somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা ফোক গানের আদি তারকারা - (মেগাপোস্ট)

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ‘ঐরাবত’ নামে একটি নাটকে প্রয়াত জনপ্রিয় নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদ গায়ক সেলিম চৌধুরীর কণ্ঠে গাওয়া “আইজ পাশা খেলবরে শ্যাম” গানটি ব্যাবহার করেন। সেই গান দিয়ে আমার ফোক গানের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। খুব ছোট বেলার কথা মনে আছে, যখন ভোরে বাংলাদেশ বেতারে কোরআন তেলাওয়াত শেষে বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হত, যার মাঝে থাকত আব্দুল আলিম, আব্বাসউদ্দিন প্রমুখদের অবিস্মরণীয় সব গানগুলো। খুব ভালো লাগত, তন্ময় হয়ে শুনতাম, শিশুমন হয়ত বুঝতো না কোনটা ভাওাইয়া, কোনটা জারিসারি আর কোনটা পল্লীগীতি। কিন্তু কেমন একটা ফোক গানের প্রতি ভালোবাসার বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল সেই শৈশবেই। তো যে কথায় ছিলাম, সেলিম চৌধুরীর কণ্ঠে গাওয়া “আইজ পাশা খেলবরে শ্যাম” গানটি তখন বাম্পার হিট, চারদিকে বাজে। কিন্তু উৎসের তেমন খোঁজ না থাকায় ফোক গান তেমন একটা কর্ণগোচর হলনা বেশ কিছুকাল। এরপর আবার নেশা জেগে উঠল যখন হাবিব ওয়াহিদ নামের তরুন মিউজিশিয়ান আমাদের জন্য নিয়ে এলেন তার প্রথম এলবাম “কৃষ্ণ”। ফোক সঙগুলো আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সাথে অবিকৃত আঞ্চলিক উচ্চারণে মন কেড়ে নিল সকলের। এরই আগে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের সিনেমাগুলোতে পেলাম অজানা কিছু লোকজ সংগীত। এরপর শুরু হল লোকজ গান তথা ফোক গান সংগ্রহ করে শোনার হিড়িক। আজকের লেখা মূলত আমার পছন্দের ২০ জন ফোক গানের রচয়িতা, সুরকার বা গায়কদের নিয়ে। আসুন দেখি তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ


১। লালন শাহঃ লালন শাহ’র জন্ম ১৭৭৪ সালে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বাঙালী যিনি ফকির লালন, লালন সাঁই, লালন শাহ, মহাত্মা লালন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক, অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ছিলেন। লালনকে বাউল গানের একজন অগ্রদূত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার গানের মাধ্যমেই ঊনিশ শতকে বাউল গান বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। লালন ছিলেন একজন মানবতাবাদী যিনি ধর্ম, বর্ন, গোত্রসহ সকল প্রকার জাতিগত বিভেদ থেকে সরে এসে মানবতাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন। অসাম্প্রদায়িক এই মনোভাব থেকেই তিনি তার গানসমূহ রচনা করেন। তার গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুলের মত বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বুদ্ধিজীবিসহ অসংখ্য মানুষকে। তার গানগুলো মূলত বাউল গান হলেও বাউল সম্প্রদায় ছাড়াও যুগে যুগে বহু সঙ্গীতশিল্পীর কন্ঠে লালনের এই গানসমূহ উচ্চারিত হয়েছে। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম, তাকে ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।


