somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দূর অজানায় (ছোটগল্প)

০৭ ই মে, ২০২৫ রাত ১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



“ও ভাই, আপনের ট্যাকা নিয়া যান… ব্যবসা কইরা লাভ করছি না… বাড়তি ট্যাকা রাখুম ক্যান…”

মাছওয়ালার চেঁচামেচিতে আমাকে আবার ফিরে আসতে হল তার কাছে।

“ভাই রেখে দেন না দশটা টাকা আমি আপনাকে খুশী হয়ে দিচ্ছি…”

“ও ভাই, আমার থন যেই মাছ কিনে, আমি বিনা পয়সায় তারে মাছ কাইট্টা দেই… ধরেন আপনার ট্যাকা।” কথা বলে পাশের রাস্তায় থু করে একদলা থুথু ফেললো সে। আশেপাশের লোকজন আমাদের ঘটনা দেখছে, আমি লজ্জায় দশ টাকার নোটখানা তার কাছ থেকে নিয়ে সামনে হাঁটা ধরলাম। পথে কোন ভিখারীকে পেলে টাকাটা দিয়ে দিবো।

মাসের শেষ, পকেট প্রায় খালি, তাই আজ বাজারে সস্তায় তেলাপিয়া মাছ কিনলাম, দাম আসলো ১৯৩ টাকা। আলাদা করে মাছ কাটাতে হয় নাই, বিক্রেতাই মাছ কেটে দিলো। এমনিতে বাজারে মাছ কাটার আলাদা লোক আছে, বিশ ত্রিশ টাকা নিতো এই মাছ কাটতে। তাকে দু’টা একশত টাকার নোট দিয়েছিলাম, ভাঙ্গতি সাত টাকা না হয় সে রেখে দিক, মাছ কেটে দিলো কষ্ট করে। আশেপাশের লোকজনকে দেখাতেই কি না, কে জানে; সে আমাকে উলটো তিন টাকা ডিস্কাউন্ট দিয়ে দশ টাকা ফেরত দিলো। নিজের খারাপ সময়ের কারণেই কি না জানিনা, আমার প্রচন্ড রাগ লাগছে।

বাজার হতে বাসার দিকে হাঁটা শুরু করলাম, লক্ষ্য রাখলাম কোন ভিখারী পাওয়া যায় কি না। পুরো রাস্তায় কোন ভিখারী নেই! শহরে বুঝি আমার মত কিছু শিক্ষিত ভিখারী (যারা বেকার হয়ে সারাদিন চাকুরীর সন্ধানে ঘুরছে চারিদিকে) ছাড়া আর কোন ভিখারী নেই। আজ রোদের তেজ খুব বেশী, বেলা বারোটার মতো বাজে, আমি ইচ্ছে করেই দেরীতে বাজারে আসি, এসময় সবকিছুর দাম কিছুটা কমে পাওয়া যায়। হাঁটতে হাঁটতে বাসার সামনে চলে এসেছি তখন মনে হলো ধনেপাতা কেনা হয় নাই, আবার উলটো পথে হাঁটা শুরু করলাম, ফেরত পাওয়া সেই দশটাকায় না হয় ধনেপাতাই কেনা হোক।

