১৯৯০ সাল সোভিয়েত ইউনিয়নের ডোনলেসকোজ রেলওয়ে স্টেশন।একদম শান্ত সুনশান এই মফঃস্বল শহরে্র এই স্টেশনে দিনে মাত্র দুবারই ট্রেন আসে,খুব ব্যাস্ত না হলেও সোভিয়েত পুলিশ আর গোয়েন্দা বিভাগ এই স্টেশনে দুজন গোয়েন্দা দিয়ে পালা করে ২৪ঘন্টাই নজরদারি করছে,অবশ্য এমন স্পেশাল নজরদারি চলছে সোভিয়েত ইউনিয়নের আরও প্রায় চারশো ট্রেন এবং বাস স্টেশনে,ট্রেন আসার সময় হওয়ায় প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসা সাদা পোষাকের গোয়েন্দা উঠে দাঁড়ায় পাটফর্মের অন্য প্রান্তে যাবার জন্য ঘুরে দাড়াতেই সে দেখতে পায় স্টেশন লাগোয়া ঘন জঙ্গল থেকে এক মাঝবয়সী লোক বেরিয়ে আসছে স্বভাবজাত অনুভুতি দিয়েই গোয়েন্দা বুঝতে এই মাঝবয়সী লোকটার মদ্ধে কিছু একটা সমস্যা আছে।ভালোভাবে লক্ষ্য করার জন্য গোয়েন্দা কিছুটা আড়ালে চলে যায়,মদ্ধ্যবয়সী লোকটা কিছুটা খুড়িয়ে হেটে প্লাটফর্মেই প্রবেশ করে,শুধু তাই নয় প্লাটফর্মের বেসিনে সে তার জুতো জ্যাকেট থেকে মাটি ধুয়ে পরিষ্কার করে গোয়েন্দা এবার লোকটির দিকে এগিয়ে যায় এবং লক্ষ্য করে তার চিবুকের একপাশে জমাট বাধা রক্ত এবং তার বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলে গভীর একটা কাটার ক্ষত যেখান থেকে তখনও রক্ত ঝড়ছে।গোয়েন্দা লোকটির পরিচয় জানতে চায়।তবে পরিচয় পেয়ে গোয়েন্দা রীতিমত ঘাবড়ে যায় কারন যাকে সে চ্যালেঞ্জ করেছে সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য আন্দ্রে রোমানোভ চিকাটিলো,গোয়েন্দা তাকে তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিলেও প্রায় দুঃসাহসিক এক কাজ করে বসে,সে ঐদিনই এই ঘটনা থানায় রিপোর্ট আকারে জমা দেয়।এই ঘটনার প্রায় চব্বিশ ঘন্টা পর ঐ স্টেশন লাগোয়া জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা হয় ২২ বছর বয়সী এক তরুনীর লাশ,লাশের শরীরে অনেকগুলো ছুরির আঘাতের দাগ,তরুনীর স্তন কামড়ে ছিড়ে নেয়া হয়েছে এবং গত কয়েকবছরে উদ্ধার হওয়া আরও প্রায় ত্রিশটা লাশের মত তার চোখও খুচিয়ে তুলে নেয়া হয়েছে।
(চিকাটিলো)
চিকাটিলো সোভিয়েত ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার, যে কিনা ১৯৭৮ থেকে ১৯৯০ সালের মদ্ধে প্রায় ৫৬ শিশু কিশোর আর তরুনীকে হত্যা করেছে। যার মদ্ধে ৫২ টি ঘটনার সত্যতা তদন্তে উঠে এসেছে। সোভিয়েত রাশিয়া, ইউক্রেন আর উযবেকিস্থান জুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করা এই সিরিয়াল কিলার কে ধরা পড়ার পর “বুচার অফ রোস্তভ” নাম দেয়া হয়।
চিকা এই সিরিজের বাকী সিরিয়াল কিলারদের মত নয় বরং চিকাকে নিয়ে হাল্কা পড়াশোনা করার সময় আমার বারবারই মনে হয়েছে, চিকার পেছনে যে মানুষটা বার বার উকি দিয়ে গেছে সে হচ্ছে যোসেফ স্ট্যালিন।এমনকি চিকাটিলোর নিজেও তার বিচার চলাকালে বারবার স্টালিনকে দায়ী করেছে অবশ্য তার কথা বিশ্বাস করার কোন কারন নেই কারন সিরিয়াল কিলিং ইনভেস্টিগেটর জন ডগলাস এর মতে চিকাটিলো হচ্ছে More bad than mad।
(মুভির একটা দৃশ্য)
চিকার জন্ম ১৯৩৬ সালে, ইউক্রেন এ। এটা সেই সময় যখন স্টালিন এর জমি অধিগ্রহন এর আইন এর কারনে ইউক্রেনে হলোদোমর নামে পরিচীত ভয়বহ দুর্ভিক্ষ চলছিলো।তাই চিকা জন্ম থেকেই চারিদিকে শুধু ক্ষুধা আর ক্ষুধা দেখেছে। তারচেয়েও ভয়বহ ব্যাপার হচ্ছে কথিত আছে এই ভয়বহ খাদ্য সংকটের সময় চিকার প্রতিবেশীরা চিকার বড় ভাইকে ধরে রান্না করে খেয়ে ফেলে, ভয়াবহ ক্ষুধার কারনে নর মাংস ভক্ষন তৎকালীন ইউক্রেনে কোন আশ্চর্্যরজনক ঘটনা ছিলো না বরং এই নিয়ে ইউক্রেনে একটা কৌতুক ও প্রচলিত ছিলো
