একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রসঙ্গ উঠলেই আমার এক বন্ধু কেমন যেন অপ্রতিভ হয়ে পড়ে। চেপে ধরলে বলে যে একাত্তরে বিহারী গণহত্যার মত ঘটনাও মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তাই বিচার করলে সব মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার করতে হবে। যুক্তিটি ফেলনা নয়। উদাহরণ হিসেবে সে বলেছে যে, একাত্তরে সান্তাহার রেল স্টেশন সংলগ্ন বিহারী কলোনীতে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালিয়ে বিহারী নারী শিশুসহ পুরুষদের জবাই করে হত্যা করেছিল।
সান্তাহারের বিহারীদের নিয়ে আমি এমন কিছু শুনিনি, কিন্তু এর উল্টো ঘটনার সাক্ষী আমার দাদু। সান্তাহার রেল স্টেশনে একাত্তরের এক দুপুরে ট্রেন থেকে যাত্রী নামিয়ে খুজে খুজে হিন্দুদের জবাই করছিল বিহারীরা। ঐ ট্রেনে ছিলেন দাদু ও তার এক হিন্দু বন্ধু। অবস্থা বেগতিক দেখে দাদু তাৎক্ষণিকভাবে তার বন্ধুকে কলেমা মুখস্থ করায়, যার ফলে দাদুর বন্ধু বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল বেঁচে যান। কিন্তু আমার বন্ধুর বর্ণিত ঘটনা শুনিনি। বন্ধুটির বাড়ী সান্তাহারের কাছে হওয়ায় তার সাথে বিতর্কে যেতে পারিনা। এমন ঘটনা ঘটতে পারে বটে।
সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপির কিছু নেতা কর্মী বিহারী হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীতে সোচ্চার হয়েছিল। এরকম অনেক দাবী আজকাল বিভিন্ন ব্যাক্তি ও সংগঠনের মধ্য থেকে উঠছে। পাকিস্তান বরাবরই এই দাবী জানিয়ে আসছে। একাত্তরের উপর করা পাকিস্তানের তদন্ত প্রতিবেদন হামদুর রহমান কমিশনের হিসেবে দুই থেকে পাঁচ লক্ষ বিহারী নিহতের কথা আছে।
মানবতাবাদী হিসেবে যেকোন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দাবী করা আমার ধর্ম। বছরখানিক আগে মিরপুরের বিহারী কলোনীতে আক্রমণ করে নারীশিশুসহ কয়েকজন বিহারীকে হত্যা করা হয়েছিল। তার প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম তীব্রভাবেই।
প্রশ্ন যে একাত্তরে সত্যিই বিহারীদের উপর গণহত্যার মত কোন ঘটনা ঘটেছিল কিনা?
একাত্তরে বিহারীরা পাকিস্তানের সাথে বাঙ্গালী নিধনযজ্ঞের সহযোগী ছিল, ভয়াবহ সব মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত ছিল। তাই মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালিয়েছে। সম্মুখযুদ্ধ বা গেড়িলা হামলায় যেমন রাজাকার, পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে, তেমনিভাবে নিহত হয়েছে বিহারীও।
যে বিচার বাংলাদেশে চলছে, তা কোন যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, যুদ্ধের মধ্য সবাই সমান। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছে। সেইসব হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না, বিচার করা হচ্ছে নিরস্ত্র মানুষ যাদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে, এইসব মানবতাবিরোধী অপরাধের।