লোকে বলে, বিয়ে করলে বউ নাকি ভাগ্য সাথে করে নিয়ে আসে। আমার বিয়ে হলো আজ তিনমাস, আমার বউ নিয়ে এসেছে দুর্ভাগ্য। ঈদের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে দেখি আমার বড় বোন আমার জন্য বিয়ের পাত্রী দেখে পছন্দ করে রেখেছে, বাবা-মা সহ সবাই রাজী। আমাকে কিছুই জানায় নাই, তার অবশ্য কারণ আছে। আমাকে বিয়ের কথা বললেই আমি বলি, এই মুহুর্তে বিয়েশাদীর ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছি না, একটু গুছিয়ে নেই। বিগত পাঁচ বছর হতে চললো, আমি ঢাকা শহরে আছি। বেসরকারী একটা কোম্পানীর ফ্যাক্টরিতে পারচেজ ডিপার্টমেন্টে জুনিয়র অফিসার হিসেবে কাজ করি। আমার দরিদ্র পরিবারের কাছে এটাই অনেক ভালো চাকুরী, তাই আমাকে বিয়ে দিতে তাদের উঠেপড়ে লাগা। যাই হোক, গত ঈদের দ্বিতীয় দিন, আমি ঘুমিয়ে আছি বেশ বেলা করেও, এমন সময় বাসায় অনেক শোরগোল শুনে ঘুম ভাঙ্গলো। দেখি বাসা ভর্তি লোকজন, আত্মীয়স্বজন। ঘটনা কি বুঝতে পারি নাই, তবে অবাক হয়েছিলাম। এমনিতে ঈদে আমাদের বাসায় তেমন দু’চারজন আত্মীয়স্বজন ছাড়া কেউ আসে না। পরে আমাকে জানানো হয়, আজ আমার বিয়ে। গল্প উপন্যাসে মেয়েদের এমন করে বিয়ে দেয়ার কথা পড়েছি, কিন্তু ছেলে হওয়া সত্ত্বেও আমাকে এমন করে বিয়ে দেয়া হবে তা আমি এখনও কল্পনা করতে পারি নাই।

যাই হোক বিয়ের তিনদিন পর ঈদের ছুটি শেষে বউকে নিয়ে ঢাকায় আসি আর পরের দিন অফিসে গিয়ে শুনি আমার চাকরীটা আর নাই। অফিসের সবাই আমার বিয়ের খবর জেনেছে আগেই, আমিই ফোন করে আমার রিপোর্টিং বস এবং কয়েকজন সহকর্মীকে জানাই। অফিসে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতিতে সারাটাদিন পার করলাম, নিজের ডেস্কে বসে হঠাৎ কান্না করে দিলাম। বাসায় রেখে এসেছি সদ্য বিয়ে করে নিয়ে আসা বউ। এই ঢাকা শহরে তাকে খাওয়াবো কি? বাসা ভাড়া দিবো কিভাবে? এসব ভেবে অনেক কান্না করলাম। সহকর্মীরা আমাকে নিয়ে জোর করে লাঞ্চ করালো। একাউন্টস সেকশনে গিয়ে আমার ভাঙ্গতি মাসের বকেয়া টাকা বুঝে নিলাম, পিএফ ফান্ডে জমা রাখা টাকা আমাকে পরে এসে বুঝে নিতে হবে। অফিস ছুটির আগে আগেই অফিস হতে কাউকে না বলে বের হয়ে এলাম এক ফাঁকে।

আজ সাতচল্লিশ দিন, জমানো কিছু টাকার সাথে অফিস থেকে পাওয়া ভাঙ্গতি মাসের টাকা দিয়ে কোন মতে চালাচ্ছি আমাদের দু’জনের টোনাটুনির গরীব সংসার। বউ সৌভাগ্য নিয়ে আসছে কি না জানি না, তবে আমার জীবনে একজন সুন্দর বন্ধু হিসেবে এসেছে। আমার চাকুরী হারানোর খবরে সে আমার চেয়ে বেশী অবাক এবং কষ্ট পেয়েছে। সারাক্ষণ আমাকে সান্ত্বনা দেয়, খুব শীঘ্রই আরও ভালো কোন চাকুরীর ব্যবস্থা হবে বলেই হয়তো এই চাকুরীটা গেছে। আমি তাকে যতই বলি, “কিন্তু কি কারণে আমার চাকুরী গেল, তাই তো জানলাম না…”।

বাসায় ফিরে হেব্বি করে একটা গোসল দিয়ে পাখার নীচে বসলাম। গরমের দিনের দুপুর বেলার পাখার বাতাসে কেন যেন আমার চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসে। ঘরের লাগোয়া রান্নাঘরে হতে তেলাপিয়া মাছের তরকারী হতে কাঁচা ধনেপাতার সুবাস ভেসে আসছে, বালিশটা টেনে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। একটু ঘুমিয়ে নেই, আজ বিকেলে একটা ইন্টারভিউ আছে। গত সাতচল্লিশ দিনে এইটা হবে পঞ্চম ইন্টারভিউ, সব কয়টাই ভালো হয়েছে, কিন্তু এখনো কোন রিপ্লাই পাই নাই। দু’জায়গায় বলেছে চাকরীটা হলে আপনার ঠিকানায় চিঠি যাবে। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, যদিও পেটে প্রচন্ড খিদে। এই দুয়ের দোটানায় ঘুমের অতলে হারাচ্ছি ধীরে ধীরে। রান্না শেষ হলে বউ গোসল করে এসে খাবার সাজিয়ে আমাকে ডেকে তুলবে; এই ফাঁকে ঘুমিয়ে নেই।

দরজায় কেউ কড়া নাড়ছে, উঠে দরজা খুলে দেখি ডাকপিয়ন। রেজিস্ট্রি করা চিঠি নিয়ে এসেছে, সিগ্নেচার করে চিঠি বুঝে নিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করে খাম খুললাম। আহ, অবশেষে চাকুরীটা হয়েছে, ঢাকার বাইরে পোস্টিং, বেতন আগেরটার চাইতে ডবল। চিৎকার করে বউকে ডাকলাম।

“এই… এই শুনছো…” বউয়ের হাতের ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। ধাতস্ত হতে সময় লাগলো, এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম! এই অল্প সময়ে ঘুমিয়ে এতো দ্রুত স্বপ্নও দেখা যায়।

“এই… দেখোনা দরজায় কে…” বউ ভেজা কাপড়ে আমাকে ঠেলছে।

বিছানায় উঠে বসলাম, দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছে, দরজা খুলতে বলছে। আমি গিয়ে দরজা খুলে দেখি তিনজন পুলিশ দরজায় দাঁড়িয়ে।

“আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে, আপনার নামে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে চুরির মামলায়।”

“আমি কার কি চুরি করলাম?”

“আপনি আপনার অফিস হতে নগদ টাকা এবং মালামাল চুরি করে পালিয়ে আছেন। থানায় মামলা হয়েছে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন সহ…”

ভেজা কাপড়েই আমার বউ দরজায় এসে দেখে পুলিশ আমাকে হাতকড়া পড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুপুরের তীব্র রোদে নীল আকাশে কোথাও কোন মেঘের ছায়া নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি বউয়ের চোখ ঠিকরে বের হয়ে এসেছে যেন, হতবাক চাহনীতে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ভেজা শাড়ীতে। তার সেই ভেজা শরীরের সোঁদা গন্ধ ছাপিয়ে রান্নাঘরে থেকে ভেসে আসছে সদ্য রান্না করা তেলাপিয়া মাছের ঝোল হতে কাঁচা ধনেপাতার গন্ধ, হারাচ্ছে দূর অজানায়…

অফটপিকঃ অনেকদিন পরে কিছু লেখার চেষ্টা করলাম। পাঠক হিসেবে আমি এটাকে রেটিং দিবো ৩/১০ :(রন্তু ট্রিলজির দ্বিতীয় খন্ড "রন্তুর দিনরাত্রি" শুরু করার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। তাই তার আগে কিছু ইচংবিচং ছোটগল্প লেখার চেষ্টা থাকবে। পাঠক নিজ গুণে ক্ষমা করে দিবেন।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০২৫ রাত ১:৫৩
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয় দিবসের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানিয়ে । সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান ২০২৫, ১৬ই ডিসেম্বর।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:১৯




দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রানের এক সাগর রক্তের বিনিময়। দুই লক্ষাধিক মা বোনের সম্ভ্রম হারানো। লক্ষ শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত‍্যু। এক কোটি মানুষের বাস্তুহারা জিবন। লক্ষ কোটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×