আমাদের দেশে একসময় একটা ঐতিহ্য ছিলো। জন্মের পরই বাবা-মা স্বপ্ন দেখা শুরু করত তার ছেলে/মেয়ে হয় ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার হবে। এবং এই কথাটা তারা ছেলেমেয়েদের মনেও বেশ দৃঢ়ভাবেই গেথে দিত। তার উপর আবার প্রাইমারী/মাধ্যমিকে লেভেলে রচনা, ভাবসম্প্রসারণে যেভাবে ডাক্তারী পেশাকে একটা মহান পেশা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাতেও অনেক ছেলেমেয়ের মনেই ডাক্তারী/ ইঞ্জিনিয়ারিং এর বাইরের কোন পেশার কথা মাথায়ই আসত না। এমন একটা আবহ তৈরি হয়েছিলো যেন ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার না হতে পারলে জীবনই বৃথা !!
যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দেশ অনেক এগিয়েছে। মানুষের পেশা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গিও বদলেছে। কিন্তু এখনও মানুষ এই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার চক্রের ভিতর থেকে বের হতে পারেনি !! যতই আমরা নিজেদের দেশকে ডিজিটালাইশনের কথা বলি, যতই বলি আমরা দিন দিন আধুনিক হচ্ছি, আসলে আমরা যে তিমিরে ছিলাম এখনও সেই তিমিরেই আছি !! একটা প্রজন্মের স্বপ্ন যখন শুধু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মাঝেই আটকে যায় তখন আসলে নিজেদেরকে আধুনিক দাবি করা ঠিক না।
যাই হোক, সবাই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে আসলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। কারণ এমনিতেই দেশে মাথাপিছু ডাক্তারের সংখ্যা অনেক কম, তারউপর আবার ডাক্তাররা কেউ গ্রামে যেয়ে চিকিৎসা সেবা দিতে চান না সুযোগ-সুবিধার অভাবে। তাই এই দেশে ভালো ডাক্তারের চাহিদা আজীবন থাকবেই। তাই পেশা হিসেবে ডাক্তারী অনেক নিরাপদ একটা পেশা। অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং হচ্ছে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বেশ মর্যাদার একটা পেশা। ইঞ্জিনিয়ার হতে পারলে আত্নীয়- স্বজনদের মাঝে গুরুত্ব বাড়ে। সরকারী ইঞ্জিনিয়াররা এইদেশে রাজার মতই মর্যাদা পায়। অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বেসরকারী খাতও ক্রমবর্ধমান। তবে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে দোষটা কোথায়? দোষ আছে।
আমাদের দেশে ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্ন-প্রত্যাশার চাহিদা অনুসারে মেডিকেল কলেজ আর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা নিতান্তই কম। এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেতে এক একজন ছাত্র-ছাত্রীকে বিপুল প্রতিযোগিতার মাঝ দিয়ে যেতে হয়। এমনও দেখা যায় যে, একটি সিটের বিপরীতে প্রায় ৫০ জন পরিক্ষার্থী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে !! যেখানে প্রতিযোগিতা এমন তীব্র সেখানে শিক্ষার্থীদের উপর কি রকম চাপ পড়ে তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি !! তারউপর আবার আছে “ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে না পারলে জীবনটাই বৃথা !!” এই ধারণা।
সীমিত সংখ্যক সিট কিংবা প্রত্যাশার চাপ যে কারণেই হোক না কেন- সবাই মেডিকেল কলেজ কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে পারে না !! এবং তখনই হতাশা চেপে ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবনে প্রবেশ করতে যাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের উপর। ব্যর্থ হলে অনেকেই ভেঙ্গে পড়ে। কেউ ভাবে যা হয়েছে ঠিক আছে, আমি আবার দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিব। আর কেউ চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতো আছেই, এত চিন্তার কি আছে !! (যদিও এদের সংখ্যা নিতান্তই কম)
যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার আগেই হয়ে যায় সেহেতু ধরেই নেওয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের একটা বড় অংশের মাঝেই একধরনের হতাশা কাজ করে। সেই হতাশাকে কাটিয়ে উঠে খুব কম ছাত্র-ছাত্রীই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হয়। এমনকি এই ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে অনেক জিপিএ পাঁচ পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা অকৃতকার্য পর্যন্ত হয় !! এমন নাযে এসব পরীক্ষায় খুব কঠিন আইকিউ টেস্টের মত প্রশ্ন আসে, বরঞ্চ কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন এইচ.এস.সি লেভেলের চেয়ে অনেক সহজ হয় !! শুধুমাত্র অত্যধিক প্রত্যাশা আর প্রত্যাশা পুরণ না হওয়ার হতাশা থেকে সৃষ্ট চাপের কারণে শিক্ষার্থীরা এই ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়।
চলবে……………