মাঝে মাঝে কিছু সত্য চাপা পড়ে যায় বৈপরীত্যের মিথ্যা পরিচয়ে। যারা জিম করবেটের পুরো জীবনী জানেন না, তাদের কাছে করবেট একজন ঝানু বাঘ শিকারি। নির্মমভাবে বাঘ শিকার করে জগত বিখ্যাত হয়েছেন, এমনটাও ভাবা অস্বাভাবিক নয় কারো কারো পক্ষে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন, একজন প্রকৃতি এবং পশুপ্রেমী মানুষ ছিলেন জিম করবেট। জিম করবেট শুধুমাত্র মানুষ খেকো বাঘ শিকার করে বিখ্যাত হয়েছেন ইতিহাসে। তো কয়টি মানুষখেকো বাঘ শিকার করেছিলেন করবেট সাহেব? পাঁচ? দশ? জ্বী না, কমপক্ষে ২৫টি, মতান্তরে যে সংখ্যা ৩০-৩৫ এ গিয়ে দাঁড়ায়!
নাম শুনে জিম করবেট’কে ইংরেজ সাহেব মন হলেও উনার জন্ম কিন্তু নৈনিতালে, যদিও বংশগতভাবে আইরিশ। ১৮৭৫ সালে জিম করবেটের জন্ম হয়, পিতা ক্রিস্টোফার গার্নি ছিলেন ইংরেজ সরকারের একজন সরকারী চাকুরে। করবেট নৈনিতালের স্কুলে লেখাপড়া করেন। শীতকালে নৈনিতালে প্রচণ্ড শীতের কারণে করবেটের বাবা তখনকার বহুল প্রচলিত নিয়মানুযায়ী নৈনিতাল থেকে ১৫ মাইল দূরে তেহরি রাজ্যের অন্তর্গত কালাধুঙ্গি নামক গ্রামে জমিজমা নিয়ে দ্বিতীয় আরেকটি আবাস গড়ে তোলেন শীতকালীন সময়ের জন্য। আর এই দুই আবাসস্থল পরবর্তীতে জিম করবেটের শিকারি হয়ে ওঠার পেছনে বিশাল ভূমিকা পালন করে।
১৮৯৫ সালে জিম করবেট বেঙ্গল অ্যান্ড নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে সময়-শর্তহীন কাজ নেন। রেলওয়ে ইঞ্জিনের জন্য তখন খনিজ কয়লার সাথে কাঠও ব্যবহার করা হত। সেই কাঠ কাটানো ও সরবরাহের জন্য করবেট তখন সংলগ্ন এলাকার ভাবরের জঙ্গলে। এভাবে বেশ কিছুদিন কাজ করার পর একে একে ফুয়েল ইন্সপেক্টর, মালগাড়ির গার্ড, সহকারী গুদামরক্ষক, সহকারী ষ্টেশনমাস্টার ইত্যকার নানাবিধ কাজে নিযুক্ত হন। সবশেষে ব্রডগেজ থেকে মিটারগেজে মাল চালানোর কন্ট্রাক্টরির কাজ পান এবং সুনামের সাথে সুদীর্ঘ একুশ বছর এই কাজ করে ১৯১৫/১৬ সালের দিকে অবসর গ্রহণ করেন। এই কর্মজীবনের মাঝেই তিনি অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। তার জীবনের প্রথম নরখাদক বাঘ, চম্পাবতের বাঘিনী’কে মারেন ১৯০৭ সালে। ১৯৩৮ সালে যেই নরখাদক শিকার শেষ হয় ‘থাক্’র বাঘিনী’কে বধের মাধ্যমে।
বাঘ সম্পর্কে আমাদের সাধারণের ধারণা বাঘ মানুষ দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে, আসলে বিশেষজ্ঞরা বলেন শুধুমাত্র মানুষখেকো বাঘই মানুষ দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কারণ, বনের নিয়ম হল নিজের খাদ্য না হলে সেই প্রাণীকে বনের পশু এড়িয়ে চলে যাবে, কোন হামলা-ঝামেলা ছাড়াই। তো বাঘের খাবার যখন বনে পাওয়া যায় না, সেই খাদ্যাভাবের সময়ে বাঘ বন ছেড়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে হামলা করে বসে মানুষকে; আর একবার মানুষের মাংসের স্বাদ পেলে কথা নেই, সেই বাঘ হয়ে ওঠে নরখাদক। আর এই নরখাদক বাঘের আতঙ্কে তখন মানুষের জীবন হয়ে ওঠে বিপদসঙ্কুল।
