বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের নাগরিক, বিশেষকরে শহুরে নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেমের এক দারুণ প্রণোদনা কাজ করছে। দেশপ্রেম প্রকাশের উছিলাটি হল-ইন্টানেটে ভোটের মাধ্যমে বাংলাদেশের সুন্দরবন ও কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতকে পৃথিবীর আশ্চর্য স্থানগুলোর রেটিংয়ে সবচেয়ে উপরে উপরে স্থান করে দেবার প্রচেষ্টা। প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে অনেকেই বেশ আটঘাঁট বেঁধেই নেমেছেন ভোট সংগ্রহে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস ,কারখানা, বাসাবাড়ি সব জায়গায় এই দেশপ্রেমিক কর্মদল ছুটে বেড়াচ্ছেন সংগ্রহে। এ থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশের মানুষের মনে কী পরিমাণ দেশপ্রেম কাজ করে।
ভোট সংগ্রহে অংশ নেবার পর থেকে কিছু প্রশ্ন, দ্বন্দ্ব, ভাবনা আমাকে তাড়িত করছে। যেমন বাংলাদেশের আশ্চর্য দর্শনীয় স্থান কি শুধুই সুন্দরবন ও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত? সন্দেহহীন উত্তর 'না'। আমাদের দেশে আরো বহু আশবচর্য দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তবে কেন সেগুলো নিয়ে কোন রা নেই? একটি স্থান তার কিছু বৈশিষ্ট্য ও শর্তের ভিত্তিতে আশ্চর্য বলে বিবেচিত হয়। দেশের অন্যান্য আশ্চর্য স্থানগুলোর বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব কি বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত হচ্ছে?
একটি স্থানকে কি শুধু ভোটের মাধ্যমে আশ্চর্য স্থান বলে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়? ধরি চীনেও দুটি আশ্চর্য স্থান রয়েছে। চীনের জনসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। চীনের প্রতিটি নাগরিক যদি তাদের প্রতিটি আশ্চর্য স্থানের জন্য ৫টি এবং বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক যদি এখানকার প্রতিটি স্থানের জন্য ১০টি করে ও ভোট দেয় বাংলাদেশের আশ্চর্য স্থান রেটিংয়ে উপরে উঠতে পারবে? তাছাড়া চীনের চেয়ে আমাদের প্রযুক্তিগত প্রসার নিতান্তই সামান্য। চীনের যত মানুষের কাছে প্রযুক্তি সুবিধা আছে আমাদের দেশের তার সামান্যও নেই যে মানুষে ইন্টারনেটে ভোট দেবে।
বিষয়টি হল ভোট দিয়ে কোন কিছুকে ভালো বা খারাপ হিসেবে আখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। যা ভালো তা তার আপন বৈশিষ্ট্যের কারণেই ভালো। কেউ ভোট দিলেও তা ভালো, কেউ ভোট না দিলেও তা ভালো। ধরা যাক আমেরিকার নাগরিকগণ তাদের কোন একটি খুব সাধারণ স্থানের জন্য সবাই মিলে সেটিকে আশ্চর্য স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে; তবে কি তা আশ্চর্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত? আবার আফ্রিকা সহ বিশ্বে বহু স্থান রয়েছে যা আশ্চর্যের চেয়েও বেশি আশ্চর্যের। এসব স্থান আধুনিক সভ্যতার চেয়ে ক্রোশ পেছনে এবং যেখানে ইন্টারনেট নেই, নেই ভোট দেবার মতো স্বাক্ষর নাগরিক। তাহলে এসব স্থান কি ফেলনা হয়ে যাবে? আবার বাংলাদেশের কেউ যদি ভোট না দিতে পারে তবে কি কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত থাকবেনা বা সুন্দরবন কি সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন থাকবেনা? আবার ভোট না দিলেই কি এসব স্থানের অনিয়ম এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঢেকে যাবে? তবে এ ভোট সংগ্রহের কাজ যে দেশপ্রেমের পরিচায়ক এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
ভোটের মাধ্যমে শুধু একটি স্থানের জনপ্রিয়তা নির্ধারণ করা যেতে পারে; স্থানটির বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত-এসব স্থানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে কীভাবে সাধারণ জনগণ ও পর্যটকদের কাছে আরো আকর্ষণীয় ও সুলভে প্রবেশযোগ্য করে তৈরী করা যায়। এরও বাইরে দেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, উত্তরবঙ্গসহ যেসব স্থান প্রশাসনের সুনজরের অভাবে দিনেদিনে গৌরব হারাতে বসেছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করে প্রশাসনকে এবং দেশের মানুষকে এগুলোর জন্য কাজ করতে হবে।
সুন্দরবনে প্রতিদিন নির্বিচারে গাছ কেটে এবং বন্য প্রাণী হত্যা করে মুনাফা লুটছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। সেখানকার বাওয়ালিদের ঋনের ফাঁদে ফেলে মহাজনেরা বন থেকে নির্বিচারে গাছ ও গোল পাতা সংগ্রহে বাধ্য করছে। এতে সেখানকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। সুন্দরবনের এ গাছগুলোই গত সিডরের সময় খুলনাবাসীকে অনেকখানি রক্ষা করছে। বর্তমানে সুন্দরবনের বহু প্রাণী ও বৃক্ষ প্রজাতি আজ প্রায় বিলুপ্ত। কক্সবাজার সৈকতের পরিবেশ দর্শনার্থীরা দূষিত করছে প্রতিদিন। ভোট সংগ্রহে যারা নিজেদের মূল্যবান সময় ব্যয় করছেন তাদের দেশপ্রেমের চেতনাকে সশ্রদ্ধ সালাম। তথাপি এসব স্থানের সমস্যাগুলো নিরসনে এগিয়ে আসতে হবে। আশা করি সকলে দেশপ্রেমের সর্তিকার পথ খুঁজে নিতে স্বচেষ্ট হবেন।
হাসান তৌফিক
আই.ই.আর.
ঢাবি
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মার্চ, ২০০৯ রাত ৯:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