২। সিরাজ সাঁইঃ ফকির লালন সাঁই এর গুরু কে ছিলেন এ নিয়ে যথেষ্ট মত পার্থক্য রয়েছে। ফকির লালন শাহের গানে পাওয়া যায় সিরাজ সাঁই এর নামটি। তবে বাউলদের অনেকে মনে করে সিরাজ সাঁই নামের কোন গুরুর অস্তিত্ব নেই। তাদের মতে সিরাজ সাঁই হলেন সেই রাজ সাঁই। অর্থাৎ যিনি জ্ঞানের রাজা। সেই তো সর্ব শক্তির আধার। পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা। কথিত আছে যে, তিনি হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু ছেলেবেলায় জলবসন্ত রোগে অসুস্থ অবস্থায় তাঁর পরিবার তাঁকে ভেলায় ভাসিয়ে দেয়। তখন মলম শাহ এবং তার স্ত্রী মতিজান নামের এক মুসলমান দম্পতি তাঁকে আশ্রয় দেন এবং সুস্থ করে তোলেন। মলম শাহ তাকে কুর’আন ও হাদিস শিক্ষা দেন এবং ধর্মীয় শিক্ষার জন্য ফকির সিরাজ সাঁই নামের একজন ফকিরের কাছে পাঠান। এরপর লালন তার গুরু সিরাজ সাঁই এর আশ্রয়ে আশ্রিত ছিলেন। নিঃসন্তান সিরাজ সাঁই এতিম লালনকে পালক পুত্ররুপে গ্রহণ করার প্রস্তাব দিলে লালন তাতে সম্মত হন। এভাবেই তিনি তার ভাবী জীবনের পথ প্রদর্শক গুরু সিরাজ সাঁই এর সান্নিধ্যে আসেন। সিরাজ সাঁই জাতিতে মুসলমান এবং পেশায় পাল্কী বাহক বেহারা সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন।


৩। হাছন রাজাঃ দেওয়ান হাসন রাজা বাংলাদেশের একজন মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী। তার জন্ম ২১ ডিসেম্বর, ১৮৫৪, প্রকৃত নাম দেওয়ান হাসন রাজা। মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে লালন শাহ্‌ এর প্রধান পথিকৃৎ। তবে দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার। হাসন রাজার চিন্তাভাবনার পরিচয় পাওয়া যায় তার গানে। তিনি কতো গান রচনা করেছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া যায়নি। 'হাছন উদাস' গ্রন্থে তার ২০৬ টি গান সংকলিত হয়েছে। এর বাইরে আর কিছু গান 'হাসন রাজার তিনপুরুষ' এবং 'আল ইসলাহ্‌' সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শোনা যায়, হাসন রাজার উত্তরপুরুষের কাছে তাঁর গানের পান্ডুলিপি আছে। অনুমান করা চলে, তাঁর অনেক গান এখনো সিলেট-সুনামগঞ্জের লোকের মুখে মুখে আছে, কালের নিয়মে বেশ কিছু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পদ্যছন্দে রচিত হাসনের অপর গ্রন্থ 'সৌখিন বাহার'-এর আলোচ্য বিষয়-'স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও কুড়া পাখির আকৃতি দেখে প্রকৃতি বিচার(লোকসাহিত্য পত্রিকা, জুলাই-ডিসেম্বর ১৯৭৯। সৈয়দ মুর্তাজা আলী,'মরমী কবি হাসন রাজা')। 'হাছন বাহার' নামে তাঁর আর একটি গ্রন্থ কিছুকাল পূর্বে আবিস্কৃত হয়েছে। হাসন রাজার আর কিছু হিন্দী গানেরও সন্ধান পাওয়া যায়।


৪। আব্বাসউদ্দিনঃ আব্বাসউদ্দিন একজন প্রখ্যাত বাংলা লোকসঙ্গীত গায়ক। বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দীন আহমদ ১৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। বলরামপুর স্কুলে আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯১৯ সালে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা এবং ১৯২১ সালে কুচবিহার কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এখান থেকে বিএ পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে তিনি সংগীত জগতে প্রবেশ করেন। আধুনিক গান, স্বদেশী গান, ইসলামি গান, পল্লীগীতি, উর্দুগান সবই তিনি গেয়েছেন। তবে পল্লীগীতিতে তার মৌলিকতা ও সাফল্য সবচেয়ে বেশি। গানের জগতে তার ছিল না কোনো ওস্তাদের তালিম। আপন প্রতিভাবলে নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরেন। তিনি প্রথমে ছিলেন পল্লীগায়ের একজন গায়ক। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, গোলাম মোস্তফা প্রমুখের ইসলামি ভাবধারায় রচিত গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন। আব্বাস উদ্দিন ছিলেন প্রথম মুসল্মান গায়ক যিনি আসল নাম ব্যবহার করে এইচ এম ভি থেকে গানের রেকর্ড বের করতেন।রেকর্ড গুলো ছিল বাণিজ্যিক ভাবে ভীষণ সফল।


৫। আব্দুল আলিমঃ আব্দুল আলীম বাংলা লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী লোক সঙ্গীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে জীবন জগৎ এবং ভাববাদী চিন্তা একাকার হয়ে গিয়েছিল।আবদুল আলীমের জন্ম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই। তিনি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই আলীম সঙ্গীতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। অর্থনৈতিক অনটনের কারণে কোন শিক্ষকের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। তিনি অন্যের গাওয়া গান শুনে গান শিখতেন। আর বিভিন্ন পালা পার্বণে সেগুলো গাইতেন। এভাবে পালা পার্বণে গান গেয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। দেশ বিভাগের পরে আব্দুল আলীম ঢাকায় চলে আসেন এবং রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। তিনি পরে টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। এছাড়াও তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো ‘লালন ফকির’। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির মতো গান রেকর্ড হয়েছিল তাঁর। আব্দুল আলীম তাঁর আধ্যাত্মিক ও মরমী মুর্শিদী গানের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সঙ্গীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক।


৬। শাহ্‌ আব্দুল করিমঃ বাউল গানের কিংবদন্তী শাহ আবদুল করিম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দারিদ্র ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম-ভালোবাসার পাশাপাশি তার গান কথা বলে সকল অন্যায়,অবিচার,কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরূদ্ধে। তিনি শরীয়তী, মারফতি, নবুয়ত, বেলায়া সহ সবধরনের বাউল গান এবং গানের অন্যান্য শাখার চর্চাও করেছেন। স্বল্পশিক্ষিত বাউল শাহ আব্দুল করিম এ পর্যন্ত প্রায় দেড় সহস্রাধিক গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তাঁর ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী এ বছরের প্রথম দিকে সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। সাম্প্রতিককালে এ সময়ের বেশ কয়েকজন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন।

৭। উকিল মুন্সীঃ রমী সাধক গীতিকবি উকিল মুন্সির জন্ম নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামে। তিনি জন্মেছেন ১৮৮৫ সালের ১১ জুন, আর মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৮ সালে। উকিল মুন্সির যখন ৯ বছর বয়স তখন তাঁর পিতা মারা যান। ঠিক তার পরের বছর উকিল মুন্সির মাও মারা যান। পিতা-মাতার মৃত্যুপরবর্তীতে উকিল মুন্সিকে তাঁর চাচা কাজী আলিম উদ্দিন নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার গাগলাজুর ইউনিয়নের জালালপুর গ্রামে নিয়ে আসেন। উকিল মুন্সি ১৯১৪/ ১৯১৫ সালের দিকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার জালালপুর গ্রামের সাধারণ কৃষক লবু হোসেনের সুন্দরী ষোড়শী কন্যা লাবুশের মায়ের প্রেমে পড়েন। এরপর উকিল মুন্সি লবু হোসেনের বাড়ির আশপাশ দিয়ে যাতায়াতকালে একটি গান রচনা করেন। আর সেই গানটি হলো ‘ধনু নদীর পশ্চিম পারে, সোনার জালালপুর। সেখানেতে বসত করে, উকিলের মনচোর।’ এই গানটি উকিল মুন্সির কণ্ঠে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ফলে এই গানের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রেমের কথা চারদিকে জানাজানি হয়। তাদের এই প্রেম অসম অবস্থার শিকার হলে কাজীবাড়ির লোকেরা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, অসম বিয়ে ছিল কাজীবাড়ির জন্য অত্যন্ত অপমানজনক। এই পরিস্থিতিতে উকিল মুন্সি কিছুদিন জালালপুরের আশপাশে শ্যামপুর, গাগলাজুর, জৈনপুর গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন, আর বিরহী ভাব নিয়ে গান গাইতেন। লোকমুখে শোনা যায় শোয়া চান পাখি গানটি তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে রচিত। কিন্তু বিভিন্ন বাউল গবেষকের মতে, গানটি উকিল মুন্সি মৃত বউয়ের শিয়রে বসে রচনা করেন। উকিল মুন্সি তাঁর চরিত্রমাধুর্য, মানবপ্রেমী হৃদয়, দরাজ গলা, ভরাট ও মিষ্টি কণ্ঠস্বর, সর্বোপরি তার সৌম্যকান্তি অবয়ব সঙ্গীত ও ধর্ম প্রতিভার অপূর্ব সমন্বয়ের কারণেই তাঁর জীবনে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছিল। উকিল মুন্সি ও তাঁর গান নিয়ে নেত্রকোনার হাওড়াঞ্চলের মানুষের মধ্যে রয়েছে ভাটিয়ালি সুর ঐতিহ্যে বিরহ-বিচ্ছেদের এক অপূর্ব সুরধারা।


৮। আব্দুর রহমান বয়াতিঃ আব্দুর রহমান বয়াতী ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রসিদ্ধ লোকসঙ্গীত শিল্পী। তিনি একাধারে অসংখ্য জনপ্রিয় লোকগানের শিল্পী, গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক৷ ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকার সূত্রাপুর থানার দয়াগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন আবদুর রহমান বয়াতী। এ পর্যন্ত তার প্রায় পাঁচশ একক গানের অ্যালবাম বের হয়েছে, পাশাপাশি তিনটি মিশ্র অ্যালবামে গান গেয়েছেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে। ‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে’খ্যাত এই শিল্পী ১৯ শে আগস্ট, ২০১৩ মৃত্যুবরণ করেন।


৯। কাঙালিনী সুফিয়াঃ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬১ সালে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দির অর্ন্তগত রামদিয়া গ্রামে। বাবার নাম- খোকন হালদার এবং মায়ের নাম- টুলু হালদার। ডাক নাম টুনি হালদার। মাত্র ১৪ বছর বয়সে গ্রাম্য একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।। ১৫ বছর বয়সে "সুধির হালদার" নামক একজন বাউলের সাথে তাঁর বিয়ে হয়।। কিন্তু স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়ায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ৭ বছর পর ১৭৭৮ সালে টুনি হালদার উস্তাদ হালিম বয়াতির শিস্যত্ব গ্রহন করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে ‘টুনি হালদার’ নাম পরিবর্তন করে ‘সুফিয়া খাতুন’ নাম ধারণ করেন। এরপর তিনি ফরিদপুর জেলার প্রখ্যাত বয়াতি এনায়েত আলী’র কাছেও গান চর্চা করেন। সুফিয়া খাতুন বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তৎকালীন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর ডি.জি. জনাব মুস্তফা মনোয়ার তাকে কাঙ্গালিনী উপাধি প্রদান করেন। সেই থেকে সুফিয়া খাতুন সারা বাংলাদেশে কাঙ্গালিনী সুফিয়া নামে পরিচিত হোন। কাঙ্গালিনী সুফিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল- তিনি উপস্থিত (Instant) গান রচনা করেন, সুর করেন এবং পরিবেশন করেন।। গান তৈরি ও পরিবেশনের জন্য তাঁর কোন প্রকার পূর্ব প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় না। অন্যান্য ফোক বা লোকসঙ্গীত শিল্পীদের হতে এটি হচ্ছে উনার প্রধান ব্যতিক্রম। কাঙ্গালিনী সুফিয়া ইংল্যান্ড, দক্ষিন কোরিয়া, কাতার, ইটালি, হংকং, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, চিন ও ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গান পরিবেশন করেছেন।। সঙ্গীতে তিনি এযাবৎ প্রায় ৩০টি জাতীয় ও ১০টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার লাভ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি উজ্জ্বল করেছেন।


১০। ফিরোজ সাঁইঃ ফিরোজ সাঁই (জন্ম ১৯৫৩-মৃত্যু ১৯৯৫) বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। সত্তুর ও আশির দশকে দেশীয় পপ সঙ্গীতের ধারায় তিনি ছিলেন পথিকৃত। লোকসঙ্গীত ও আধ্যাত্মিক ধারার গানকে পপসঙ্গীতে রূপান্তর করেছিলেন শিল্পী ফিরোজ সাঁই। তাঁর গাওয়া এক সেকেন্ডের নাই ভরসা কিংবা ইস্কুল খুইলাছে রে মওলা, ইস্কুল খুইলাছের মতো গানগুলো আজও শ্রোতাদের হৃদয়ে ছড়ায় সুরের অনুরণন। 'এক সেকেন্ডের নাই ভরসা বন্ধ হইবো রং তামাশা' এমন ভাবের গান গেয়ে মানব মনে জীবন মৃত্যুর বোধ জাগ্রত করেছেন ফিরোজ সাঁই। ১২ জানুয়ারি, ১৯৯৫ সালে শিল্পকলার একটি গানের অনুষ্ঠানে 'এক সেকেন্ডের নাই ভরসা' গানটি গাওয়ার সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ফিরোজ সাঁই।


১১। ফকির আলমগীরঃ ফকির আলমগীর বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী। ফকির আলমগীর ১৯৫০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষা আন্দোলনের স্মরণীয় দিনটিতে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার কালামৃধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মৌ: হাচেনউদ্দীন ফকির, মা বেগম হাবিবুন্নেছা। শিল্পী কালামৃধা গোবিন্দ হাইস্কুল থেকে ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করেন। গণ সঙ্গীত ও দেশীয় পপ সঙ্গীতে তার রয়েছে ব্যাপক অবদান। তিনি ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। ষাটের দশক থেকে তিনি বাংলা গান করছেন।বাংলাদেশের সব ঐতিহাসিক আন্দোলনে তিনি তাঁর গান দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছেন। ৬৯ এর গণ অভ্যুথান,৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০ এর সামরিক শাসন বিরোধী গণ আন্দোলনে তিনি সামিল হয়েছিলেন তার গানের ঝাঁপি নিয়ে। আজম খান, ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই ও পিলু মমতাজ- ৭০ দশকে তাদের পরিচিতি ছিল পঞ্চরত্ন হিসেবে।

আজ এখানেই ইতি টানি, তবে আরও খোঁজ করছি আমীরউদ্দিন, জালালউদ্দিন খাঁ, রাধারমণ প্রমুখদের সম্পর্কে, ইচ্ছা আছে আপনাদের সাথে ভবিষ্যতে এই ব্যাপারে আরও শেয়ার করার। কারো কাছে ইনফো থাকলে জানাবেন প্লিজ। আগামীতে ইচ্ছা আছে এর পরবর্তী প্রজন্মের কুদ্দুস বয়াতি, শেফালী ঘোষ, ফেরদৌসি রহমান, রথীন্দ্রনাথ রায়, ফরিদা পারভিন, দিলরুবা খানম, মুজিব পরদেশী, কিরন চন্দ্র রায়, বারী সিদ্দিকি, সেলিম চৌধুরী থেকে শুরু করে হালের কায়া, শিরীন, সন্দীপন, সালমা, রিঙ্কুদের নিয়ে কোন একটা লেখা লেখার।

তথ্যসূত্রঃ
http://bn.wikipedia.org/
Click This Link
Click This Link
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৩ রাত ৩:২৭
১৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×