জাঁ-পল সার্ত্র ও সিমোন দ্য বোভয়া।এ এক অদ্ভুত জুটি।প্রায় বিরল।বিয়ে না করেও তাঁরা চিরবন্ধুত্বের সূত্রে একে অপরের সঙ্গে গাঁথা ছিলেন। খুব ছোটবেলাতেই তো সার্ত্র বোভয়াকে প্রেম নিবেদন করেছিলেন!কলেজের উজ্জ্বল ছাত্রটি যেমন ছিলেন সার্ত্র ঠিক তেমনি বোভয়াও ছিলেন মেধাবী।বারবার প্রত্যাখ্যানের পর অবশেষে বোভয়া ধরা দিলেন।
আর সেই যে জুটি বাঁধলেন সার্ত্রের মৃত্যু অবধি সেই বন্ধনহীন বন্ধন কোনওদিন শিথিল হয়নি।এমনকি বোভয়ার মৃত্যুর পর তাঁকে সার্ত্রের পাশে কবর দেওয়া হল।
অথচ সম্পর্কের প্রথাসিদ্ধ কোনও বন্ডে তাঁরা কোনওদিন স্বাক্ষর করেননি।তাঁরা ছিলেন মুক্ত।
কেমন ছিল তবে তাঁদের সম্পর্ক? বোভয়ারের ভাষায়, 'আমার জীবন সার্ত্রের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পর্কিত ছিল।... জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিজেরাই তৈরি করে নিয়েছিলাম এবং আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি ছিল স্বাধীনতা।'
কেমন সেই স্বাধীনতা? বোভয়ারের নিজের কথায়:
'আমাদের একটা নীতি ছিল।সেটা এই যে, আমরা দুজনে সর্বদাই পরস্পরের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ থাকব, এবং যখনই একজনের অন্যজনকে দরকার হবে তখন আমরা সেই দরকার মেটাব, পরস্পরের কাছে থাকব।আমরা পরস্পরের প্রতি একধরনের বিশ্বস্ততায় সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতাম'।
তবে এই চুক্তির মধ্যেও অনেক গলিগুঁজি ছিল।বোভয়ারের ভাষায়:
'আমরা চাইনি যে, আমাদের জীবন কেবলমাত্র আরেকজন মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়।আমরা বলতাম যে, আমাদের ভালোবাসাটা হচ্ছে একান্তভাবে আবশ্যিক ভালোবাসা।কিন্তু আমরা অন্যান্য ভালোবাসাও চেয়েছিলাম, সেগুলিকে আমরা বলতাম নিমিত্তসাপেক্ষ ভালোবাসা।সেটাই ছিল আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি।'
দুজনে আলাদা ভাবে জীবন কাটিয়েও তাই তাঁরা শেষদিন অবধি মিশে থাকতে পেরেছিলেন।হয়তো বোভয়ার তাঁর কোনও ছাত্রীর সঙ্গে সার্ত্রের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, কয়েকদিন পর খবর পেলেন সার্ত্র মেয়েটির সঙ্গে বিছানা শেয়ার করেছেন।বোভয়ারও অন্যের ঘরণী হয়ে কিছুকাল কাটিয়েছেন।এগুলো তাঁদের প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
এই বইটি এক আশ্চর্য বই।প্রায় প্রতিটি পৃষ্ঠা অশ্রুপাত সক্ষম। আদিউ বা বিদায় সার্ত্র।১৯৭০ থেকে ১৯৮০ --- সার্ত্রের জীবনের এই শেষ দশবছরকে নিয়ে বোভয়ার আবেগপূর্ণ অথচ তথ্যবহুল স্মৃতিচারণা।
দুঃখের বিষয় সার্ত্রের জীবন এইসময়ে অসুখে-বিসুখে কেটেছে।ভগ্ন স্বাস্থ্য। অন্ধ।তবু তাঁর মধ্যে প্রাণপণে লিখে চলেছেন ফ্ল্যবেয়ারের জীবনী।
বোভয়া পরম আন্তরিকতায়, নিষ্ঠায় ও দুর্মর ভালোবাসায় লিখে চলেছেন প্রতিটি দিনের দিনপঞ্জি। যেন একজন বন্ধু তাঁর বন্ধুর জন্য শেষকৃত্য সম্পাদনা করে যাচ্ছেন।
কী গভীর ভালোবাসা থেকে বোভয়ার এই উচ্চারণ:
'সার্ত্রের ওপর আমার বিশ্বাস এত গভীর ও পূর্ণ ছিল যে, তিনি আমাকে যে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন তা একমাত্র পাওয়া যেতে পারে পিতামাতা কিংবা ঈশ্বরের কাছ থেকে।'
অনূদিত এই বইটি নিয়ে বিস্তারিত কিছু আজ বলব না।আমি শুধু পৃষ্ঠা উল্টিয়ে চলি।১৯৭০...১৯৭১... ১৯৭৫...১৯৭৮...১৯৮০!
আমি একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় পৌঁছে গেছি।মারা যাবেন ১৫ এপ্রিল ১৯৮০! তার আগে বোভয়াকে বলছেন, 'আমার শেষকৃত্যের খরচ তোমরা সামলাবে কী করে?' তাঁর তখন একমাত্র দুশ্চিন্তার কারণ ছিল অর্থের অভাব।হাসপাতালে গেছেন বোভয়া।বোভয়ার হাত ধরে সার্ত্র বললেন, 'তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, কাস্তো'!যে হাত তিনি ছাত্রজীবনে প্রথম ধরেছিলেন আজ আবার ধরতে চাইলেন।
১৪ এপ্রিল। ঘুম থেকে জেগে উঠে বোভয়াকে সামনে দেখে স্বভাববিরুদ্ধ ভাবে তাঁর ঠোঁটের কাছে ঠোঁট এগিয়ে নিয়ে এলেন।বোভয়া তাঁর ঠোঁট, গাল ও চিবুক চুম্বন করলেন। বোভয়ার ভাষায়, 'এটা বেমানান। বুঝতে পারছিলাম সার্ত্রর মৃত্যু আসন্ন'।
চরম অস্তিত্ববাদী ছিলেন দু'জনেই।কোনও ভাবুলতা ছিল না স্বভাবে।বোভয়া পরিস্কারভাবে বলেছেন:
'সার্ত্রের মৃত্যু আমাদের দুজনকে বিচ্ছিন্ন করেছে। আমার মৃত্যুতে তা আর যুক্ত হবে না।জীবনটাই এরকম।তবে অনেকদিন ধরে আমরা দু'জনে হৃদ্যতার সঙ্গেই আমাদের জীবন উপভোগ করলাম।এটা কি কম আনন্দের?'
আমার বাঙালী স্বভাবে বলরাম দাস মনে পড়ে:
কে রহিবে গোকুলে কে শুনিবে বোল।
কে করিবে অনুখন ক্রন্দনের রোল।।
কে হেরিবে শূন্য কদম্বক কোর।
কে যাওব ঐছন কুঞ্জক ওর।।
নারিব নারিব প্রাণ রাখিতে নারিব।
কহে বলরাম হাম আগে সে মরিব।।
* জানি না বইটি এখন পাওয়া যায় কিনা।আমার কাছে একটিই মাত্র কপি ছিল।বন্ধু অর্ণব সাহাকে উপহার দিয়েছিলুম।
©গৌতম অঁতেলেকচুয়াল


সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২৩ বিকাল ৪:৩০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