এইসব ঘটনাগুলো বিদেশী সংবাদ মাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারি। তবু সব খবর কোনদিন জানা সম্ভব হবে না, কারণ খবর সংগ্রহে পাক আর্মির বাঁধা। বিদেশী সাংবাদিকরা ক্যামেরার ফিল্ম জুতার তলায় রেখেও ছবি নিয়ে আসতে পারেনি অসংখ্য গণহত্যার, পাক আর্মিরা সেগুলো কেড়ে নিত। এমন অনেক ঘটনা সেইসময় বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়োজিত বিদেশী সাংবাদিকদের মুখে শোনা যায়।
তাই এটা স্পষ্ট যে বাঙ্গালী নিধনের অনেক তথ্যই আমরা জানি না। কিন্তু বিহারীদের সাথে মানবতাবিরোধী অপরাধের মত ঘটনা ঘটলে তা প্রকাশে কোন বাঁধা ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা কারো ফিল্ম ছিনিয়ে নেয়নি। এমন একটা ঘটনাও একাত্তরে বিদেশী কোন সংবাদ মাধ্যমে পাওয়া যাবে না, যেখানে বিহারীদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বপক্ষে যায়। দেশী কোন পত্রিকাতেও পাওয়া যাবে না।
যদি পাওয়া যেত তাহলে বিএনপি, জামাত এতদিনে পেপার কাটিং দেখিয়ে মিছিল মিটিং করত।
তাই সহজেই বুঝা যায় যে, একাত্তরে বিহারীদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ স্রেফ অপপ্রচার।
কিন্তু অবস্থা যেমন দাঁড়িয়েছে, মানুষের ভিতর সংশয় প্রবেশ করতে সময় লাগবে না। মিথ্যা বারবার বলে সেটাকে সত্যে পরিণত করা হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন জন যখন একই কথা বলে, সেটা সত্য পরিনত হয়। মানুষের মন এভাবেই কাজ করে। মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করার এই নীতিকে বলা হয় গোয়েবলসীয় নীতি। হিটলারের মন্ত্রী গোয়েবলস্ এভাবেই মিথ্যা প্রচার করত।
একাত্তরে তিরিশ লক্ষ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়নি-এই কথাও গোয়েবলসীয় নীতিতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে পাকিস্তান, জামাত-বিএনপি।
সবশেষে একটা রম্যগল্প।
এক লোকের ছাগল একটু অসুস্থ হওয়াতে তাকে ঝুড়িতে ভরে মাথায় উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কয়েকজন ঠগবাজ তার ছাগল চুরি করার পরিকল্পনা করল। কিছুদূর যাওয়ার পর এক ঠকবাজ লোকটির উদ্দেশ্য বলল, গর্দভ মানুষেরাই শুধু কুকুরকে মাথায় নিয়ে হাঁটে।
লোকটি মনে মনে হাসে, গর্ধব নিজে এসে জানান দিচ্ছে যে সে একটা গর্ধব, নয়তো ছাগলকে কুকুর বলে কিভাবে।
আরও কিছুদূর যাওয়ার পর দ্বিতীয় ঠকবাজ লোকটির উদ্দেশ্য বলল, কি ভাই! আজকাল কি বাজারে কুকুর বিক্রি হচ্ছে।
লোকটি এবার রেগে গেল, আপনি বরং চোখের ডাক্তার দেখান।
এভাবে আরও একটু যাওয়ার পর তৃতীয় ঠকবাজের আবির্ভাব। ব্যঙ্গাত্মক সুরে লোকটিকে বলল, ভাই মাথা ঠিক আছে তো? নাহলে খামোখা কুকুরকে মাথায় নিয়ে ঘুরছেন কেন?
লোকটি রেগে গেলেও তার মনে সংশয় দেখা দিল এবার। সবাই বলছে কুকুর, কিন্তু সে ছাগল নিয়ে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর আরও একজন ঠকবাজ এসে লোকটিকে বলল, আপনার মাথার কুকুরটা কি সার্কাস পার্টির?
এইবার লোকটার মনে আর কোন সন্দেহ থাকল না, সে নিশ্চিতই একটা কুকুর মাথায় নিয়ে হাঁটছে। ঝুড়ি থেকে ছাগলকে নামিয়ে পাছায় কষে লাথি মেরে বলল, ভাগ শালা কুত্তা। এতক্ষণ ছাগল ভেবে তোকে মাথায় নিয়ে হাঁটছি।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫৩