরণ তথা তথ্যের পরিমাণ খুব বেশী বলে মনে হয়েছে । বেশীরভাগ সময়ই কাল্পনিক চরিত্রগুলোর মুখ দিয়ে তৎকালীন বিভিন্ন সত্য ঘটনার ব্যাখ্যা-উপস্থাপনের ধরণটা আকর্ষণীয় । তবে সেগুলো হয়তো আরেকটু মানবিক উপায়ে উপস্থাপন করা যেতো । খানিকটা মেকি ভাব চলে এসেছে লেখায় ।


উপন্যাসের দুইটি খন্ড করা হয়েছে যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ আর এর পারিপার্শ্ব নিয়ে । প্রবাসী সরকারের নানা ইতিহাসের গল্প বলার ঢং এ আমার পড়া এখন পর্যন্ত সেরা কোনো বই এটি । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশ নিয়ে কিছু বই পড়া আছে, তাই তথ্যগুলো হয়তো সবসময় চমকের মত কাজ করেনি কিন্তু যা জানা ছিল, তারচেয়েও বেশী তথ্য জানতে পেরে ভালো লেগেছে । যুদ্ধের সময়ের বিখ্যাত ঘটনাবলীর সময়ক্রম ঠিক রেখে বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষদের কলম দিয়ে উঠে আসা ইতিহাসকে আশ্রয় করে লেখা অধ্যায়গুলো মনে রাখার মত । তবে যুদ্ধটা যেন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেলো ।

এরপর যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ এবং এর চড়াই উতরাই পেরোনো । উপন্যাসের এই অংশে এসে হয়তো লেখকের হঠাৎ মনে পড়লো তিনি আসলে তাজউদ্দীনকে নিয়েই উপন্যাস লিখছেন, সমস্ত বাংলাদেশ উনার ধর্তব্য না । তাই এ অংশে এসে আমরা বেশী বেশী দেখতে পেলাম তাজউদ্দীনকে, যার উপস্থিতি উপন্যাসের প্রথম অংশজুড়ে খুবই কম । কিন্তু সত্যি বলতে, উপন্যাসের প্রথম অংশটা, লেখক যার নাম দিয়েছেন ‘পূর্ব খণ্ড’, সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে । পাতায় পাতায় উত্তেজনা, চরিত্রগুলোর মানবিক উপস্থাপন ইত্যাদি ।
বারবার ‘মানবিক উপস্থাপন’ কথাটা বলার কারণ মূলত উপন্যাসের ‘পূর্ব খণ্ড’ অংশ । বিভিন্ন চরিত্রের বিচার-বিশ্লেষণগুলো লেখক করেছেন বেশ নৈর্ব্যক্তিক উপায়ে । নৈর্ব্যক্তিক আলোচনার প্রেক্ষিতে বলতে হয়, লেখক মূল চরিত্র তাজউদ্দীনকে নিয়ে খুব বেশী নিরপেক্ষ ছিলেন না বরং তার আশেপাশের মানুষগুলোই হয়ে উঠেছে বেশী বাস্তবিক এবং জীবন্ত যেমন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ।


উপন্যাসের পরের অংশ, ‘উত্তর খণ্ড’ এর পর্যালোচনায় বলতে হয় এ অংশের অধ্যায়গুলোর অসাধারণ নামকরণের কথা । আলাউদ্দীন-বাতেন-তারেক প্রমুখ কাল্পনিক চরিত্রের মুখ দিয়ে বাহাত্তর থেকে পচাত্তরের সময়কালের বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনাবলীর গ্রহণযোগ্য একেকটি ব্যাখ্যার কথা পড়ে ভালো লেগেছে । উপন্যাসের এই অংশে আমরা দেখতে পাই কীভাবে একটি হতদরিদ্র দেশের অর্থমন্ত্রী হয়ে দিনরাত কাজের মধ্যে ডুবে থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় থাকেন অথবা বিদেশের দাতাদেশগুলোর কাছে একেবারে মাথানত না করে কীভাবে নিজেদের প্রয়োজনমাফিক ঋণের প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন । অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাইকেলে চড়ে গণমানুষের কাছে গিয়ে বাজারের দ্রব্যাদির দাম পর্যবেক্ষণ করা যেমন আলোড়িত করে তেমনি চাটুকার দলের প্রকোপে জাতির পিতার কাছ থেকে তাঁকে ক্রমাগত প্রত্যাখ্যাত হতে দেখা আমাদের অস্থির করে তোলে। আবার, উপন্যাসে বর্ণিত সহজ সরল তাজউদ্দীন আহমেদ, যিনি কিনা শত প্রতিকূলতা, গুজব, কুৎসার মাঝেও মুক্তিযুদ্ধের হাল ছাড়েননি, হয়ে উঠেছিলেন বলিষ্ঠ এক নেতা, সেই তিনিই পরবর্তীতে কী এক ডিপ্রেশনে ভুগে যখন রাস্তার আইল্যান্ডে গাড়ি তুলে দিয়ে দূর্ঘটনায় আক্রান্ত হন, তখন আমরাও যেন সেই একই ডিপ্রেশনে নিমজ্জিত হই । ওদিকে বঙ্গবন্ধুর সাথে খন্দকার মোশতাকের দহরম-মহরম তাজউদ্দীন আহমেদের মত আমাদেরও ব্যাথিত করে তোলে । এক অদ্ভুত অক্ষমতায় হাত-পা সেঁধিয়ে আসে যেন । এইসব দিক দিয়ে লেখককে সফলই বলতে হবে ।


তবে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় খলনায়ক খন্দকার মোশতাকের ক্যারেক্টার বিল্ড আপ একদমই ভালো মনে হয়নি । বরং মোশতাকের প্রতিটি কথার শেষে ‘হে হে’ যোগ করে এরকম ঠাণ্ডা মাথার খুনীর চেহারায় যেন রিলিফের গম চুরি করা গ্রাম্য মেম্বারের একটা প্রলেপ দেয়া হচ্ছিল । লেখকের এই দিকটায় আরো মনোযোগ দেয়া উচিত বলে মনে হয়েছে ।


সর্বোপরি, বাংলাদেশের ইতিহাসে তাজউদ্দীন আহমেদ একজন জুডাসের মত । এরকম একটি লোক স্বাধীনতার এতোগুলো বছর পরেও অভিমাণী হয়ে লুকিয়ে ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে । লেখক সুহান রিজওয়ানকে আবারো ধন্যবাদ তাঁকে সে ইতিহাসের অলিগলি থেকে উদ্ধার করে আনবার জন্য । জাতীয় চার নেতার অন্য তিন নেতাকে নিয়েও আগ্রহ সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে আপনাআপনিই । লেখকের কাছ থেকে তাই প্রত্যাশাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে । আশা করি আশাহত হবো না । ভবিষ্যতে আরো ভালো লেখার অপেক্ষায় থাকলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:১৯
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

সম্পর্ক

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২


আমারা সম্পর্কে বাঁচি সম্পর্কে জড়িয়ে জীবন কে সুখ বা দুঃখে বিলীন করি । সম্পর্ক আছে বলে জীবনে এত গল্প সৃষ্টি হয় । কিন্তু
কিছু সম্পর্কে আপনি থাকতে চাইলেও থাকতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×