আগের পর্বঃ যাত্রা শুরুর আগের গল্প (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০১)
ঢাকা থেকে যাত্রা
ঈদের দিন রাতে আগে ঢাকা শহর থাকতো ভূতুড়ে ফাঁকা, কিন্তু এখন ঈদের দিন বিকেলের পর থেকে শহরের নানান সড়কেই লম্বা গাড়ীর সারি দেখা যায়। তাই বাসা থেকে একটু আগে আগেই রওনা হয়ে গেলাম পান্থপথের শ্যামলী বাস কাউন্টারে। সবার আগে আমি পৌঁছলাম, আমার পরে দলের বাকী তিনজন চলে আসলো, ঘড়িতে তখনো বাস আসার প্রায় আধঘন্টার বেশী বাকী। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাত ১০:০০টার শ্যামলী পরিবহণের কলকাতাগামী বাস আরামবাগ কাউন্টার হতে ছেড়ে এসে আমাদের চারজনের দলকে ঠিক সাড়ে দশটায় পান্থপথ কাউন্টার হতে তুলে নিল। ফাঁকা রাস্তা এবং কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই ভোররাত সাড়ে চারটার আগেই পৌঁছে গেলাম বেনাপোল।
কিন্তু বরাবরের ন্যায় শ্যামলী পরিবহণের অজানা কোন কারনে, উভয় পাশের ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস ফর্মালিটিস শেষ পেট্রাপোল থেকে গাড়ী ছাড়ল ভারতীয় সময় সকাল নয়টায়। এই পাঁচঘন্টা সময় কাটানো বেনাপোল বর্ডারে খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। ভালো একটা ওয়েটিং রুম বা কম্পাউন্ড কি তৈরী করা যায় না। প্রয়োজনে তার জন্য ভ্রমণার্থীরা পে করবে, কিন্তু এটার খুব দরকার। কয়েকটা ওয়াশরুম, ক্যান্টিন বা ফুড কোর্ট, নামাজের জায়গা, সাথে শ পাঁচেক ওয়েটিং চেয়ার দিয়ে একটা কম্পাউন্ড করে সেখানে টাকার বিনিময়ে ব্যবহারে ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সেদিকে কখনো চিন্তা হবে না। যাই হোক, এই পাঁচঘন্টায় কোনমত নিজেদেরকে একটু ভদ্রস্থ করে নিয়ে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। এরপর পেট্রাপোল থেকে কলকাতা’র ৮৪ কিলোমিটার পথ পেরুতে লেগে গেল প্রায় ০৪-০৫ ঘন্টা! আমি বুঝি না বর্ডার হতে ছেড়ে এতটুকু রাস্তার জন্য মাঝপথে আবার কেন বিরতি দেয়া। আর এইসব হ্যাপা থেকে বাঁচতে সেবারই ছিলো আমার সড়ক পথে ভারতে যাওয়া। এরপর টাকা একটু বেশী লাগলেও আমি রেল বা বিমানে ভারত যাওয়ার পক্ষে। অন্য খরচে লাগাম টেনে, ছাড় দিয়ে হলেও ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা বিমান বা রেলে যাওয়া অনেক শ্রেয়।
চলে এলাম কলকাতা
কলকাতা নিউমার্কেট এসে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুর একটা। আগে থেকে কলকাতায় একটা হোটেলে প্রি বুকিং দেয়া ছিলো, সেটা ক্যান্সেল করে মারকুইস স্ট্রেটের "হোটেল আফসা"য় চেকইন করলাম। ব্যাগপত্র রেখে ফ্রেশ হয়ে "ধানসিঁড়ি রেস্তোরাঁ"য় লাঞ্চ করে ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে চলে এলাম আলিপুর। আমাদের দলের এই অংশে রয়েছে আমার আগের ট্রিপের সেই অধ্যাপক স্যার এবং উনার স্ত্রী। স্যারের আগ্রহে এদিন বিকেলের প্রোগ্রাম ছিলো আলিপুর চিড়িয়াখানা ভ্রমণ আর সন্ধ্যাটা যথারীতে কলকাতায় আমার প্রিয় জায়গা “প্রিন্সেপ ঘাট” এ।
