
-যাবেন? মোহাম্মদপুর।
-(হ্যা বোধক ভাব)
- মিটারে তো?
- ২০ ট্যাকা বাড়ায়ে দিয়েন।
অগত্যা কিছু করার না থাকায় উঠে পড়লাম। গুলশান ১ –এ স্যামসোনাইটের সামনে অসহায় দাঁড়িয়ে আছি প্রায় ৩০ মিনিটের উপরে।
-কোন দিয়া যাইবেন? মিটার হইয়া তো আপনারা রাস্তা বেশি চিন্যা ফালাইসেন।
গেট টেনে ধরে বললাম- যেদিক দিয়ে ইচ্ছা যান।
-মিটার হইয়া আপা গরীব আরো গরীব হইসে। আপনারা তো ভাড়া কম দিয়া যান গা। ১০/২০ টাকা বাড়াইতে কইলে সার্জনরে বিচার দেন। আমগো ক্যাশ টাকা লইয়া যায়। গুলশান থেইক্যা মোহাম্মদপুর কত লাগত কন? নিম্নে ২৫০ টাকা? অখন যান ১৫০-১৬০! আর আমাগো জমাই দেয়ন লাগে ৯০০-১০০০ টাকা। মাফ নাই।
-তো, আপনারা আন্দোলন করেন! জমা কমানোর আন্দোলন।
- লাভ নাই। সরকার খালি আমগোরেই টাইট দিবো। জমা দিয়া হাতে আর কিছু থাকেনা। সেই দিন দুপুরে হোটেলে খাইলাম- ভাত, ডাউল আর কাচাঁ কলা ভর্তা। আর একটা শাক। ৬৫ টাকা নিসে। ভাত একলা খাইলে ভালা লাগেনা। কত দিন মাছ-মাংস খাইনা। চাইলে পারিনা? পারি! খাইনা। ঘরে বৌ বাচ্চা আসে, কি খায় না খায়। হয়না আপা। কিচ্ছু হাতে থায়না। পড়ার খরচ! ভর্তি –বই-খাতায় পাচঁ হাজার টাকা গেসে। কই পামু এত টাকা! তাই পারুটি খাই। আইজক্যা দুপুরে দুইটা পুরি খাইসি।
(কিছুক্ষণ থেমে)
আমার চেহারা এত খারাপ আছিলোনা। এক্ সপ্তা ধইরা শরীলডা ভালা না। মালিকরে কইলাম –কইল চালাইতে না পারলে পার্মেন্ট লোক নিব, গাড়ী বসায়া রাখবনা। বাইধ্য হইয়া অসুইখ্যা শরীল লইয়া ক্যামনে যে প্রতিদিন ৯০০ টাকা জমা দিসি। তাও গাড়ীটা থাউক। নাইলে একমাস বেকার থাকন লাগব।
বউ বাইচ্চাদের দ্যাশে রাখছি। ঢাকা শহরডা ভালা না। রাখবারো পারুম না।
সাইড ভিউ মিরর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়েই কথা বলছে ড্রাইভার। খারাপ লাগছেনা শুনতে। এক একটা মানুষ এক একটা উপন্যাস! মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল সরে বসা উওচিত, যেকোন সময় দূর্ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক না।
-আপনার কয়টা বাচ্চা?
-একটা মেয়ে, একটা ছেলে। মেয়ে ব্যস কম তের, ছলের নয়। মেয়ের মা নাই।
-মানে? কি হয়েছিল?
-লিভারে জন্ডিস! ঢাকা মেডিকেলে ছিল।পরে মগবাজার আদ্ব-দ্বীণে মারা গেছে।
-আপনার এই বৌ মেয়েকে আদর করে?
-ছেলেডারে যেমন দ্যাখে, মেয়েটারেও তেমন দ্যাখে। ব্যস কম নাই। আমার আগের বৌটা খুব ভালো ছিল। মুখ দিয়ে কোন কথা বাইর হইত না। কেও কইতেই পারতনা বাড়ীতে একটা মেয়ে লোক আছে।
-১ম টা প্রেমের বিয়ে ছিল?
-না আপা! আমার মা, আমার আল্লাহ্র পরেই। মায়ে যদি কয় এহন ‘দিন’, এহন ‘দিন’, মায়ে কইলে এহন ‘রাইত’। ভায়ের শ্বশুর বাড়ি গেসিলাম। সেইদিনই আমার কাবিন হইছে। কইতেও পারুমনা। মায়ের পছন্দ ছিল। আমার বৌরে মায়ে মাইয়ার মতন দ্যাখত। কেউ দেখলে সবাই মনে করত এইটা আমার মায়ের প্যাটের মাইয়া।
-বাহ্! বেশ।
সিএনজি তখন নভো থিয়েটারের সামনে। কথার গাড়ি চলছে। মন্দও লাগছেনা, আবার একটানা ভালোও লাগছেনা। মিশ্র অনুভূতি।
আমারে দেখলে কেওই কয়না আমার এতবড় ছেলে-মেয়ে আছে। শরীরডা এই কয়দিন ভালা না। এই আংগুলের আংটিটা টাইট হইতো-এহন দ্যাখেন ঢিলা হয়। টাকার শোক। দেড় লাখ টাকা পানিতে ফেলসি আপা। এই দেড় লাখ টাকা আমার কাসে এক কোটি টাকার মতন। অনেক কষ্টে জমাইসিলাম। বিদেশ যাওয়ার তালে সব শ্যাস। পাচঁ লাখের কন্টেক হইসিল। ভিসাও পাইসিলাম। আমার বুকের দুইটা হাড় ভাঙ্গা। আগে টেরাক চালাইতাম-কত দেশ ঘুরছি-এই বয়সেই। মানুষ কত ট্যাকা খরচ করে –বেড়াইতে! আর আমি এম্নি-ই ঘুরসি- টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। একদিন ইস্পিড হারাইয়া বিশ টন চাউলের টেরাক উল্টাইল। লাফ দিসিলাম-কিন্তু দেরি হইয়া গেসে। একটা বস্তা বুকে আইসা পরল। কেও ভাবেনাই বাচুম। আমি বাচলাম। মায়ের কসমে ট্রেরাক ডেরাইভারী ছারসি। বিদেশ যাইতে পারিনাই হাড্ডি ভাঙ্গা বলে। মেহনতের কাম করতে পারিনা। জিদ্দে পাসপোট ছিইর্যার ফেলসি।
সিএনজি তখন ক্রিসেন্ট লেক ধরে ছুটে চলছে। রাস্তার দুই পারে অসংখ্য জুটি। হাতে হাত, কাধেঁ কাধঁ। আচ্ছা ড্রাইভার ভাইয়ের নাম তো জানা হল না। জেনে লাভও নাই। মনে থাকবে না। আর কখনো দেখা হলেও হয়ত চিনব না।
২য় স্ত্রীকে সাজতে মানা- ড্রাইভারের বৌ বলে কেও যেন তাকে মন্দ না ভাবে। ড্রাইভারের বৌ কে কেন মানুষ মন্দ বলবে বুঝিনাই। এ বিষয়ে অবশ্য সে অনেক কথা বলেছিল। মন দিয়ে শুনি নাই। রাস্তায় কড়া জ্যাম বেধেছে রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের সামনে থেকেই। বিরক্ত লাগছিল।
-আমার রাগ এক্টু বেশি। একবার এই বৌটারে মারসিলাম- মা’র কথা শুনে নাই তাই। উনার ভাই আইস্যা নিয়া গেসিল। আমি উনার ভাইরে কইসিলাম- আমার বৌরে আটকাইবার পারবেন না। পারেনাই। আমি একবার ফুন দিয়া হ্যালো কইসি, চইলা আইসে। উনি আমারে অনেক ভালোবাসে, আমিও বাসি। নাইলে কি আইত??
অবশেষে পৌছলাম-জাপান গার্ডেন। ভাড়া মিটালাম-১৯২ টাকা। নামতেই সে বলল- আপা, অনেক কথা কয়া ফালালাম। কিছু মনে কইরেন না । আমাদের জীবনের অনেক গল্প- শুধু শোনার মানুষ নাই।
ভালোবাসা- বিচিত্র। গল্পগুলো ভালোলাগছিল; কারণ গল্পগুলো ছিল –ভালোবাসার। ভালোবাসা- মা, স্ত্রী হয়ে প্রবাহিত হয়েছে সন্তানে। আশায় স্বপ্ন বোনা, স্বপ্ন ভঙ্গ, আবার নতুন স্বপ্নের প্রত্যাশায় ছুটে চলা-ভালোবাসার মানুষগুলোর জন্যই। বুকের ভাঙ্গা হার বেয়ে সেই ভালোবাসা গড়িয়ে বাষ্প হয়ে যায়না- সেই ভালোবাসা শুকনো রুটি কিংবা দুটো পুরি দিয়ে দিন পারি দিতে শেখায়। সেই ভালোবাসা মোবাইল ফোনে প্রেম কে হ্যাচকা টানে বাড়ি ফেরত আনতে পারে। ঘড়িতে সময় মিলালাম- ৪৬ মিনিট লেগেছে বাড়ি ফিরতে। আমার জন্য ভালোবাসায় জড়ানো দুই জোড়া চোখের অপেক্ষা শেষ করতে হবে।

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