কথায় আছে, বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা... কেন? কারণ বাঘের থাবায় আছে মারাত্মক বিষ, এই বিষাক্ত থাবা দিয়ে একবার আঁচড় দিয়ে দিলে গ্যাংগ্রিন হয়ে মানুষ মৃত্যুর কোলে পর্যন্ত ঢলে পড়ে। তার উপর বাঘটি যদি হয় মানুষ খেকো, তাহলে কথাই নেই। ভারতের কেদার-বদ্রিনাথ তীর্থে দীর্ঘ ৭/৮ বছর ধরে প্রায় ৫২৫ জন মানুষকে হত্যা করেছিল মাত্র দুইটি চিতাবাঘ! আর এই চিতাদুটি’কে হত্যা কে করেছিল? ধারণা করতে পারেন? জ্বী, উনার নাম জিম করবেট।
মানুষখেকো বাঘ মারাটা কিন্তু সবচেয়ে দুঃসাহসিক আর ঝুঁকিপূর্ণ শিকারগুলোর একটি। একজন অভিজ্ঞ সাপুড়েও যেমন বিষধর সাপ মারতে গিয়ে নিজে মারা যেতে পারেন, তারচেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশী এই সম্ভাবনা রয়েছে মানুষখেকো বাঘ মারতে যাওয়ার বেলায়। জিম করবেট এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন, বারবার এই বিপদসঙ্কুল শিকার তিনি শেষ করেছেন দেহে প্রাণখানি অক্ষত রেখে। মানুষখেকো বাঘ মারা অবশ্যই সাহসের কাজ, কিন্তু শুধু সাহসে এই কম্ম সম্পন্ন হওয়ার নয়। এর জন্য দরকার অতি উচ্চমানের ইন্দ্রিয় বোধ সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। আর এখানেই জিম করবেট আরও অনেকের চেয়ে অনন্য ছিলেন। তার ছিল সদা জাগ্রত চক্ষুকর্ণ। কোন জায়গায় হয়ত কোন একটা কাঁটার আগায় হলদে একটু লোমের খোঁজ, কোথাও কোন ঝোপের আড়ালে এক টুকরো সুতো, কখনো বা জঙ্গলের রাস্তার কোন কোণে এক ফোঁটা রক্তের চিহ্ন; আর তা থেকেই মানুষখেকোর অনুসন্ধান এবং শেষে শিকারে ঘায়েল করা... এই ছিল জিম করবেট।
জিম করবেটের বাল্যকাল কেটেছে হিমালয়ের কোল ঘেঁষে, যেখানে বিচরণ নানান পশু-পাখি, বাঘ-হরিন-ভল্লুকের আনাগোনা ছিল অহরহ। আজ থেকে শত বছর আগে লোকালয়ের কাছে বনে বিচরণ ছিল এইসব প্রাণীদের। আর সেই বাল্যকাল থেকেই জিম করবেট এসব পশুপাখীদের গতিবিধি, তাদের জীবনাচার, তাদের নানান ধরণের ডাকের অর্থ আয়ত্ব করেছিলেন। এর সাথে ছিল তার অপরিসীম ধৈর্য আর কষ্ট সহিষ্ণুতা। আর তাইতো প্রায় অসম্ভব একের পর এক শিকার তাকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।
চিতাবাঘ আমাদের অনেক পুরানো শিকারি, আমাদের পূর্বপুরুষের মাথার খুলির ফসিলে চিতাবাঘের দাঁতের চিহ্ন সেই স্বাক্ষ্যই দেয়। উনিশ শতকে ভারতের কুমায়ুনের পানারের নরখাদক ছিল এমনই এক চিতাবাঘ। জিম করবেট ধারণা করেন, কোন শিকারীর গুলিতে আহত হওয়ার দরুন এর স্বাভাবিক শিকার ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং ফলস্বরূপ চিতাবাঘটি হয়ে ওঠে মানুষখেকো। সরকারী হিসাব অনুযায়ী চার শতাধিক মানুষ তার শিকারে পরিণত হয়। অবশেষে ১৯১০ সালে জিম করবেট এই নরখাদককে হত্যা করতে সক্ষম হন।
তবে ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে আছে রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো। টানা সাত/আট বছর ধরে চলেছে এর অত্যাচার, তার ভয়ে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই অলিখিত এক অবরোধ জারি হত পুরো জনপদ জুড়ে। পুরো বিশাল জনপদটা পরিণত হত এক মৃত্যুপুরীতে। এই নরপিশাচটিকে মারতে সবচেয়ে বেগ পেতে হয়েছিল জিম করবেটকে। ফাঁদ পেতে কিংবা পটাশিয়াম সায়ানাইড বিষ মিশিয়ে তৈরি মড়িতেও একে বশে আনা যায় নাই। এই ধূর্ত চিতাবাঘ সম্পর্কে জিম করবেটের স্বীকারোক্তি, “একসময় আমিও সবার মত বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম চিতাবাঘটার শরীরটা পশুর আর মাথাটা শয়তানের।”
এর ধূর্ততার নমুনা হিসেবে একটি ঘটনা বলা যেতে পারে। রুদ্রপ্রয়াগ কিন্তু দুটো পবিত্র নদীর সঙ্গমস্থল, হিন্দু শ্রাইন বা তীর্থ ভূমি। ফি বছর বহুলোকের সমাগম ঘটে এখানে। একবার তীর্থযাত্রীদের এক দল মানুষখেকোর এলাকার কাছ দিয়েই যাচ্ছিল। পথে সন্ধ্যা হয়ে এলে সবাই বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নিলো। গাঁয়ের মোড়ল হুঁশিয়ার করে দিলো বাঘটার সম্বন্ধে, বললো সামনের কোন গাঁয়ে আশ্রয় নিতে। তীর্থযাত্রীদের মধ্যে একজন পুরুত ঠাকুর ছিলেন। তিনি বললেন পায়ে হেঁটে এতদূর আসায় সবাই ক্লান্ত, তাছাড়া এতগুলো লোকের মধ্যে বাঘ আসার সাহস পাবে না। এদিকে তীর্থযাত্রীদের সবার একসঙ্গে কোথাও থাকবার মতন জায়গাও ছিলো না। পাছে খোলা মাঠে থাকতে দিতে হয় এই ভেবে মোড়ল তার গোলাঘরেই সাবাইকে রাত কাটিয়ে যাবার প্রস্তাব দিলেন। এই প্রস্তাবে খুশি হয়ে পুরুত ঠাকুর আশীর্বাদ করে বললেন বাঘ যদি আসে তাহলে সেটাই হবে বাঘের শেষ দিন। রাতে খাবার শেষে ভক্তবৃন্দেরা সবাই পুরুত ঠাকুরকে ঘিরে গোল হয়ে শুয়ে পড়লেন। পরদিন খুব সকালে পুরুত ঠাকুরের দেখা মিললো না, সবাই মনে করেছিলো প্রাতকৃত্য সারতেই হয়ত তিনি বাইরে গেছেন। কিন্তু বড় বড় ফোঁটায় রক্তের ধারা দেখে সবাই নিঃসন্দেহ হলো এটা কার কাজ। এতগুলো লোককে ডিঙিয়ে ঠাকুরকে বাঘে খাবার কথাই ছিলো না। বাঘে ধরলে সবচেয়ে কিনারার লোকটিকেই ধরবার কথা ছিলো। কাউকে কিছু টের না পেতে দিয়ে কিভাবে এত বড় একজন লোককে উঠিয়ে নিয়ে গেলো সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার।
বাঘরূপী এই পিশাচটিকে করবেট হত্যা করেন ১৯২৬ সালে। জিম করবেট দীর্ঘদিন এর পেছনে লেগে থেকে যে বিষয়টি লক্ষ্য করলেন তা ছিল, চিতা বাঘটি অলকনন্দা নদীর এপারে একদিন শিকার করে তো পরের শিকার হয় ওপারে দশ মাইল দূরের কোন লোকালয়ে। তাই তাকে চট করে হদিশ করা ছিল খুবই দুরহ ব্যাপার। কিন্তু করবেটের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। একদিন এক জায়াগায় বাঘটি একটি মানুষ মারার পরপর করবেট সে এলাকায় গেলেন এবং অলকনন্দা’র তীর ধরে পর্যবেক্ষণ করে বুঝলেন বাঘটি অলকনন্দা পাড়ি দিয়ে পালায়নি। তখন সবাই ধারনা করত বাঘটি নদী সাঁতরে পাড়ি দেয়, কিন্তু করবেটের ধারণা ছিল ভিন্ন। কেননা অলকনন্দা নদীর ফেনিল জলরাশি তার খরস্রোতা প্রবাহের যে পরিচয় দিচ্ছিল, তাতে সহজেই অনুমেয় এই তীব্র স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে নদী পার হওয়া দুরূহ নয় শুধু, প্রায় অসম্ভব। আর এই থেকে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, বাঘটি নদীর উপর যে পুল ছিল তা দিয়েই পারাপার হয়। তিনি পুলের মুখে ওত পেতে থাকেন এবং ফলস্বরূপ এই ইতিহাসখ্যাত বাঘটিকে ধরাশায়ী করতে সক্ষম হন।
আচ্ছা এবারে আসি করবেটের নিজের ভাষায় সবচাইতে ভয়ংকর মানুষখেকোর গল্পে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতের উত্তরাঞ্চলের জঙ্গলেই নেপাল সীমান্তের কাছাকাছি কোথাও জন্মেছিলো সে। চিন্তা করুন কোন প্রাণীকে হত্যার জন্য সেনাবাহিনী ডাকতে হয়!!! কি ভয়ংকর ছিল সেই প্রাণীটি!!! ভয়ংকর নয় শুধু, ছিল মানবজাতীর জন্য অভিশাপ। শিকারীর গুলিতে শ্বদন্ত ভেঙ্গে যাওয়ায় স্বাভাবিক ভাবে শিকার করতে পারতো না সে। ফলশ্রুতিতে মানুষ শিকারের দিকে ঝুঁকতে হয় তাকে। ক্রমেই এ কাজে সিদ্ধহস্ত হয়ে ওঠে সে। প্রায় শ’দুয়েক মানুষ মারার পর টনক নড়ে নেপাল সরকারের এবং তলব করা হয় সেনাবাহিনীকে; কেননা সকল শিকারি ব্যর্থ হয়েছিলেন এই মানুষখেকোকে থামাতে। সেনাবাহিনী তাকে ঘায়েল করতে না পারলেও নেপাল ছাড়া করতে পেরেছিল, আর ফলস্বরূপ নেপাল-ভারত সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম ‘চম্পাবত’ এ সে তার শিকার শুরু করে দেয়। পরবর্তীতে এই বাঘিনী ‘চম্পাবতের বাঘিনী’ নামে ইতিহাস বিখ্যাত হয়ে যায়। এর ভয়ে পুরুষ মানুষ দরজা খুলে কাজে যাবার সাহস পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিল। কারণ এ শুধু সন্ধ্যা বা রাতে নয়, দিনের বেলাও মানুষ শিকার করে বেড়াত। অবশেষে জিম করবেট ১৯০৭ সালে বাঘটিকে শিকার করতে সক্ষম হন। তবে তার আগে শুধুমাত্র সরকারী হিসেবেই এই বাঘিনী প্রায় সাড়ে চারশত মানুষ হত্যা করেছিল।
এরকম মানুষখেকো বাঘ প্রায় ৩০/৩৫টি শিকার করে জিম করবেট হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে জিম করবেটের প্রথম বই ‘ম্যান ইটার্স অফ কুমায়ুন’ বের হবার সাথে সাথে বিশ্বখ্যাতি প্রাপ্ত হন এই মহান শিকারী। এরপর প্রকাশকের তাগিদে একে একে লিখেন ‘ম্যান ইটিং লেপার্ড অফ রুদ্রপ্রয়াগ’, ‘মাই ইন্ডিয়া’, ‘জাঙ্গল লোর’, ‘দ্যা টেম্পল টাইগার অ্যান্ড মোর ম্যানইটার্স অফ কুমায়ুন’ প্রভৃতি গ্রন্থ। জিম করবেট ছিলেন রক্ষণশীলধর্মী শিকারী, তিনি মানবতার খাতিরে বাঘ শিকার করেছিলেন, শিকার করেছিলেন শুধুমাত্র ভয়ংকর প্রাণঘাতী সব মানুষখেকো বাঘেদের। এই মহান শিকারী ১৯৫৫ সালে কেনিয়ার নিয়েরি শহরে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানকার সেন্ট পিটার্স অ্যারলিকান চার্চ সিমেট্রিতে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০১৫ বিকাল ৩:২৫