আলিপুর চিড়িয়াখানায় বিকেলবেলা
১৮০০ সালে বাংলার তদনীন্তন গভর্নর-জেনারেল আর্থার ওয়েলেসলি কলকাতার নিকটস্থ ব্যারাকপুরে তাঁর গ্রীষ্মাবাসে ভারতীয় প্রাকৃতিক ইতিহাস প্রকল্পের অঙ্গ হিসেবে একটি ছোটো পশু উদ্যান গড়ে তোলেন। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন শহরে চিড়িয়াখানা স্থাপিত হতে থাকলে, কলকাতার ব্রিটিশ সম্প্রদায়ও এই পশু উদ্যানটিকে একটি বিধিবদ্ধ চিড়িয়াখানার রূপ দেওয়ার কথা ভাবতে থাকেন। ১৮৪১ সালের জুলাই মাসে ক্যালকাটা জার্নাল অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি পত্রিকায় কলকাতায় চিড়িয়াখানা স্থাপনের পক্ষে সওয়াল করা হয়। ১৮৭৩ সালে লেফটানেন্ট-গভর্নর স্যার রিচার্ড টেম্পল কলকাতায় একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের প্রস্তাব দেন। সরকার এশিয়াটিক সোসাইটি ও এগ্রি-হর্টিকালচার সোসাইটিকে যৌথভাবে চিড়িয়াখানা স্থাপনের জমি প্রদান করে। ১৮৭৬ সালের ১ জানুয়ারি প্রিন্স অফ ওয়েলস সপ্তম এডওয়ার্ড আনুষ্ঠানিকভাবে চিড়িয়াখানাটির উদ্বোধন করেন কলকাতার অভিজাত শহরতলি আলিপুর অঞ্চলে।
আলিপুর চিড়িয়াখানার আয়তন ৪৫ একর। গত পঞ্চাশ বছর এই চিড়িয়াখানার বিস্তার সম্ভব হয়নি। এখানে একটি সরীসৃপ ভবন, একটি বনমানুষ ভবন, একটি হস্তীভবন ও একটি প্যান্থার ভবন রয়েছে। প্যান্থার ভবনের পিছনে বাঘ ও সিংহের জন্য ওপেন এয়ার এনক্লোজার রয়েছে। একটি আলাদা শিশুদের চিড়িয়াখানাও রয়েছে। চিড়িয়াখানার মাঝের জলাশয়ে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে।চিড়িয়াখানার সম্মুখস্থ রাস্তার উল্টোদিকে চিড়িয়াখানা অণুমোদিত কলকাতা অ্যাকোরিয়াম অবস্থিত। এই আলিপুর চিড়িয়াখানায় যে সকল প্রাণীর দেখা মেলে তার মধ্যে রয়েছে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, আফ্রিকান সিংহ, জাগুয়ার, জলহস্তী, ভারতীয় একশৃঙ্গ গণ্ডার, রেটিকুলেটেড জিরাফ, গ্র্যান্ট'স জেব্রা, এমু, ড্রোমেডারি ক্যামেল ও ভারতীয় হাতি। আগে প্যান্থেরা হাইব্রিড ও জায়ান্ট এল্যান্ডও ছিল। এছাড়া চিড়িয়াখানায় প্রচুর আকর্ষণীয় পাখি রয়েছে। এর মধ্যে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় থাকা ম্যাকাও প্রজাতির বৃহদাকার তোতা, কনুর, লোরি ও লোরিকিট রয়েছে। আর রয়েছে টৌরাকো ও ধনেশ, সোনালি মথুরা, লেডি আমহার্স্ট'স পেজেন্ট ও সোয়াইনহো'স পেজেন্ট। কয়েকটি এমু, ক্যাসাওয়ারি ও অস্ট্রিচও রয়েছে।
