
বিয়ের পরপরই রত্নাকে কে যেন কানে কানে বলেছিল, ‘তোমার পথ চলা একার। তোমার কোন জোড়া নেই।’ কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়েছিল। ক’দিন হলোতো বিয়ে হয়েছে। নতুন জীবন শুরু হয়েছে। এসব ভাবনা কেন তার মনের মাঝে আসে? রত্না বুঝে উঠতে পারেনি তখন।
আর আজ?
প্রায় ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত। ত্রিশ না হলেও ২৭ বছর তো হবেই। রত্নার পথ চলা একার। সঙ্গীবিহীন।
একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরী করে। নাইন টেনে অঙক, বিজ্ঞান পড়ায়। বেতন নামমাত্র। এসব চাকরীতে প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসর ভাতার - প্রশ্নই আসে না। প্রাইভেট স্কুল না?
চাকরের মত মনে করে রত্নাকে, স্কুলের মালিক কাম পরিচালক। ধমক ধামক দিলে থাকবে না আবার ? আরো বেশী সমীহ করবে, আরো ভয় পাবে। মুখ বুজে কাজ করে যাবে কাজের বুয়ার মত। কিন্তু কি জানি কেন, রত্নার এসব ভাল লাগে নি। সে চাকরীটা ছেড়েই দিল। বনানীর রাস্তা দিয়ে যেতে ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকে স্কুলের বেতন জমা হতো । এখন চাকরীও নেই, ব্যাংকের সাথে কোন লেনা দেনাও নেই। সচরাচর তাই এদিকে আর আসা হয় না রত্নার ।
কিন্তু সেদিন অন্য একটি কাজে রত্না হেঁটে যাচ্ছিল ঐ রাস্তা দিয়ে। শুকনো দিন। এত বড় রাস্তা আর শেষ হয় না। পথ যেন খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছে। হঠাৎ খুব বাতাস বইতে শুরু করলো । কি অদ্ভুত ! বাতাসের তোড় প্রচন্ড হচ্ছে । যেন টর্নেডোর মতন। ক্ষেপে গেছে প্রকৃতি। কারোর ওপর ক্ষেপে গিয়ে সে আচমকা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। রাস্তার পাতাগুলো ,ধূলাবালি, ময়লাগুলো ঘূর্ণি খাচ্ছে। রত্না আকাশের দিকে তাকালো । দেখলো মেঘ জমেছে। কিন্তু বৃষ্টি হবার মতন নয়। দিনতো খুব শুকনা ছিল। আচমকাই যেন কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে।
কে ঘটাচ্ছে?
কেন?
রত্না বুঝবার আগেই প্রচন্ড বাতাসের সাথে শুরু হলো ঝম ঝম বৃষ্টি। এ রাস্তার শেষ প্রান্তে যাবার কোন সুযোগ নেই। বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ায় টেকাই যাচ্ছেনা। হাঁটাও দায়। যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবে । আশ্রয় নিতেই হবে কোথাও। পাশে সেই ইস্ট ওয়েস্ট ব্যাংকের পোর্টিকো তে রাস্তার সবাই জড়ো হয়েছে। বিকেল চারটা বেজে গেছে। তাই ব্যাংকের সামনের দরোজা বন্ধ। কেউ ঢুকতে পারছে না ভিতরে। সবাই গাদাগাদি করে ওই অতটুকু জায়গার মাঝে ঠাঁই নিয়েছে। রত্নাও এসে তাদের সাথে সামিল হলো। তার ভাগ্য যেন তাকে ঠেলে এখানে পাঠালো।
রত্না বুঝে উঠতে পারছে না ব্যাপারটা। একটু খটকাও লাগছে প্রকৃতির আকস্মিকতা দেখে। সে ভাবলো, জীবনের যেন নিশচয়তা নেই। শুকনো মেঘলা দিন হঠাৎ -ই বদলে বাদললা দিনে টার্ন নিল।
এমন কেন হলো?
তার জন্য তো বিশেষ করে হয়নি। রাস্তার পথচারীরা সবাই এই দুর্যোগে আক্রান্ত।
সামনে তাকিয়ে দেখলো একটা সাদা গাড়ি ঢুকছে ব্যাংকের চত্বরে। পার্কিং -এ না থেমে বিল্ডিং এর দিকে এগিয়ে আসছে গাড়িটা। প্রচন্ড বৃষ্টি তো। হয়তো কাউকে নামিয়ে দেবে বলে পোর্টিকোর দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু এখানে তো অনেক লোক গাদাগাদি করে দাঁড়ানো। গাড়িটা কোথায় দাঁড়াবে?
আবার থামার তো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বেশ অবাক হচ্ছে ড্রাইভারের চালনা দেখে। এতটুকু জায়গায় গাড়ীটা যেন মানুষের ওপর তুলে দেবে এমন ভাব। সত্যই যেন তাই হলো। গাড়িটা এসে রত্নার গায়ের উপর পড়তে পড়তে পায়ের কাছে কোনমতে থামলো। চাকাগুলো রত্নার আংগুলগুলো থেতলে দেয় বলে। অল্পের জন্য বাঁচোয়া।
সে দেখলো খ্যাট -খ্যটা মেজাজের একটা লোক গাড়ি থেকে নামতে নামতে ড্রাইভারকে বলতে লাগলো ‘আগাও, আগাও। আরো আগাও। গাড়িটা তুলে দাও, তুলে দাও মানুষের ওপর।’
গাড়ীটা রত্নার পায়ের ওপর তোলার কারণেই খ্যাট খ্যাটা লোকটা যেন রত্নাকে উদ্দেশ্য করে ড্রাইভারকে বকা দিয়ে উঠেছিল। মানে সরাসরি নয় কিন্তু রত্নাকে জানান দিচ্ছিল যে তারা খুব দুঃখিত ড্রাইভারের এমন আচরণের জন্য। আরেকটু আগালেই তো অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেত। ভীড়ের মাঝে রত্না আর কতটুকুই বা সরতে পারতো?
পারতো না। আর জায়গা ছিল না।
লোকটা নেমে চলে গেল ব্যাংকের পিছনের গেইটে। মানে সে জানে এখন ব্যাংকের সামনের দরজা বন্ধ। লোকটা ৫০ বছর বয়স্ক হবে। শুকনা, লম্বা, কাঁচা পাকা চুল। খুব বুদ্ধি সম্পন্ন গার্জিয়ান সুলভ ভাব ভংগীমা। মানে গাড়ির মালিক বুঝা যাচ্ছে। ড্রাইভারের পাশে সিটে বসা ছিল।
লোকটা নেমে যেতেই গাড়িটা পিছনে বাঁক নিল। এবার সে পার্কিং এ যাবে। জানালা দিয়ে একটা ছেলে বয়স ২২/২৩ হবে, ঘাড়টা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে আর চারপাশ বুঝার চেষ্টা করছে। যেন ৫/৬ বছরের শিশুর মতন। রত্না আরেকটু ভাল ভাবে খেয়াল করে দেখলো ছেলেটি আর কেউ নয়। এই সেই তার ভোলাভালা স্বামীপ্রবর - আবিদুর। সেই ২৭ বছর আগের সংসার যাত্রা শুরু করেছিল যার হাত ধরে। সেই আবিদুর, এই গাড়িতে বসে আছে। আরো ইয়ং লুকিং হয়েছে। ৩০ বছর পর মনে হচ্ছে বয়স তার আরো কমে ২০/২২ বছরে ঠেকেছে । তখনই তো ছিল ত্রিশ। এখন ৫৭ হবার কথা তা হলে। কিন্তু এতো বয়সে আরোও শিশু সুলভ নির্মল সাধাসিধে ভাব এসেছে চেহারায়।
খ্যাট -খ্যাটা মেজাজের লোকটা মনে হয় আবিদুরকে দেখা শোনা করে।
ঘটনাগুলো যে রত্নার জন্যই এত দ্রুত ঘটছে এমন ভাবার তো কারণ নেই।
কিন্ত গাড়িতে আবিদুর কেন উপবিষ্ট?
এ সকল দৃশ্য কেন রত্নার সামনে ঘটে চলছে? - আচমকা ঝড়ের সূত্রপাত। তারপর ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও এই স্থানে এসে আশ্রয় নেয়া। একা নয় । সকল পথচারীদের সাথে – সেই ব্যাংকের বারান্দায় যেখানে সাদা গাড়ি এসে থামবে। গাড়ি থেকে কেউ কথা বলবে রত্নার সাথে গায়ে গাড়ি উঠানোর ব্যাপারে। রত্না আরো মনোযোগী হয়ে দেখবে গাড়িতে কে আছে? জানালার কাঁচ খোলা বলে দেখাটা স্পষ্ট হবে। সেই গাড়ি যে কিনা আবিদুরকে নিয়ে এসেছে এখানে।
আবার প্রশ্ন এলো মনে, বিষয়গুলো কি রত্নার জন্যই ঘটেছে?
কিন্তু কেন?
আজ ২৭ বছর পর কার ইচ্ছা হলো আবিদুরের হাল হকিকত রত্নাকে দেখাবার?
আবারো সেই প্রশ্ন - কেন?
রত্নার তো সেই সব দিন অনেক আগেই গত। রত্না কোন রকমে প্রতারক ঐ পরিবার থেকে প্রাণটা নিয়ে ফেরত চলে আসার পর আবিদুর তো এই মুখী হয়নি। আবিদুর কে তার বাবা যা বুঝিয়েছে সে তাই বুঝেছে। মানসিক প্রতিবন্ধী আবিদুরের স্মৃতি তো তার মাথায় বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ার কথা না। সে অবস্থায় তারা থাকেও না। তাদের মস্তিষ্কের গঠণ আলাদা।
তার বাবা যদি তাকে বলে ‘সব ভুলে যাও’, সে ঠিকঠিক ভুলে যাবে। রত্নার জায়গায় আবিদুরের বাবা পরবর্তীতে তার জন্য হীরা, মুক্তা, পান্নার থেকেও ভাল ভাল বৌ এনে দেবে। আবিদুর তাতেই খুশী হবে।
তাহলে এত বছর পর রত্নার সামনে প্রকৃতি কেন এই ঝড়ের সূচনা করলো?
বড্ড রসিক অথবা বলবো, বড্ড বেরসিক এই প্রকৃতি। রত্নার সাথে সে বিদ্রূপ করতে ছাড়েনি। রত্নার ঘাড়ে মানসিক ভারসাম্যহীন, প্রতিবন্ধী একজনকে চাপিয়ে দিয়ে, প্রকৃতি সেই নির্মম প্রহসন কেন করেছিল রত্না তা আজও জানে না।
আর আজকে?
ভীড়ের মাঝে রত্নার ঘাড়েই এসে পড়লো গাড়িটা! আর জায়গা ছিল না? সময়টাও কি সুন্দর মিলে গেছে।
ঝড়ে বক মরে,ফকিরের কেরামতি বাড়ে। পক্ষান্তরে কাকে দেখাবার জন্য এ ঝড় বৃষ্টির কেরামতি?
ঝড় এলো।
ঝড়ে বকও মরলো আর ফকির কেরামতি করে রত্নাকে ‘আবিদুর দর্শন’ করিয়ে দিল।
রত্না না চাইলেও প্রকৃতির উপর তো তার হাত নাই।
২৮/১১/২০২৫
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



