হিন্দু ধর্মঃ- ২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
সত্য বিশ্বজনীন এবং তার সন্ধানও চিরন্তন। মুনি-ঋষিদের অনুভূত সিদ্ধান্তের উপর হিন্দুধর্ম প্রতিষ্ঠিত। এখানে কোন একনায়কত্মের স্থান নেই। নানা পথে বিভিন্ন ধারায় এ সত্যকে জানবার চেষ্টা করেছেন তাঁরা যুগে যুগে। এ ধর্মের বৈশিষ্ট্য কোন একটি ছাঁচে বাঁধা-ধরা নিয়মে নয়। কোন ঈশ্বর প্রেরিত ব্যক্তি বা ধর্মপ্রবক্তার বাণীও নয়। এগুলো শ্বাশত। তাই একে সনাতন ধর্ম বলে। এ ধর্মমতে ধর্ম জিজ্ঞাসা ও সশ্রদ্ধ প্রশ্ন আধ্যাত্মিক মার্গে প্রবেশের প্রথম সোপান। তদ্বিদ্ধি আংশকা নেই বরং এ ধর্ম আত্মজ্ঞানলাভেচ্ছু ব্যক্তিকে তার সংশয় দূর করবার জন্যে নির্দেশ দিচ্ছে- " সংশয়াত্মক ব্যক্তি ইহলোক পরলোক কোন বিষয়ে সফলকাম হয় না। তার বিনাশ অনিবার্য- (গীতা ৪/৩৪)
অতএব দেখা যাচ্ছে হিন্দুধর্মে অন্ধবিশ্বাসের কোন স্থান নেই। কিন্ত্ত যারা জলে না নেমে সাঁতার শিখতে চায় তাদের কোন কালেই সাঁতার শেখা হয় না। যাঁরা ধর্মের প্রয়োজনীয়তা উপলব্দি করেছেন, অথচ পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তাদের প্রশ্নের মীমাংসা প্রয়োজন। সেজন্যে উপযুক্ত শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করা দরকার। এঁদের আমরা আচার্য বা গুরু বলতে পারি। শাস্ত্রে আছে- যে পর্বত আরোহন করে ফিরছে তার কাছে পূরোবর্তী পথের সন্ধান আস্থা সহকারে জেনে নেওয়া প্রয়োজন্ (ছা উপ) সেরূপ ধর্মপথের উচ্চশিখরে উপনীত হতে হলে আচার্যের কথায় আস্থা না রাখলে চির জীবনই ব্যতিরেকে জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। যদি ব্যবহারিক জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রে এ অবস্থা হয় তাহলে অতীন্দ্রয়ি জ্ঞানলাভের জন্যে পরিপ্রশ্নের সাথে প্রণিপাতের প্রয়োজন হলে তা কিছু অবৈজ্ঞানিক হবে না। শাস্ত্র আরও বলেছেন- শুষ্ক তর্কে দ্বারা তুরীয় জ্ঞান লাভ হয় না। (নায়মাত্মা প্রবচেনন লভ্য-মুন্ডক উপনিষদ ৩/২/৩)। যাঁকে প্রত্যক্ষ করবার জন্যে ধর্মের প্রয়াস তিনি "অবাঙমনসোগোচরম্)- বাক্য ও মনের অতীত; সর্বভূতের অন্তরে লুকিয়ে আছেন, সহজে প্রকাশিত হন না। সদ্গুরুই এ ব্যাপারে পথপ্রদর্শক। এ গুরু এখন কৌলিক বা পুরোহিত সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে বংশগত হয়ে পড়েছে। কিন্ত্ত উপনিষদ্ বা গীতা কোন বংশগত গুরুর দাবী স্বীকার করছেন না। (গীতা ৪/৩৪) অর্থাঃ যে গুরু ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছেন। যার আত্মদর্শন হয়নি তিনি কেমন করে মন ও বুদ্ধির অতীত বিদ্যা প্রদান করতে সক্ষম হবেন? (গীতা ৩/৪২)
হিন্দুধর্মে বিভিন্ন শাখা-উপশাখার এবং মার্গের কথা বলা হয়েছে, অভিজ্ঞ কর্ণধারের সহায়তা নিয়ে এ সকল পথে চললে পথ হারাবার ভয় নেই।
গুরুবাদ এ ধর্মে স্বীকৃত হয়েছে। কিন্ত্ত এর অর্থ এ নয় যে, যে কোন ব্যক্তি গুরু হতে পারবেন। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে অধিকারীভেদ। যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী নয় সে ব্যক্তি গুরু হতে পারে না। এ অধিকার সম্বন্ধে সাবধান বাণী যথেষ্ট উচ্চারিত। শ্রী রামকৃষ্ণ তাই উল্লেখ করেছেন- গুরু এক সচিদানন্দ। তিনিই শিক্ষা দিবেন। ... লোক শিক্ষা দেওয়া বড় কঠিন। যদিও তিনি সাক্ষাৎকার হন আর আদেশ দেন তাহলে হতে পারে।
মানুষ সমগুণ ও সমতুল্য অবস্থায় ভূমিষ্ট হয় না। প্রত্যেকের দেহের মধ্যে যেমন শরীর অপেক্ষা আত্মার প্রাধান্য তেমনি জন্বগত অবস্থাতে মানষে মানুষে হিন্দু ধর্মের অধিকারবাদ একটা মৌলিক নীতি। এ নীতি বিস্তৃত হলে কোন তত্ত্মই উপলব্দ হবে না, বরং বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হবে। সকল মানুষের জন্বগত বিচারবুদ্ধি, প্রবৃত্তি এবং আধ্যাত্মিক তত্ত্ম ধারণ করবার ক্ষমতা এক নয়। তাই সকল রোগ এবং রোগীর জন্য সমান ব্যবস্থাপত্র নেই হিন্দু ধর্মে।
কারণ ব্যতীত কোন কার্য হয় না এবং কার্য করলে সেই কার্যই অপর কার্যের কারণ । এটি বৈজ্ঞানিক সত্য। একে হেতুবাদ বা কার্যকারণবাদ বলা হয়। কাজ করলে তার ফল অনিবার্য। বৃহদারণ্যকে উপনিষদে(৪/৪/৫) ফলভোগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জন্বমৃতু¨রূপ সংসার চক্র থেকে মুক্তি হবে না বলে বলা হয়েছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ এটা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। দেহধারী জীব এক মুহুর্তও কর্মহীন হয়ে থাকতে পারে না। প্রতিটি কাজই যে সৎকাজ হবে তা বলা চলে না। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে যে কত ক্ষুদ্র প্রাণীবধ হচ্ছে তা আমরা জানি না।অজ্ঞানবশতঃ অনেক অন্যায় কাজেও অবতারণা ঘটেছে। তাই শুভাশভ মিশ্রিত কর্ম ব্যক্তি জীবনে হয়ে থাকে। শুভ কর্মে স্বর্গলাভ করে পুনর্জন্ব থেকে সাময়িক অবতারণা ঘটেছে। তাই শুভাশুভ মিশ্রিত কর্ম ব্যক্তি জীবনে হয়ে থাকে। শুভ কর্মে স্বর্গলাভ করে পুনর্জন্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি পেলেও মুক্তিলাভ হয় না। সুকৃতির ফল কালক্রমে শেষ হয়ে যায় ভোগের দ্বারা। তাই আবার জন্বগ্রহন করতে হবে। এ ধারাবাহিক জন্ব ও জন্বান্তর কৃতকর্মের ফলের বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই যাতে কর্ম বন্ধনের কারণ না হয়ে মুক্তির সোপান হয় সেভাবে সনাতন হিন্দুধর্মের অনুসারীরা চেষ্টা করেন। কামনাশূন্য হয়ে ফলাকাঙ্খা না করে কর্ম করিলে তা মুক্তির কারণ হয়। গীতায় আছে-
যুক্তঃ কর্মফলং ত্যক্তা শান্তিমাপ্নোতি নৈষ্ঠিকীম্
অযুক্তঃ কামকারেণ ফলে সক্তোনিবধ্যতে।।
ঈশ্বরের নিমিত্ত কর্ম করছি, ফললাভের জন্য নয়- এরূপে কর্মফলত্যাগপূর্বক নিষ্কাম কর্মযোগী জ্ঞাননিষ্ঠার ফলস্বরূপ চিরশান্তির অধিকারী হন; কিন্ত্ত সকাম কর্মী কর্মফলে আসক্তিবশে সংসারে আবদ্ধ হন।
আরও দেখেন-দেহ আমি নই। দেহের মধ্যে লুক্কায়িত আত্মাই প্রকৃত আমি। নিজে পরমাত্মার অংশবিশেষ। অজ্ঞানতার জন্য তা ভুলে থাকেন। এ অজ্ঞানতাকে দূর করবার জন্য আধ্যাত্মিক অনুভূতির দিকে ধাবিত হন হিন্দু সাধক।এ আধ্যাত্মিক জগতের শীর্ষদেশে আরোহন করা একমাত্র সম্ভব কঠোর পরিশ্রম এবং তপস্যায়। অধিকারীভেদে অনেক বিকল্প পথের কথা উল্লেখ রয়েছে হিন্দুধর্মে। তাই কোন বিশিষ্ট পথ রুচিসম্মত না হলে হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। এজন্যে কোন বিশিষ্ট মন্দিরে বা উপাসনালয়ে উপস্থিত হতে হবেই- তা হিন্দু ধর্ম বলে না। আসলে ত্যাগই অমৃতত্ত্ম লাভের প্রকৃষ্ট উপায়, ভোগ নয়। ত্যাগনৈকে অমৃতত্ত্মমানশুঃ(না ১২/১৪)
হিন্দুধর্ম মতে ধর্ম একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার। দল বেঁধে হাটে-বাজারে , উৎসব মেলায় যাওয়া যায়, কিন্ত্ত অব্যক্ত অচিন্ত¨ ও নির্বশে পরমেশ্বরসত্তাকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন অতীন্দ্রয়ি অনুভূতি। কঠোর সাধনায় আত্মিক উন্নতি ছাড়া এ ভূমিতে প্রবেশ করা যায় না। সর্বভূতে সমদর্শন ও সর্বভূতের কল্যাণ সাধনই হিন্দুধর্মের বিশেষ লক্ষ্য। ভগবান সৃষ্টির প্রতি অনুতে বিরাজমান। প্রত্যেক জীবের অন্তরে আত্মার উপলব্ধি করতে না পারলে সৃষ্টিকর্তাকে দেখা যায় না। (ঈশ-উপ-৫-৬, গীতা ৪/৩৫)
সকলের মধ্যে নিজেকে অনুভব করতে না পারলে সম্পূর্ণভঅবে অপরের জন্য ব্যথিত হওয়া যায় না। (গীতা ৬/৩২)। এ ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত হিতের কথা বলে না। বিশ্ব জগতের মঙ্গলের কথা গভীরভাবে বলে। তাহলেও কি এ ধর্মকে স্বার্থপরতার ধর্ম বলা যায়? সত্য অনুভব না করে সমালোচনা করলে সমালোচিত হওয়ারই সম্ভাবনা। তাই আধ্যাত্মিক জীবনের চরম শিখরে উন্নীত হয়েও যোগীকে লোকসংগ্রহ কর্মে (গীতা ৩/২০) ও সর্বভূতহিতে রত(গীতা ৫/২৫) থাকতে উপদেশ দিচ্ছেন শাস্ত্র।
সনাতন হিন্দুধর্ম চিরন্তন সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে এটি অবিনাশী। বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও এটি শক্ত ও দৃঢ়মূল। এ ধর্মের অন্ত©নিহিত উদারতা ধর্ম-বর্ণ -নির্বশেষে সকলকে আপন করে নিয়েছে। এর নমনীয়তা, সংস্কার প্রবণতা সহজাত। এজন্য এটি কালে কালে কত গৌণ আচার বা বিচার গ্রহন বা বর্জন করেছে। এত সংঘাত, এত পরিবর্তন সত্ত্মেও এর অস্তিত্ম বিলুপ্ত হয়নি। কারণ এর সর্বজনীন, শাশ্বত সত্ত্মাকে সংস্কার করবার প্রয়োজন হয় না। লক্ষ্যনীয় রামানুজ ও চৈতন্য প্রবর্তিত ধর্মে জাতবিচার নেই এবং বৈষ্ণব ধর্মও হিন্দু ধর্মের এক শাখা এবং বেদান্তদর্শনের উপর এটি প্রতিষ্ঠিত। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাখাও এরূপ। স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মের এক শাখা এবং বেদান্তদর্শনের উপর এটি প্রতিষ্ঠিত। হিন্দুধর্মের বিভিন্ন শাখাও এরূপ। স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের আত্মদর্শন ও সর্বত্র ব্রহ্মদর্শনের দুটি ধারাকে একত্রিত করে বলেছেন- আত্ননো মোক্ষর্থং জগদ্ধিতায় চ। অর্থাৎ নিজের হৃদয়ে আত্মানুভূতি হলে সাধকের কামনা বাসনার শৃঙ্খল ছিন্ন হয়। তাকে জীবমুক্তি দান করে। তথাপি তার পূর্ণ ব্রহ্মজ্ঞান হয়নি।ব্রহ্ম যেমন তার মধ্যে আছেন, তেমনি সৃষ্টির সকল জীবের মধ্যে তিনি আছেন (কট ২/২/১০-১২)। শ্রী রামকৃষ্ণ এ ভাবটিকে তাঁর আধ্যাত্ম অনুভূতিতে ব্যক্ত করেছেন- " যার হেথায় আছে- তার সেথায় আছে"।
উপনিষদে বিদ্যা এবং অবিদ্যার উল্লেখ রয়েছে। একে পরা এবং অপরা বিদ্যা বলে। সংসারে উভয়েরই প্রয়োজন। মানুষের জীবন বিভিন্ন স্তরে প্রবাহমান-ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। এ সকল অবস্থার মধ্যদিয়ে মানুষের উত্তরণ ত্যাগে। এটিই তার অমৃত্ব লাভের উপায়।(দ্ব বিদ্যে বেদিতব্যে... পরা চৈবাপরা চ। মুন্ডক, উপ ১/১/৪)। যাঁরা এ পরোক্ষানুভূতি লাভ করতে সক্ষম তাঁরাই অমৃত্ লাভ করেন। এ ধর্মের উদ্দেশ্যই হর অমৃতত্ব লাভ। যেনাহং নামৃতং স্যাং কিমহং তেন কুর্যাম্ (নৃহ উপ ২/৪/৩-৪/৫/) । এটাই হোক চিরন্তন জিজ্ঞাসা।
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'
আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
আকুতি
দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন
ক- এর নুডুলস
অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।
ক
একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন
কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???
কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???
আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু
২-১ : আলিফ-লাম-মীম
আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন