বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় ছোটদের উপযোগী করে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের একটি ইতিহাস রচনা করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয় কাজ করেছেন। রচনাটি খুবই সংক্ষিপ্ত কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানার জন্য মোটামুটি তথ্য উপাত্ত এতে আছে। পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ধারায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও লুকোচুরি শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী হন জিয়াউর রহমান। তিনি সামরিক শক্তিবলে দেশের রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন এবং পরে রাষ্ট্রক্ষমতা স্থায়ী করার জন্য সেনাবাহিনী প্রধান পদ দখলে রেখে নির্বাচন করেন, রাজনৈতিক দল গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে তাকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাও পাঠ করানো হয়েছিল। এতে তিনি কিছু বাড়তি পরিচিতি পেয়েছিলেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের যে বিশাল রাজনৈতিক পটভূমি তাতে জিয়াউর রহমানের কোনও অবদান নেই। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কোন সামরিক তৎপরতার বিষয় ছিল না, এটা ছিল একটা প্রকৃত জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধে সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা অংশ নিয়েছিলেন কিন্তু তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় অংশ নিয়েছিলেন ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক-নারী_ অর্থাৎ সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর যখন আক্রমণ করে তখন বাঙালি কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেই বলে রেখেছিলেন, 'আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি...'। বাঙালির হাতে সেদিন প্রয়োজনীয় অস্ত্র ছিল না। ছিল না সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়ার সময় ও সুযোগ। তা সত্ত্বেও মাতৃভূমির প্রতি গভীর মমতা ও সীমাহীন সাহস বুকে নিয়ে বাঙালি জাতি মুক্তির জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ আকস্মিক হলেও স্বাধীনতার জন্য কিন্তু বাঙালি জাতির প্রকৃত প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় বাঙালি স্বাধীনতার অগি্নমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের আকাঙ্ক্ষা বাঙালির মনে জাগিয়ে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার অন্যসব বিশ্বস্ত রাজনৈতিক সহকর্মী-সহযোগী। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির আত্দঅনুসন্ধান ও আত্দজাগরণের যে যাত্রা শুরু তারই সফল পরিণতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। অর্থাৎ ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯-৭০_ এই কালপর্বে নানা ঘটনা ঘটেছে, আন্দোলন-সংগ্রামের বিভিন্ন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছে এবং ধাপে ধাপে স্বাধীনতার পথ রচিত হয়েছে। এই পথচলায় এবং অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তাদের সামনের কাতারে ছিলেন নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে জন্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বের প্রশ্ন এলে বঙ্গবন্ধুর নাম সবার আগে উচ্চারিত হয় এবং তার সঙ্গে আর কারও তুলনা চলে না, তার সঙ্গে একই মর্যাদায় অন্য কারো নাম উচ্চারণ করা যায় না।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভু্যদয়ের পেছনে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক কার্যকারণ ছিল। বাস্তব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি বাঙালি জাতিকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়তা করেছিল যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকে বাঙালির অস্তিত্ব বিকাশের সুযোগ নেই। তাই বলা যায়, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখেই স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়েছি আমরা। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং বৈষম্যমুক্ত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা। মোটা দাগে এটাকেই বলা যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। একটি পাকিস্তান ভেঙে দুটি দেশ তৈরি নয়, বরং ভিন্ন রাষ্ট্রআদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রেরণাই মুক্তিযুদ্ধে উজ্জীবিত করেছিল বাঙালি জাতিকে। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বদলে 'ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার' এই বিশ্বাসের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই বাঙালি হিসেবে এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তারা বাংলাদেশকে ফিরিয়ে নিতে চায় পাকিস্তানি ধারায়। সে জন্যই পাকিস্তানি রাষ্ট্রাদর্শ_ অর্থাৎ সামরিক শাসন, গণতন্ত্রহীনতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং বৈষম্যমূলক নীতি-পদ্ধতি চালুর অপচেষ্টা চলতে থাকে। তাছাড়া রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য ইতিহাস দখলের পাঁয়তারাও শুরু হয়। ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতা দিয়ে ইতিহাস রচনার প্রহসন চলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারীদের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দেশপ্রেম ও নিভর্ীকতার কথা, বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারলে ষড়যন্ত্রকারীদের পায়ের নিচে মাটি শক্ত হবে না মনে করেই ইতিহাস থেকে তাদের অবদানের কথা মুছে ফেলার এবং ঘৃণ্য দেশদ্রোহীদের বিশ্বাসঘাতকতার অপকর্তীতি লুকানোর সর্বাত্দক অপচেষ্টা চালানো হয়েছে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হিসেবেই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা হয়েছে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছে, কীভাবে হয়েছে, কাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে, দেশে-বিদেশে কারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের শত্রুমিত্র তা রাখা হয়েছে উহ্য। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথা হয়তো বলা হয়েছে কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার কথা, বর্বরতার কথা কিছু বলা হয়নি। এই বিকৃত ও অসম্পূর্ণ ইতিহাস পড়িয়ে নতুন প্রজন্মের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার জন্য, জিয়াউর রহমানকে মহিমান্বিত করার জন্য স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে ঘৃণ্য সব কুযুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। যেন জিয়ার ঘোষণাতেই দেশ স্বাধীন হয়েছে! কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধুর নাম অবিচ্ছেদ্য। তিনি এই ইতিহাসের নির্মাতা। হাত দিয়ে যেমন সূর্যের আলো আড়াল করা যায় না, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা যায় না আর কাউকে তার পাশে দাঁড় করিয়ে। বায়ান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত ধারাবাহিক রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতিটি পর্বেই বঙ্গবন্ধুর উজ্জ্বল উপস্থিতি আছে। সত্তরের নির্বাচনে বিপুল গণরায় ছিল বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই। এমন কি মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনাই ছিল বাঙালির কাছে অবশ্য পালনীয়। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' বঙ্গবন্ধুর এই প্রত্যয়দৃঢ় উচ্চারণ ছিল প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা।
জিয়াউর রহমানের রেডিও ঘোষণাকে যারা অনেক বড় করে দেখেন এবং এর ভিত্তিতে জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর সমান মাপের নেতা বানাতে চান তারা যুদ্ধকালে জিয়ার অবস্থানের কথা ভুলে যান। তার ঘোষণাতেই যদি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে থাকে তাহলে তারই তো নেতৃত্বে থাকার কথা কথা ছিল? আসলে জিয়ার রেডিও ঘোষণার তাৎপর্য এতই ক্ষীণ যে, মুজিবনগর সরকার এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী গঠনেও তার কোন প্রভাব দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে জিয়াউর রহমানকে কেউই নেতা মানেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টরের মধ্যে একটি সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি অর্থাৎ সামরিক নেতৃত্বের ১১ জনের ১ জন ছিলেন জিয়াউর রহমান। এর বেশি কিছু নয়। একাত্তরের ৭ মার্চের পর সারা বাংলা যখন টগবগ করে ফুটছিল তখন বিভিন্ন জায়গায় দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নিয়েছেন। কিন্তু সে সময় জিয়াউর রহমান তেমন কিছু করেছিলেন বলে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। পাকিস্তানের প্রতি তার আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। ৯ মাসের যুদ্ধকালে মুক্তিপাগল বাঙালি তো শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতেও তার নামেই জয়ধ্বনি দিয়েছে। জিয়ার নামে কোন জয়ধ্বনি কোথাও কেউ শুনেছিলেন কি? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই জিয়া তার নিজের মাপের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে শুরু করেন।
ইতিহাস জোর করে দখল করা যায় না, ইতিহাস থেকে কাউকে জোরজবরদস্তি করে বাদও দেয়া যায় না, আবার ইতিহাসে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কারও নাম সংযোজন করাও যায় না। এই সত্য অনুধাবনে সহায়ক হবে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বইটি। দেশজুড়ে এর ব্যাপক প্রচার হওয়া দরকার। এ ছাড়া এই বইটি স্কুলপাঠ্য হিসেবে অন্তভর্ুক্ত করা হলে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি পরিচ্ছন্ন ধারণা পাবে।
বিভুরঞ্জন সরকার
[লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট]