কৃষ্ণদা....কৃষ্ণদাগো...আমাকে মাফ করেন...ছেড়ে দেন আমাকে...আর দেখবো না আমি...আর যাবো না....আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই....মাফ করেন আমাকে...। পাশে দাড়িয়ে থাকা মারমাটা ছোট ছোট চোখে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠে আমার দিকে চেয়ে। চারিদিকে শুনশান নিরবতা। ঝোপ এর মধ্যে গা শিউরে উঠা সরসর শব্দ। ঘামে জবজব করছে শরীর..বুকটা হাপরের মত উঠানামা করছে...পা এর মাসলগুলো যেন গিটার এর ষ্ট্রিং হয়ে গেছে, কেউ বেসুরো তালে এমনভাবে বাজাচ্ছে যে কেন সময় টাশ টাশ করে ছিড়ে যেতে পারে। কৃষ্ণদা।..আমার পক্ষে আর সম্ভব না। আমি আর যাবো না। কে শোনে কার কথা..কৃষ্ণদা বললেন আমরা প্রায় এসে গেছি...আরও একটু কষ্ট কর...আরও একটু ধৈর্য্য ধর.....
কৃষ্ণদা এর সাথে আমার পরিচয় অনেককাল আগে একটা চ্যাট রুমে। ওই চ্যাটরুমে তার নিক ছিল 'কৃষ্ণ'। তাই তখন থেকেই তাকে আমি কৃষ্ণদা বলেই সম্বোধন করি। এই লেখাতে তার সত্যি নামটা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এমন কটমট করে আমার দিকে তাকালেন যে, সেই সাহস আর করা হয়ে ওঠেনি। সামু ব্লগে তার নিক আপনারা 'পয়গম্বর ' নামেই জানেন। আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন বড়ভাই। দুজনে অনেকদিন ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়েছি। অনেক চা সিগারেট ধবংস করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছি। সেই পয়গম্বর ওরফে 'কৃষ্ণদা' এর সাথে এটাই আমার প্রথম ঢাকা এর বাইরে যাওয়া। সব প্ল্যান প্রোগ্রাম উনার করা। প্ল্যান অনুযায়ী ঈদের পরে গত ০৯/১১/১১ তারিখ বুধবার রাতে গ্রীন লাইনের স্ক্যানিয়া বাসে আমরা দুইজন উঠে পড়ি। উদ্দেশ্য চিটাগং শহর। বিলাসবহুল স্ক্যানিয়া বাসের আরামদায়ক সিটে বসে চারপাশ দেখতে দেখতে যাচ্ছি। কৃষ্ণদা দিকে তাকালাম, দেখলাম উনি গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করছেন। উনাকে বিরক্ত না করে আমি চুপচাপ বাইরে দেখা শুরু করলাম। তখনো জানি না....সামনে কি বিপদ আর রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে...
১০/১১/১১ তারিখ ভোর চারটায় বাস আমাদের নামিয়ে দিল তাদের চিটাগং কাউন্টারে। সবার আগে আমি আর কৃষ্ণদা কাউন্টারে প্রবেশ করে দেখি কয়েকটা সোফা পাতা। এইটা আমার বাংলাদেশ...যা খুশি তাই করবো...এই কথা মনে করে...অনেক যাএীকে দাড় করিয়ে রেখে আমি আর কৃষ্ণদা...দুইটা সোফা দখল করে দিলাম একটা ঘুম....আহহহহ.....কি শান্তি রে মামা....
ভোর সাতটায় শান্তি বিনষ্ট...একটা বিরক্তিকর প্রানী দেখি ডাকাডাকি করছে। চোখ খুলে দেখি আর কেউনা...কৃষ্ণদা....চোখ খুলতেই বললেন চল উই হ্যাভ টু গো আ লং ওয়ে...উঠে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে দুজনে একটা রিকসা নিয়ে চললাম বহদ্দার হাট এর দিকে । ঈদের পর কুয়াশায় ঢাকা শুনশান ভোরের চিটাগং। ভারি কুয়াশা রাস্তায় জমে আছে। একহাত সামনে দেখা যায়না। রিকসাওলা আস্তে আস্তে চালিয়ে নিচ্ছিল। দুজনে বেশ ভয় পাচ্ছিলাম ছিনতাইকারি ভাইদের।কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে কোনরকম দূর্ঘটনা ছাড়াই পৌছে গেলাম বহদ্দার হাট। মুগডাল, ভাজি, গরম গরম পরটা আর চা খেয়ে দুজন উঠে বসলাম শ্যামলী পরিবহনের একটা বাসে। উদ্দেশ্য চকরিয়া। আধো ঘুম আধো জাগরনের মাঝে দিয়ে ঝাঁকি খেতে খেতে যখন চকরিয়া নামলাম...মনে হল আমার ব্রেনটা মনে হয় মাথা থেকেই একটু নড়ে গেছে। এর মাঝেই দেখলাম কৃষ্ণদা কোথা থেকে দৌড়ঝাপ করে চান্দের গাড়ির দুইটা টিকেট নিয়ে এসেছেন সরাসরি লামা যাবার। ফি আমানিল্লাহ বলে উঠে বসলাম চান্দের গাড়িতে। উদ্দেশ্য বান্দরবনের লামা।
উচুনিচু বান্দরবনের রাস্তা পার হয়ে লামা পৌছে উঠলাম কৃষ্ণদায়ের এক পরিচিতজন-এর বাসায়। প্রচন্ড টায়ার্ড আমি। ব্যাগ ট্যাগ রেখে ধপাশ করে বিছানায় পড়লাম। কৃষ্ণদা এসে হুংকার দিলেন আধঘন্টা রেস্ট। এরপর আমরা আবার বের হব। আমি থোড়াই কেয়ার করে দিলাম একটা ঘুম। দেড়ঘন্টা পর শুনি বাশির সুর। কাহিনি কি....কাহিনি আর কিছুইনা ...আবার সেই ভিলেন কৃষ্ণদা....উনি মনের সুখে বাশি বাজাচ্ছেন...আমি আরও আরামে পাশ ফিরে শুলাম....মর জালা...যে বিছানা্য ঘুমাইছি...সেই বিছানার তো চাদরই নেই.....
কি আর করা...উঠে বসলাম...হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে দুজনে একটা হোটেলে গিয়ে পাহাড়ি চালের ভাত আর দেশি মুরগির রান খেয়ে রওনা দিলাম কাছাকাছি একটা মারমা পারার দিকে। মারমা পাড়াতে দেখলাম পাহাড়ের জংগলের মাঝে একটা খুব সুন্দর বৌদ্ধমন্দির। ঘুরেফিরে দেখছি। এমন সময় সাথে থাকা এক স্থানীয় মারমা জানাল এখানে অনেক সাপ আছে..রাতে মন্দির পাহারা দেয়। ....লে হালুয়া....আর যাবা কই....সাথে সাথে সেই স্থান ত্যাগ করে মারমাদের একটা গ্রামে গিয়ে ঘুরলাম...চুরুট, ডাব খেলাম।
মাতামুহুরী নদীর পাশের মার্মা গ্রামে দাঁড়িয়ে উদাস আমি
সন্ধ্যায় গেস্টহাউজে ফিরে গল্পের বই পড়ায় মন দিলাম..কৃষ্ণদাকে দেখলাম খালি ছটফট করছে....একটু পর পর বাইরে যাচ্ছে...আবার ফিরছে...ঘটনা কি ভাবতেছি...এমন সময় দেখলাম উনি এক বোতল পাহাড়ী মদ নিয়ে ফিরলেন। স্থানীয় ভাষায় যার নাম " আরা " । সেই 'আরা' খেয়ে আমাদের কি দশা হয়েছিল যদি জানতে চান, তাড়াতাড়ি এই লেখাটা পড়ার পরএখানে ক্লিক করেন।
পরদিন ভোর সাতটায় শুরু হল আমাদের যাএা। উদ্দেশ্য চিয়ংমুরং পারা। লামা উপজেলা থেকে অনেক ভিতরে একটা পাহাড়ের উপরে। চান্দের গাড়িতে বুড়িরঝিরি যেতে যেতে কৃষ্ণদাকে জিজ্ঞেস করলাম, পাহাড়ে উঠার কি ব্যবস্থা ? কতটুকু উঁচু ? ....পাহাড়ে উঠার কোনো ব্যবস্থা নাই...পায়ে হেটে উঠবা..অল্প উঁচু। গম্ভীরমুখে জবাব দিলেন কৃষ্ণদা।
জবাবে তুষ্ট হতে পারলাম না...এর কারণটা জানার জন্য এখন একটু আমার সম্পর্কে বলি। আমি একটা নাদুস নুদুস আগুনের গোলা টাইপ পোলা। হাঁটা-হাঁটি আমার একদমই ভালো লাগেনা। যেখানেই যাই হয় রিকসা অথবা গাড়িতে যাই। লোকাল বাসে চড়ার অভিজ্ঞতাও আমার কম। ঢাকার বাইরে কোথাও গেলে গাড়ি নিয়ে যাই....আর কোথাও নৌকা, ট্রলারে উঠা হলে এ্যডভেন্চার ...এ্যডভেন্চার বলে চিল্লাই।
সে যাই হোক...নতুন ধরনের এ্যডভেন্চার হবে এই কথা ভাবতে ভাবতে বুড়িরঝিরি এসে পৌছালাম। তারপর দেখি ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে পায়ে হাটা পথ চলে গেছে। আরেহহহ...এই রাস্তা তো আমর জন্য লেনটিল রাইস এই কথা মনে করতে করতে সবার আগে আগে হাটা শুরু করলাম। এক ঘন্টা হাটার পর আমার দম শেষ। আর হাটতে পারি না। এমন সময় কাইম্পা পাড়া নামে একটা আদিবাসি পাড়াতে পৌছলাম। ওখানে পৌছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওয়ানা দিলাম চিয়ংমুরং পাড়ার দিকে।
চিয়ং মুরং পাড়ার দিকে হেঁটে চলেছি আমরা
ঝিরিপথ পার হচ্ছি আমরা
ভেবে পাচ্ছিলামনা, এই কর্দমাক্ত রাস্তা পার হবো কিভাবে
যতই আগাই ততই পাহাড়ের সৌন্দর্য বাড়ে আর রাস্তা খারাপ হয়। কোথাও উঁচু...কোথাও নিচু...আবার কোথাও পিচ্ছিল ঝিরিপথ। যেতে ..যেতে আমি ক্লান্ত....দুবার বসলাম...বিশ্রাম নিলাম। তৃতীয়বার যে বসব তার আর উপায় নাই। এক দিকে পাহাড় খাড়া উঠে গেছে। আরেকদিকে পাহাড় খাড়া নেমে গেছে। মাঝখানে কোনমতে একজন মানুষ দাড়াতে পারে এমন সরু রাস্তা। তাও আবার আমার ওজনে হুরমুর করে ভেঙে পরে কিনা তাই ভাবতে ভাবতে অস্থির। অনেক কষ্টে একটা ঘন জংগলের পাশে বসছি। কৃষ্ণদা অনেক দুর আগাইয়া গেছেন উনার গাইড নিয়ে। আমি মারমা গাইড সহ বসে আছি....শুনশান নিরবতা। কিন্তু শান্তি নাই..জংগলে সরসররর শব্দ।ভয় লাগছিল। অনেকক্ষন বসে থাকার পর কৃষ্ণদা আবার আমাদের খুঁজতে ফিরে এলেন। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম। "কৃষ্ণদা.........আর যাবো না...................."
পাহাড়ী ঝিরি পার হচ্ছি আমরা
এখানে বসেই বলেছিলাম 'আর যাবোনা'
কৃষ্ণদা বললেন এতদুর এসে আর ফেরত যাবার কোন মানে হয় না। আরেকটু কষ্ট করে চল। ফেরার পথে আমরা অন্য একটা সহজ পথ দিয়ে যাবো। আমি বললাম তো সেই সহজ পথ দিয়ে এখন যাচ্ছিনা কেন ? উনি বললেন সেই পথ তো এখন চিনিনা...উপরে উঠে কাউকে জিজ্ঞেস করে তারপর যাবো। আমি ফেলে আসা সেই ভয়ংকর পথে আবার যেতে হবে মনে করে..মনের সব সাহস একসাথে করে বললাম, "ঠিক আছে...তাহলে চলেন"।
দুর্গম পাহাড়ী পথে আমরা হেঁটে চলেছি
ঝিরি পথের রাস্তা
চিয়ংমুরং পাড়াতে উঠার আগে আগে সত্তুর ডিগ্রি বা তার থেকে বেশি খাড়া একটা ছোট পিচ্ছিল রাস্তা আছে। সেইখান থেকে আমি নিশ্চিত পরেই যেতাম, যদিনা আগের দিনের হেভী গ্রিপওয়ালা স্যান্ডেল না কিনে নিতাম আর হাতে লাঠি না থাকত।থ্যাংকস টু কৃষ্ণদা, তিনিই আমাকে জোর করে লামা থেকে এই বদখত চেহারার স্যাণ্ডেলটা কিনিয়েছিলেন।
বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা
ঝিরি পথে এগুচ্ছি আমরা, পথ যেন আর শেষই হতে চায়না
যাই হোক অবশেষে উঠলাম সেই পাহাড়ে...উঠেই তো আামার চক্ষু চড়কগাছ।কারণ, শুনেছিলাম মুরংরা ছোট ছোট জামা কাপড় পরে। আমি দেখলাম এরা তো ছোট জামা কাপড় দূরে থাক। কিছুই পরে না। মেয়েরা শুধু কোমড়ের কাছে ছোট স্কার্ট টা্ইপ একটা পোশাক পরে থাকে। সারা গায়ে আর কিছু থাকে না। এমন মানুষ টিভি তে আফ্রিকার জংগলে দেখেছি। আমাদের দেশেও যে আছে, তা আমার জানাই ছিল না। কৃষ্ণদা বললেন চোখ ও মন খুব সাবধান...নয়ত বিপদ হবে। গ্রামে তখন কোনো পুরুষ ছিল না। তাই তাদের পোশাক কেমন তা আর বলতে পারলাম না।
তো যা বলছিলাম...পাহাড়ে উঠে আমি তো মাটিতে লুটাইয়া বসে বেহুশ এর মত হাপাচ্ছি আর ঢোক..ঢোক করে পানি খাচ্ছি। একটু যখন সুস্থির হলাম..নাকে কিসের যেন গন্ধ লাগতে লাগলো...ভাল মত চেয়ে দেখি.............শিট...........গোবরের গন্ধ.........তাও আবার শূকরের গোবর। আমি তার বেশ কাছেই বসে আছি....আর আশপাশ দিয়ে শূকরগুলো হেটে বেড়াচ্ছে....ইয়াকককককককক থুহহ্ঃ
অনেক উঁচু চিয়ংমুরং পাড়া দেখে ভয়ে আমি শেষ, কারণ আমার হাইট ফোবিয়া রয়েছে
লাফ দিয়ে উঠে যখন আশেপাশে যখন একটা ভালো বিশ্রাম নেবার জন্য জায়গা খুঁজছি...তখনি আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে এল। হাটু কাপতে লাগলো...মাথা ঘুরতে লাগলো...কারন আমরা যে পাহারে উঠেছি সেই পাহাড়টা ঐ স্থানের সবথেকে উঁচু পাহাড়। তার তুলনায় অন্য পাহাড়গুলোকে মনে হচ্ছিল যেন একটা ছয় ফুট লম্বা মানুষের পাশে একটা দুই বছরের বাচ্চা দাড়িয়ে আছে। কৃষ্ণদায়ের চালাকিটাও সাথে সাথে বুঝে ফেলি ....দেয়ার ইজ নো অল্টারনেট ওয়ে টু গেট ডাউন। বেওয়াফা কৃষ্ণদা।
পাহাড়ে উঠে ক্লান্ত হয়ে গেছি...আজকে আর লিখবো না....বিদায়....
বি:দ্র: শুনেছি কৃষ্ণদা ওরফে ব্লগার পয়গম্বর ভাই তার ব্লগে আমাকে নিয়ে বেশ ভালো পচিয়েছেন। আপনারা ভুলেও ওই লেখাটা পড়তে যাবেন না। আফটার অল আমার ইজ্জত কা সওয়াল।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:৪৯