ভালো লাগার জায়গা "প্রিন্সেপ ঘাট" এ সন্ধ্যা-রাত্রি
সারাটা বিকেল আলিপুর চিড়িয়াখানায় কাটিয়ে সন্ধ্যের আগে আগে চলাম আমার পছন্দের জায়গা “জর্জ প্রিন্সেপ মেমোরিয়াল ঘাট"। প্রিন্সেপ ঘাট হল কলকাতায় হুগলি নদীর তীরে ব্রিটিশ যুগে নির্মিত একটি ঘাট। প্রিন্সেপ ঘাটটি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ওয়াটার গেট ও সেন্ট জর্জেস গেটের মাঝে অবস্থিত। এটি ১৮৪১ সালে নির্মিত হয় এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ইতিহাসবিদ জেমস প্রিন্সেপের নামে নামাঙ্কিত। ঘাটের মূল গ্রিকো-গথিক স্থাপত্যটি ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পূর্ত মন্ত্রক সংস্কার করেছে।
প্রিন্সেপ ঘাট কলকাতার সচেয়ে পুরনো দর্শনীয় স্থানগুলির একটি যেখানে সপ্তাহান্তে অনেক মানুষ বেড়াতে আসেন। নদীর গা ঘেঁষে রাস্তায় খাবারের দোকান রয়েছে। ঘাটের কাছে চল্লিশ বছরের পুরনো আইসক্রিম ও ফাস্ট ফুড বিক্রির একটি কেন্দ্র আছে। তরুণদের মধ্যে এই কেন্দ্রটি বেশ জনপ্রিয়। এখান থেকে অনেকে নদীতে নৌকায় প্রমোদভ্রমণে যান। ২০১২ সালের ২৪ মে প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাজে কদমতলা ঘাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পথে সৌন্দর্যায়িত নদীতীরের উদ্বোধন করা হয়েছে। এই অংশটি আলোকমালা, বাগান, প্রমোদপথ, ফোয়ারা দিয়ে সাজানো হয়েছে এবং এই অংশের ঘাটগুলির সংস্কার করা হয়েছে। রাতের বেলায় এখানকার গ্রিকো-গথিক স্থাপত্যটি আমার কাছে খুবই প্রিয়, আর ঘাসের লনে ঘাসের তৈরী হাতী’র অবয়ব তিনটি ভীষণ ভালো লাগে।
প্রিন্সেপ ঘাটে পুরো সন্ধ্যাটা কাটিয়ে আকাশের বুকে রাতের দখল চলে আসার পর আমরা সেখান থেকে চলে এলাম কলকাতা নিউমার্কেটে। টুকটাক প্রয়োজনীয় কেনাকাটার ফাঁকে চললো স্ট্রিট ফুড খাওয়াঃ পানিপুরি, নিম্বুপানি, জিরাপানি, আইসক্রিম, চানাচুর মাখা.... রাতে নিউমার্কেট এলাকায় কেনাকাটা শেষে হোটেলে ফিরলাম নয়টার পরে। ঐদিকে ঢাকায় তখন দ্বিতীয় দল বাস কাউন্টার অভিমুখী। রাতের খাওয়া শেষে প্রথম দল যখন আরামের ঘুম দেয়ার জন্য প্রস্তুত, ছয় সদস্যের দ্বিতীয় দল তখন বাসে, কলকাতার উদ্দেশ্যে। পরের দিন দুই দলের দেখা হবে কলকাতা বিমানবন্দরে। কিন্তু তখনো জানা ছিলো না, কি ভোগান্তি অপেক্ষা করছে পরের দিনের জন্য।
ভ্রমণকালঃ সেপ্টেম্বর ২০১৬
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর, ২০১৬ এর সকল পর্বঃ
* যাত্রা শুরুর আগের গল্প (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০১)
* কলকাতায় অপেক্ষা... (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০২)
এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৫:০৭