“আমার আন্টি কে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।কারন তার আমন্ত্রিত অতিথী তার দেয়া স্যুপ এর মদ্ধে তার আগের অতিথীর আঙ্গুল ভাসমান দেখেছিলো”
(চিকাটিলোর শিকার এক হতভাগ্য)
যাই হোক চিকার শৈশবেই দ্বিতীয় বিশবযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং চিকার বাবাকে কন্সক্রিপ্ট হিসেবে যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। জার্মান বাহিনীর সামনে এই সোভিয়েত বাহীনী টিকতেই পারেনি এবং ইউক্রেনের মাটিতে সোভিয়েত বাহিনী জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পন করে, যা কিনা এখন পর্্যিন্ত মানব ইতিহাসের আওন্যতম সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পন এর ঘটনা। কিন্তু স্ট্যালিন এর কাছে আত্মস্মর্পন করা প্রতিটা সৈনিক এবং জেনারেল একেকটা গাদ্দার।তাই যুদ্ধের বাকি সময় এবং যুদ্ধের পরও এইসব সৈন্য আর তার পরিবার কে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সু্যোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিলো। যাই হোক এই যুদ্ধের ডামাডোলের মাঝেই আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়, চিকার সামনেই জার্মান সৈন্যরা ধর্ষন করে চিকার মা কে। এই ঘটনা তার মনোজগতে এক গভীর ক্ষত রেখে যায় যে ক্ষত আর কখনোই সারবে না এবং তাকে নিয়ে যাবে সিরিয়াল কিলিং এর অন্ধকার জগতে।
(পুলিশের সামনে চিকাটীলো নিজেই তার হত্যা পদ্ধতি দেখাচ্ছে)
চিকাটিলোর মুল শিকার ছিলো ছোট শিশু এবং কিশোরী বা সদ্য তরুনীরা যারা শারীরীক ভাবে চিকার তুলনায় দুর্বল ছিলো , যদিও চিকার হত্যাকান্ডগুলো সেক্সচুয়াল ফ্যান্টাসি বা সেক্সচুয়াল স্যাডিজম এর উদাহরন কিন্তু চিকা কোন অবস্থাতেই স্বাভাবিক যৌনকর্ম করতে সক্ষম ছিলো না, তাই আবুঝ শিশু বা দুর্বল টিনেজারদের উপর অত্যাচার করেই মানুষিক তৃপ্তি পেত, চিকার এই দেড় দশক ব্যাপী চালানো হত্যাযজ্ঞ গুলো থেমে যেতে পারতো একদম শুরুতেই কিন্তু তা হয় নি কারন সোভিয়েত সমাজব্যাবস্থা ও আইন ছিলো চিকাটিলোর মতই ইমপোটেন্ট। তার প্রথম শিকার নয় বছর বয়সী সেই অবুঝ কন্যাশিশুটির হত্যার দায় চাপানো হয় ঐ এলাকার পুরনো এক অপরাধীর ঘাড়ে যে এর আগে ধর্ষন মামলায় জেল খেটেছিলো। অথচ শিশুটির পায়ের ছাপ পাওয়া গিয়েছিলো চিকাটিলোর ঘরে।
(চিকাটিলোর গ্রেফতারের মুহুর্ত)
হলিঊড এর পরিচালক ডেনিয়েল এস্পিনোসা চিকাটিলো কে নিয়ে তৈরী করেছেন চাইল্ড ৪৪ নামের মুভিটা। তবে সত্যি কথা বলতে এই মুভিতে চিকাটিলোর উপস্থিতি মোট মুভির ১ শতাংশও না তবে চিকা ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে এই মুভিতে সবসময়ই ছিলো, এই মুভিটাকে বরঞ্চ সোভিয়েত সমাজ ব্যাবস্থা কতটা ব্যার্থ ছিলো তার একটা সামান্য নমুনা বলা যেতে পারে। তবে বামপন্থী আর রাশিয়ানরা এই মুভিটা হজম করতে পারে নি তাদের আক্রমনে এই মুভির আইএমবিডি রেটিং এ ধ্বস নামে তাই চমৎকার এই মুভিটার রেটিং দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। টম হার্ডী, গ্যারী ওল্ডম্যান, নাওমি রুপাক ছাড়াও ডীপার্টমেন্ট কিঊ খ্যাত আমার প্রীয় দুই অভিনেতা ফারেস এবং নিকোলা কাস ও এই মুভিতে অভিনয় করেছেন।
আগের পর্ব
জেফ্রি ডাহমার
রবার্ট হ্যানসেন
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ১১:৪৪