ঘরের খুঁটিতে শ্যাওলা ধরেছে কয়েকযুগ আগেই। টিনশেড বেয়ে পরজীবী লতাগুল্মরা বাসা বেঁধেছে পাশের শতবর্ষী কাঁঠাল গাছে। যে ঘরটাতে আমি একাকীত্ব যাপন করছি, সে ঘরটার সাথে আমার চারদশকের সম্পর্ক। ঘরের প্রতিটি দেয়াল আমাকে চেনে। এখনো এই ঘরে খুঁজে পাই শৈশবের ঘ্রাণ এক চিরচেনা শব্দ। কাঠের খোদাই করা দারুশিল্পের পরতে পরতে কতকিছু লেখা সিলভার হরফে। আমার শৈশবের হাতের লেখার ওপর ছুঁয়ে দেই আমার রুগ্ন হাতের পরশ।
আমার কানে আসে দম্পতি চড়ুইদের কোলাহল, পাকা জামের গন্ধ, জারুল ফুলের আকুল করা ঘ্রাণ। বাড়ির পাশের খেতে জমে থাকা নতুন পানির টলমল কানে আসে। নিরাবরন শৈশবে যেমন আমার প্রেমিকা ছিলনা এই ঘরে, আজো প্রেমিকা নেই এই ঘরজুড়ে। এই বাড়িটি আমাকে আশ্রয় দিয়েছে যুগে যুগে, আগলে রেখেছে জীবনের পর জীবন। যাপিত জীবনের অনেক গল্প খুনসুটি মেরে লেপ্টে আছে।
আমার সাথে জীবনের গল্প ভাগাভাগি করে টিকটিকি, ঘরকুনো ব্যাঙ, লাল পিঁপড়ের দল, মাকড়সারা। রাত নিশুথ হলে ঝরাপাতার শব্দের সাথে গান শোনায় রাতজাগা পাখিরা। আমি ওদের গানে কেবল বিরহের সুর শুনি। করোনাকাল অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে আমাকে। প্রকৃতির সাথে সখ্য করে বেঁচে থাকাটা আনন্দের।
ঘরের মেঝেতে গজারী কাঠের একটা চৌকি। পায়া- পাইর সব জৌলুসতায় ভরপুর। নান্দনিক সব কারুকাজ। দুশো বছর আগের এই চৌকিতে সংসার বেঁধেছিল আমার পূর্বপুরুষরা। আমার চারপাশে অষুধের কৌটো, শরবতের গেলাস, কালোজিরা দানায় ভরা ভেষজ বয়াম। ফলের ঝুড়ি থেকে পিঁপড়ের সারি গিয়ে থেমে যায় ঘরের পূবকোণে। আমার দৃষ্টি থেমে যায়, গজারী কাঠের শরীরে খোদাই করা লেখায় -
"এলাহি ভরসা"
৯ আশ্বিন ১২২৭ বঙ্গাব্দ।"
আহা, পৃথিবীতে তখন করোনাকাল ছিল না।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ বিকাল ৩:৫১