আগের দিনের ফিল্মি উত্তেজনা আর টেনশন দূর করতে একটা আরামের ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হয়ে দিনটা শুরু করেছিলাম ভালো মুডে। কিন্তু কে জানতো এই ট্যুরে প্যারা আমার আর দলের পিছু ছাড়বে না। সকালের নাস্তা সবাই সময়মতো সেরে নিয়ে হোটেলের লবীতে অপেক্ষায় ছিলাম। ড্রাইভার গাড়ী নিয়ে চলে এলো, টেম্পো ট্রাভেলার, ভারতের খুবই জনপ্রিয় একটা টুরিস্ট ভেহিকেল। কুরবানী ঈদের ছুটিতে এই ট্যুরে যখন দিয়েছি, দিল্লীতে প্রায় ৩৭/৩৮ ডিগ্রীর উপরে টেম্পারেচার। তাই ককশিটের আইসবক্স কিনে তাতে বরফ দিয়ে পানির বোতল, জুসের প্যাকেট আর চললেট বার রেখে দিলাম। কিন্তু গাড়ীর যে কন্ডিশন ভালো না তা কিছুটা সন্দেহ হলো চেহার সুরত দেখে, তেমন একটা পছন্দ হলো না। যাই হোক সবাইকে তাড়া দিলাম, গাড়ীতে ওঠার।
ঐদিকে আমার ছোট ভাই আর দুই আত্মীয় কেরলবাগ এর হোটেলের সামনের রাস্তা হতে সস্তা দামের সানগ্লাস কিনে ১০০ রুপীর বদলে ১০০ ডলারের নোট দিয়ে হাঁটা শুরু করেছিলো; ভাগ্য ভালো আরেক আত্মীয় সেটা দেখে সামলেছে। এই নিয়ে সবাই হাসি তামাশায় খুব ব্যস্ত। সবাইকে তাড়া দিয়ে গাড়ীতে উঠালাম। আজ এই হোটেল থেকে চেক আউট করে দিল্লী থেকে প্রস্থান, দু'রাত পরে আবার ফিরবো এই হোটেলেই। যেহেতু খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের ট্যুর ছিলো এটা, তাই প্ল্যান ছিলো দিল্লীর মূল কিছু ঐতিহাসিক স্থান শুধু দিল্লীতে দেখা হবে যার কিছু আজকের সকালে, বাকীটা ফেরার দিনের ফ্লাইটের আগে। সেই প্ল্যান মোতাবেক আজকের দর্শন তালিকায় ছিলো বিড়লা মন্দির, সেখান থেকে রাজঘাট গান্ধী মেমোরিয়াল হয়ে লালকেল্লা। সেখান থেকে সোজা আগ্রা, হাতে সময় থাকলে বিকেল বেলা আগ্রা ফোর্ট দেখা। পরেরদিন ভোরবেলা তাজমহল দর্শন করে আগ্রা থেকে সোজা ফাতেহপুর সিক্রি।
কিন্তু দলের সবাইকে বিড়লা মন্দির নিয়ে গিয়ে পড়লাম বিপদে, আধাঘন্টা সময় দিয়েছলাম সবাইকে বিড়লা মন্দির দেখতে, সবাই নিজেদের মত করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলাদা হয়ে গেল। তাদের একত্রে করে গাড়ীতে তুলতে এক ঘন্টা লেগে গেল অতিরিক্ত। ভারতের ধনাঢ্য "বিড়লা পরিবার" এর অর্থায়নে নির্মিত দিল্লীর লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির দিল্লিতে নির্মিত প্রথম বৃহৎ হিন্দু মন্দির। এই মন্দিরটি ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৯ সাল সময়কাল জুড়ে জুগল কিশোর বিড়লা'র অর্থায়নে নির্মিত হয়েছিলো এবং এর উদ্বোধন করেন মহাত্মা গান্ধী। মন্দির এর পুরো কম্পাউন্ডটি ৭.৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। এখানে অনেকগুলি উপাসনালয়, ফোয়ারা এবং হিন্দু ও জাতীয়তাবাদী ভাস্কর্য সহ একটি বড় বাগান এবং বক্তৃতার জন্য গীতা ভবনও রয়েছে। মন্দিরটি দিল্লির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ, হাজারো দর্শনার্থী সারা বছর এখানে ভ্রমণ অথবা ধর্মীয় প্রার্থনার জন্য এসে থাকেন। তবে জন্মাষ্টমী এবং দীপাবলির উৎসবে সবচাইতে বেশী ভক্তকে এখানে জড়ো হতে দেখা যায়।
এখানকার কিছুটা দেরী হওয়া কাভার হয়ে গেল লালকেল্লা গিয়ে, সকালের কড়া রোদে সবাই এত্ত বিশাল কেল্লায় খুব একটা দেরী করলো না, সময়ের আগেই সবাই গাড়ীতে উঠে বসেছিলো। তবে বিড়লা মন্দির দেখে ফেরার সময় রাজঘাট গান্ধী মেমোরিয়াল এ গাড়ি থামানো হলো মিনিট দশেকের জন্য। দু'তিন জন ছাড়া আর কেউ আগ্রহ দেখালো না সেখানে ঢুঁ মারার, আমিও মনে মনে খুশীই হলাম, না হলে আবার সবাইকে ধরে ধরে ডেকে নিয়ে এসে গাড়ীতে তুলতে হতো। পুরো ট্যুরেই এটা ছিলো আমার মূল কাজ যেন।

রাজ ঘাট মূলত পুরানো দিল্লি তথা শাহজাহানাবাদ এর একটি ঐতিহাসিক ঘাটের নাম ছিল। মহাত্মা গান্ধীকে উৎসর্গ করা এই স্মৃতিসৌধ এলাকাটি সেই পুরানো ঘাট থেকে খুব একটা দূরে নয়; তাই এই স্মৃতিসৌধ এলাকাকে রাজঘাট বলা হয়। ১৯৪৮ সালের ৩১ জানুয়ারী এখানেই মহাত্মা গান্ধীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান হয়েছিলো। পরবর্তীতে গান্ধীজির দর্শন এবং বিনয়ী জীবনযাপনের অনুশীলনের সাথে মিল রেখে ভানু জি ভুটা দ্বারা ডিজাইন করা একটি কালো মার্বেল পাথরের বর্গাকার সাধারণ স্মৃতিসৌধ এই জায়গায় তৈরি করা হয়। মার্বেল প্ল্যাটফর্মের উপরে, একটি কাঁচের ফ্রেমে ঘেরা একটি চিরন্তন শিখা অবিরাম জ্বলতে থাকে, দিনরাত। পাথরের তৈরি একটি ফুটপাথ প্রবেশপথে থেকে স্মৃতিসৌধের দিকে চলে গেছে, পাথরের পথের দুপাশে সবুজ লন রয়েছে; যার চারিপাশে একটি প্রাচীর দ্বারা ঘেরা আর ।
রাজ ঘাটের আশেপাশে বিখ্যাত ভারতীয় নেতা এবং ব্যক্তিত্বদের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিসৌধ রয়েছে যাদের মধ্যে অন্যতম হলঃ
বিজয় ঘাট (লাল বাহাদুর শাস্ত্রী'র সমাধি)
শান্তিবন (পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু'র সমাধি)
শক্তি স্থল (ইন্দিরা গান্ধী'র সমাধি)
বীর ভূমি (রাজীব গান্ধী'র সমাধি)
কর্মভূমি (শঙ্কর দয়াল শর্মা'র সমাধি)
রাষ্ট্রীয় স্মৃতি স্থান (অটল বিহারী বাজপেয়ী'র সমাধি)
বছরের পর বছর ধরে, দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী সহ রাজ ঘাট এলাকায় অনেক উল্লেখযোগ্য ভারতীয় নেতাদের সমাধি নির্মিত হয়েছিল। 2018 সালে নির্মিত অটল বিহারী বাজপেয়ীর সমাধি রাষ্ট্রীয় স্মৃতি স্থল হল রাজ ঘাট এলাকার সর্বশেষ সংযোজন।
লালকেল্লা হতে বের হতে হতে ঘড়িতে দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে। ড্রাইভারকে বললাম, পথে পরিবার নিয়ে খাওয়া যায় এমন ভালো মানের কোন রেস্টুরেন্টে গাড়ী থামাতে। আমার ভারত ভ্রমণে একমাত্র বদ ড্রাইভার ছিলো এই ব্যাটা। সে আমাদের গাড়ী নিয়ে থামালো যমুনা এক্সপ্রেস হাইওয়ের উপরে থাকা একমাত্র রেস্টুরেন্টটিতে (এখন আরও হয়েছে কি না জানা নেই)। আমি গাড়ী থেকে নামার সময় তাকে বললাম, হাইওয়েতে উঠার আগে কোন রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ে নাই? সে নির্বিকার!!! খাওয়া শেষে বিল দিতে গিয়ে বুঝলাম বাঁশ কেমন খাইছি; সেটাও কোন ব্যাপার ছিলো না, গাড়ীতে সবাই উঠে গেছি দেখি ড্রাইভার নাই!!!
তার খোঁজে রেস্টুরেন্ট এ ঢুকতে দেখি সে পাঁচশত রুপীর একটা নোট ক্যাশ কাউন্টার হতে বখশিশ নিয়ে পকেটে রাখছে। আমার মেজাজ চড়ে গেল সপ্তমে। যাই হোক গাড়ীতে উঠে গাড়ী ফের আগ্রা অভিমুখে যাত্রা শুরু করে কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা গেল গাড়ীর স্পীড বাড়ালেই এসি কাজ করছে না। এই আটত্রিশ ডিগ্রী গরমে মেজাজ সবার খারাপ হবে, আর আমার মেজাজ তো রেস্টুরেন্ট এর ঘটনা দেখেই সপ্তমে চড়ে ছিলো; এখন তা অষ্টম-নবম পেড়িয়ে এক্কেবারে দশমে উঠলো যেন। আমি ফোন লাগালাম আমার এজেন্টকে, সে আবার হিমাচলের নামকরা এজেন্ট। সে ব্যাটা ফোন ধরছে না। বিকেলের দিকে সে যখন ফোন ধরলো আমরা তখন আগ্রার পথে অনেকটা এগিয়ে এসেছি। তাকে পুরো ঘটনা জানালে সে দুঃখ প্রকাশ করে বললো, "এখন তো দিল্লী থেকে নতুন গাড়ী পাঠালেও তোমাদের একদিন অপেক্ষা করতে হবে; এতো কম সময়ের ট্রিপ, এটা তো সম্ভব না। কোন মত ম্যানেজ করে নাও।" এই ম্যানেজ করতে গিয়ে বদ ড্রাইভারকে নিয়ে পরে আরো ঝামেলা হয়েছে আমার, সেই গল্প সামনে আসবে। আপাতত আমরা চললাম আগ্রার পথে... ধীর গতিতেই, তাও এসি চলুক; নইলে দিল্লীর এই "কুত্তা মারা" গরমে সবাই মরে যাবো এক্কেবারে।
উৎসর্গঃ আমার ভারত ভ্রমণের এই সিরিজটি ব্লগার "কামরুন নাহার বীথি" আপাকে উৎসর্গ করছি। উনি আমার এই ট্যুরে ট্যুরমেট ছিলেন। গত পহেলা জানুয়ারী রাত এগারো ঘটিকায় বীথি আপা আল্লাহ্র ডাকে সারা দিয়ে পরপারে চলে গেছেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে। আল্লাহ্ তার শোকার্ত পরিবারকে এই শোক সইবার ধৈর্য দাণ করুন। আর আপাকে পরপারে আল্লাহ্ সকল গুনাহ (যদি থাকে) মাফ করে তার কবরে আজাব মাফ করুন এবং আখেরাতে বেহেশত নসীব করুন।
প্রথম পর্ব থেকে বীথি আপার এই ট্যুরে যুক্ত হওয়ার ঘটনাটা আবার তুলে ধরলামঃ
ঈদের কয়েকদিন আগে আমি কোন একটা কাজে নীলক্ষেত মোড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি, একটি অচেনা নাম্বার থেকে কল এলো, কল রিসিভ করতে অপরপাশ থেকে অচেনা কণ্ঠস্বর। আমাদের দলের সাথে যুক্ত হতে চায় এই ট্রিপে। “সামহোয়্যার ইন ব্লগ” এ তখন পর্যন্ত আমার পূর্বপরিচিত কেউ ছাড়া আর কারো সাথে পরিচয় ছিলো না। “সাদা মনের মানুষ” খ্যাত কামাল ভাই এর সাথে পরিচয় ভ্রমণ বাংলাদেশ থেকে। সেই কামাল ভাই এর কাছ থেকে খবর পেয়ে ফোন দিয়ে প্রিয় ব্লগার কামরুন নাহার বীথি আপা। উনি এবং ভাইয়া যুক্ত হতে চাচ্ছেন আমাদের সাথে। আমি একদিন সময় নিয়ে উনাকে কনফার্ম করলাম উনাদের যুক্ত হওয়ার ব্যাপারটা। এরপর উনাদের এয়ার টিকেট এর ব্যবস্থা করা হলো। দল গিয়ে দাড়ালো দশজনের। সিদ্ধান্ত হল চারজনের একটা দল ঈদের দিন রাতে রওনা হয়ে যাবো কলকাতার উদ্দেশ্যে। একদিন পরে বাকী ছয়জন রওনা হবে, যেহেতু কোরবানী ঈদের ছুটি, তাই অনেকেই সারাদিনের কোরবানীর হ্যাপা পোহানোর পর সেদিন রাতেই রওনা হতে রাজী হলো না। ফলে আমরা যে চারজন আগে রওনা হবো, তারা একরাত কলকাতা থেকে পরেরদিন সরাসরি বিমানবন্দর চলে যাবো। অপর দলও সরাসরি বেনাপোল বর্ডার হতে দমদম বিমানবন্দর চলে আসবে। এরপর ঢাকা থেকে সকলের কলকাতার বাসের টিকেট এবং আনুষাঙ্গিক কাজ শেষ করে অপেক্ষার পালা চলতে লাগলো….
ভ্রমণকালঃ সেপ্টেম্বর ২০১৬
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর, ২০১৬ এর সকল পর্বঃ
* যাত্রা শুরুর আগের গল্প (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০১)
* কলকাতায় অপেক্ষা... (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০২)
* ফ্লাইট মিসড তো ট্যুর ক্যান্সেলড... টেনশনিত অপেক্ষার শেষে (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০৩)
* আগ্রার পাণে যাত্রা (গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ট্যুর - পর্ব ০৪)
এক পোস্টে ভারত ভ্রমণের সকল পোস্টঃ বোকা মানুষের ভারত ভ্রমণ এর গল্পকথা
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০২৩ রাত ১১:৩৪