১৯৯৮ সালঃ
ভোর রাতের আযান হচ্ছে। হাসনা হেনা ফুলের গাছে ফুল ফুটেছে তীব্র গন্ধে নাক ভরে যাচ্ছে সুমির। নিটোল স্বপ্নহীন একটা ঘুম হয়েছে ওর। ও আর মোড় ভেংয়ে ঘুম থেকে ওঠে। পুকুর পাড়ে যেতে হবে। ওযু করবে নামাজ পরবে। সকালের নামাজ না পড়লে ওর ভালো লাগেনা। সারাদিন মনের ভেতের একটা নেই নেই ভাব কাজ করে। বাবা মা পাশের ঘরে ঘুমাচ্ছে, বাবা স্কুল মাষ্টার। ওর ৬ বছর বয়সের ভাই বুবুন ওর পাশেই শুয়ে আছে। ও ওর ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, কি নিস্পাপ মুখ! এদের সবাই কে ছেড়ে স্বামীর ঘরে যেতে ওর খুব খারাপ লাগবে, খুব। তবুও কি করার? মেয়েদের কে তো যেতেই হবে, স্বামীর ঘরে। সে হয়েছে তার মায়ের মতন। সে যখন বড় হয়েছে মা তখন শিখিয়েছে, সোনা মা মেয়েদের কাছে পুরুষের কিছু জিনিস আমানত রাখা থাকে। তোর যে স্বামী হবে তার কিছু জিনিষ তোর কাছে আমানত রাখা আছে। সেই আমানত জীবন থাকতে নষ্ট হতে দিবিনা। ও ওর মাকে জিগ্যেস করেছিল, "মা ছেলেদের কাছে কি আমাদের জন্য কিছু আমানত রাখা নাই?" মা বলেছিলো আছে রে মা, আছে। সৎ আদর্শবান পুরুষেরা সেই আমানত ঠিক রাখে। আল্লাহতালা বলেছেন তিনি সৎ নারীর জন্য সৎজীবন সঙ্গিনী রেখেছেন, তেমনি পুরুষের জন্যও।
সুমি আব্রু করে, হিজাব পরে, নামাজ পড়ে। এবার সে অনার্স পড়ছে ইচ্ছা আছে অনেক বড় কিছু হবে।
সুমি ওযু করতে বাহিরে যাবে সকালের আলো ফুটে ওঠেনি এখনো। সে একা, বাহিরে যেতে ভয় পাচ্ছে। বুবুন কে ওঠানো যায়, কিন্তু ওর এই নিস্পাপ ঘুম ভাঙতে ইচ্ছে করেনা ওর।
সুমির লাশ টা ঝুলে আছে গাছের সাথে, গলায় রশি দিয়ে। ও জানত আত্মহত্যা মহাপাপ। তবুও, ও গলায় দড়ি দিলো। বুবুনটা কিছুই বলছেনা, সুমির মা বিলাপ করছে, বাবা কাদছে। বুবুনের পবিত্র মুখে স্তব্ধতা। বুবু, হ্যা ও ওর বুবুকে মরে যেতে দেখেছে। সকালে ওর হিসু এসেছিল, উঠে দেখে বুবু নেই। দরজা খোলা ও একাই উঠে বাহিরে গিয়েছিল। বাহিরে গিয়ে ও দেখেছিলো, চেয়ারম্যানের ছেলে ঝন্টু ওর বুবুকে মাটিতে ফেলে উপরে উঠে খুব মারছিল। ঝন্টুর বন্ধু টিকু বুবুর মুখ চেপে রেখেছিল। বুবু ছট ফট করছিল তবুও ঝন্টু বুবুকে মারছিল, কিভাবে চেপে- চেপে ধরছিল? ও গিয়ে ছিল দৌড়ে কিন্ত টিকু ওকে চড় মেড়ে বলেছে, যদি কাউকে বলে- তাহলে ওকে সহ ওর বাবা-মা কে মেরে ফেলবে। ও ওর বুবুর মুখ টা ভুলতে পারছেনা। বুবুর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরছিল।বুবুর ভয়ার্ত চোখে ও বেদনা দেখেছিল। এর কিছুখন পরই বুবু নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। ঝন্টুই বুবুর শরীর টাকে গলায় রশি দিয়ে ওদের বাড়ির একটা গাছের সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে ছিল। ওর মনে আছে এই ঝন্টুই এক দিন রাস্তায় বুবুকে বলে ছিল
বোরকা আলী বুবুজান
মুখ খান দেখাই যান,
মুখে দিমু চুমা,
আমার কোলে ঘুমা।
গল্পটা এখানে শেষ করে দিলে কেমন হয়? অনেকেরই মনের মধ্যে এক ধরনের রাগ তৈরী হবে। এটা কি লিখলাম আমি? সুন্দর সকালে ঘুমথেকে ওঠা এত ভালো এবং সুখি মেয়ের জীবন আমি অন্ধ কারে ঢেকে দিয়ে, তার মৃত্যু দিয়ে, আমি কি মজা পেলাম?! ঐ ধর্ষন কারী ঝন্টুর তো কিছুই হলো না। আদতে হয়না কিছুই, সুমির বাবা একটা অপমৃত্যুর মামলা করেছিল, সেই মামলা পর্যন্তই। "ধর্ষনের পর, শ্বাস রোধে মৃত্যু" এটা পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে পাওয়া গিয়ে ছিলো, ঠিকি। কিন্তু কে ধর্ষক বা হত্যা করী তা আজো ধরা যায় নি।
এটা আর একটা গল্প একটার সাথে আর একটার মিল হয়তো থাকতে পারে,
ভোর ৪টা ঝন্টু দের ঘরের আলো জ্বলছে, ঝন্টু ওর বন্ধুদের নিয়ে ডি ভি ডি প্লেয়ার চালাচ্ছে। সারারাত হিন্দী সিনেমা দেখেছে। কি নাচ নাচেরে নাইকা গুলা, উহু- আহা। "কাটা লাগা, হায় বাংলে কে পিছে।" উহ ঝন্টুর মাথা খারাপ একটা ভাব হচ্ছে। যা দেখাইলো না, "উহু" নেকেট নাইকাগো নাচাইয়া ভারতিয়রা কি মসলাইনা বানাইছে।এখান গান বানাইছে- "কালিওকা চামাং যাব খিলতি হ্যা, থোরা শিশা লাগতা হ্যা, থোরা রশম লাগতা হ্যা।"
দেশিও কিছু সিনেমা সে এনেছে। সথে টিকু নিয়ে আসছে দেশি কিছু সিডি, ভারতিয় তো আছেই সাথে বিদেশি মাল গুলারও ভিডিও। পাশের ঘরে বাবা ঘুমায়নাই এখন ও। বাবা ঘুমাইলেই হালকা মদের সাথে চালানো হবে ব্লু-ফ্লিম।
ঝন্টু টিকুর দিকে তাকায়, টিকু মদের বোতলে চুমুক দিয়ে বলে, "কিরে এরকম চাইয়া রইছিস কেন?"
- দোস্ত একটা মাল পাইলে ভালো অইত।
এই গ্রামে মাল পামু কই? সেই দিন না ঢাকায় গিয়া তোরে হোটেলে খাওয়াইয়া আনলাম।
- দোস্ত যে ভিডিও দেখাইছস, মাথায় মাল চাইপা গেছে। না ঝারতে পারলে হইতাছেনা।
দোস্ত শোন এহন এই রাইতে মাইয়্যা পাওয়ার কোন সুযোগ নাই।
ঝন্টু বুকের পশম গুলায় হাত বুলিয়ে বলে, মাষ্টারের মাইয়া সুমিরে পাইলে যা হইতো না। টিকু ঝন্টুর দিকে তাকায়, ওর চোখে কামুক দৃষ্টি। ও ঝন্টুকে বলে চল বাহিরে কিছুখন হাটা-হাটি করে আসি, তাইলে মাথা ঠান্ডা হইব।
ওরা বাহিরে হাটতে বের হয়। সুমিদের বাড়ীর পাশে আসার পর, বাড়ীর ভেতরে উকি ঝুকি দেয়। সুমি দরজা খুলে পুকুরের দিকে যায়। টিকু ঝন্টুকে বলে- "দোস্ত তোর মাল এক দিন না তোরে অপমান করছিল। রাস্তায় তুই ফুল দিছিলি সেইটা তোর মুখের উপর ছুইরা মারছিল।
ঝন্টু কেবল বলে "চল"।
এর পরের ঘটনাতো আপনাদের সবারই জানা।
২০১২ সালঃ
মাষ্টার সাহেবের মন খুব খারাপ। তিনি গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তার সামনে তার মৃত মেয়ে সুমির ছবি। তিনি সেই ছবির দিকে গভীর আবেগ নিয়ে বসে আছেন। কে তার মেয়েকে মেরে ফেল্লো? এই প্রশ্নের জবাব তিনি আজও পান নি। এটা ছাড়াও তার মন অন্য কারনে আরো বেশি খারাপ, কারন মেয়েকে তো তিনি হারিয়েছেন, কিন্তু একমাত্র ছেলে বুবুনটা একেবারে বখে গেছে। সুমি মারা যাবার পর থেকেই ও একেবারে চুপ চাপ হয়ে গিয়ে ছিল। এখন হয়ে ছে সন্ত্রাসী। চেয়ারম্যানের ছেলে ঝন্টুর গ্রুপের সাথে থাকে। সব সময় ঝন্টুর পাশে পাশে থাকে। এই ছেলের কোমরে সব সময় পিস্তল থাকে। ঝন্টুর বাপ এবছর আর চেয়ারম্যানি ইলেকশন করবেনা। এবার বাবার জায়গায় দ্বাড়াবে ঝন্টু নিজেই।
কিন্তু ঝন্টুর এবারের জেতার চান্স কম, কারন অপজিসনে যে দ্বাড়িয়েছে রুবেল সে ঝন্টুর চেয়ে বড় সন্ত্রাসী। ইলেকশনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, পরিস্হিতি তত খারাপ হচ্ছে। কে
যে কাকে কখন মেরে ফেলে, বলা মুশকিল।
২০১২ জুন মাসের কোন এক সন্ধ্যাঃ
ঝন্টুর লাশটা উবু হয়ে পড়ে আছে ঝোপের আড়ালে, তাকে ধারালো অশ্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।
বাইরে গুরি, গুরি বৃষ্টি হচ্ছে। মাষ্টার সাহেব একা ঝিম ধরে জানালার পাশে বসে আছে। আবছা অন্ধকারে কেউ একজন উঠন পেরিয়ে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে আসে। মাস্টার সাহেব লোকটার হাটার ভংগী দেখে খুব বুঝতে পারছে এটা, বুবুন। এই ছেলে এখন কেন ঘরে ফিরছে? এর তো গভীর রাতে ফেরার কথা। তিনি ধ্রুত দরজা খুলে দেন। বুবুন ঘরে ঢুকে বাবা কে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেদে উঠে বলে, "বাবা আমি বুবুর খুনের বিচার করেছি, আমি ঝন্টুকে মেরে ফেলেছি। ও ই ছোটবেলায় বুবুকে মেরে ফেলেছিল, কেউ শুনতনা আমার কথা, তখন। ও বলেছিল আমি ওদের নাম বললে তোমাদের মেরে ফেলবে।"
মাষ্টার সাহেব ছেলেকে বুকের ভেতর টেনে নিয়ে বলেন, "বাপরে তুই খুন করেও আজকে আমার কাছে অপরাধী না, তুই আমার মনের সব কষ্ট আজকে দুর করে দিয়েছিস। তোর বুবুও খুব খুশি হবে রে, বাপ ধন।" বলে তিনি বুবুনের রক্ত মাখা কাপর গুলোকে ধুয়ে দেন নিজ হাতে।
শেষ কথাঃ পুলিশ এসেছে লাশ উদ্ধার করতে। কিন্তু কাউকে এ্যারেষ্ট করেনি। কেউ দেখেনি খুন হতে তবে কেউ কেউ ধারনা করছে রুবেলই মারিয়েছে ঝন্টুকে। চেয়ারম্যান সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন, তিনি ধারনা কারতে পারছেন না, কে খুন করতে পারে? ঝন্টু কে। রুবেলকে অনেকে সন্দেহ করছে, কিন্তু তার ধারনা রুবেল এটা করবেনা। কারন রুবেল এমনিতেই এবার জিতে যাবে, ও কেন খুন করার মতন এমন একটা রিস্ক নিবে? কেউ নির্বাচনের সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে, যে কাজটা করেছে সে ভেবেছে এখন মেরে ফেল্লে, সবাই রুবেল কে সন্দেহ করবে। তিনি বুবুন কে ডেকে বলেন, "বাপরে তুই তো ঝন্টুর সাথে সাথে থাকতি, ওর কি ওর বিরধী দল ছাড়া আর কোন শত্রুছিল?" বুবুন টিকুর দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিয়ে বলে, "চাচা জান ঘরের শত্রু বিভিষন।"
এর কিছু দিন পর, টিকু খুন হয়ে যায়। খুনটা চেয়্যারম্যানের নির্দেশে বুবুনই করেছে। এবারও কোন স্বাক্ষী নেই।
মুখ বন্ধঃ এই গল্পের সব গুল চরিত্র কাল্পনিক হলে ও অধিকাংশ ঘটনার সাথে বাস্তবে মিল খুজে পাওয়া যেতে পারে। অধিকাংশ পুরনো দিনের বংলা সিনেমায় পুলিশের একটা কমন ডায়লগ দেখা যায় সেটা হল, "আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না।" আমিও সেই সাবধান বানী এই গল্পটির ক্ষেত্রে ব্যাবহার করছি।
আমাদের দেশটা যেন কেমন, যখন কিছু আরম্ভ হয় মহামারীর মতন আরম্ভ হয়, কিছু উদাহরন দেইঃ
ইভটিজিং, এমন খারাপ অবস্হায় পৌছালো কিছুদিন আগে যে সরকারও বিব্রত হয়ে গিয়েছিল।
গুমঃ আবারও সরকার বিব্রত, আমরা আতংকিত।
মহানবীকে অবমাননা, এবার আমরা বিব্রত রামুতে আগুন।
ইদানিং আরম্ভ হয়েছে ধর্ষণ, এবার আমরা সবাই বিচার প্রার্থী কিন্তু জেন্ডার বৈসম্ম এবং নারীর পোশাক পরার অধিকার নিয়ে টানা-হেচড়া।
আমি কেবল একটা কথা বলি, একটু কড়া ভাষায়ই বলি,
যারা রেপ কে সমর্থন করে তারা যেমন খারাপ। তেমনি যারা অশ্লীল পোশাক সমর্থন করে তারাও সমান দোষে দুষ্ট।
জনাতে চান কেন?
কারন দুই দলই মজা লয় এক দল চোখ দিয়া আর এক দল শরীর দিয়ে।
এবার বলি যারা একচোটিয়া পোশাককে দোষ দেয়। কিছু আছে জন্মগত ভাবে কামুক,
একটা উদাহার দেই, এই অংশ টুকু আমি গল্পেও উল্লেখ করেছি, আমার এক বোন কে নিয়ে সদর ঘাট দিয়ে যাচ্ছি, ও হিজাব পরে বোরকাও। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছেলে হঠাৎ সুর করে বলে উঠল,
বোরকা আলী বুবজান,
মুখ খনা দেখাইজান।
গালে দিমু চুমা,
আমার কোলে ঘুমা।
এদের কে চৌরাস্তার মোড়ে ইট ট্রিটমেন্ট দেয়া উচিৎ।
আমরা সোচ্চার হব রেপের বিরুদ্ধে। রেপ কে কোন যুক্তির মাধ্যমে সমর্থন করা যায়না। এভাবে চলতে পারেনা, না। বিচার ধর্ষকদের হতেই হবে এই বাংলায়।
লেখাটি ইমন জুবায়ের ভাইকে উৎসর্গ করলাম।
ফেইস বুকে আমার পেইজ দেখতে চাইলে নিচের লিংকে যানঃ
View this link
আমার রিসেন্ট একটি লেখাঃ
যে মেয়েটা রোজ রাতে বদলায় হাতে হাতে অথব Let's Rock The Party, Come On Every Body.
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ২:০৯