(ছবিঃ বড় কাটরা এবং ছোট কাটরা, যা স্যার চার্লস ডি'ওইলি যথাক্রমে ১৮২৩ এবং ১৮১৭ সালের দিকে অঙ্কন করেছিলেন।)
বন্ধু পায়েলকে সকাল সকাল উঠিয়েছি। আজ ওকে নিয়ে পুরান ঢাকার চকবাজারের দিকে যাব। শায়েস্তা খাঁর আমলে তৈরি বড় কাটরা এবং ছোট কাটরা নামের দুটি প্রাচীন স্থাপনা নাকি ওইদিকটায় এখনও টিকে আছে। তো পরিকল্পনা মোতাবেক সকাল আটটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম চকবাজার থানার সামনে। সেখানে গিয়ে স্থানীয় এক দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করার সাথে সাথে ভদ্রলোক পথ বাতলায়ে দিলেন। চকবাজার মসজিদটা পার হয়ে একটু সামনে গিয়েই একটা সরু গলির ভেতর ঢুকে পরলাম। সোজা খানিকটা যাবার পরেই চোখে পড়ল এই ধ্বংসাবশেষ।
হ্যাঁ, এটাই ১৬৪১ সালে সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা দ্বারা নির্মিত বড় কাটরার বর্তমান চিত্র।
(ছবিঃ ১৮৭০ সালে বড় কাটরা)
কাটরাটি শাহ সুজা তার প্রধান স্থপতি দিওয়ান মীর মোঃ আবুল কাসেমকে দিয়ে তৈরি করান। জানা যায়, মধ্য এশিয়ার ক্যারাভান সরাই-এর ঐতিহ্য অনুসরণ করেই এই কাটরা নির্মাণ করা হয়।
(ছবিঃ ১৯১০ সালের দিকে বড় কাটরা)
এটি মুলত মুসাফির খানা হিসাবেই ব্যবহার হয়ে এসেছে। ২০ টিরও অধিক কক্ষ সম্বলিত এই ভবনে ভ্রমণকারীরা বিনে পয়সায় সেবা লাভ করত।
(ছবিঃ বড় কাটরার ভেতরে)
বড় কাটরার ফটকে ফার্সি ভাষায় শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজী লিখিত একটি পাথরের ফলক পাওয়া গিয়েছিল। যেখানে লেখা ছিল,
“সুলতান শাহ্ সুজা সব সময় দান-খয়রাতে মশগুল থাকিতেন। তাই খোদার করুণালাভের আশায় আবুল কাসেম তুব্বা হোসায়নি সৌভাগ্যসূচক এই দালানটি নির্মাণ করিলেন। ইহার সঙ্গে ২২টি দোকানঘর যুক্ত হইল- যাহাতে এইগুলির আয়ে ইহার মেরামতকার্য চলিতে পারে এবং ইহাতে মুসাফিরদের বিনামূল্যে থাকার ব্যবস্থা হইতে পারে। এই বিধি কখনো বাতিল করা যাইবে না। বাতিল করিলে অপ্রাধী শেষ বিচার দিনে শাস্তি লাভ করিবে। শাদুদ্দিন মুহম্মদ সিরাজি কর্তৃক এই ফলকটি লিখিত হইল।"
আফসোস! আবুল কাশেম সাহেবের দেয়া ‘শেষ বিচারের দিনে শাস্তির’ ভয় কেউ আর পায়নি বোধহয়। বর্তমান অবস্থা অন্তত সেই কথাই বলে।
যাক গে, কিঞ্চিত হতাশা নিয়ে বড় কাটরা থেকে বের হয়ে হাটতে লাগলাম ছোট কাটরার উদ্দেশ্যে।
(ছবিঃ স্যার চার্লস ডি'ওইলি যা এঁকে গিয়েছিলেন)
ছোট কাটরার সামনে যখন এসে দাঁড়ালাম তখন কিছু বলার মত আমি আর ভাষা খুঁজে পেলাম না। চিৎকার করে কতক্ষণ কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।
বড় কাটরার তো তাও ভেতরে ঢুকতে পেরেছিলাম, আর এই ছোট কাটরার ভেতর বলতে আসলে কিছু নেই। এই একটা ভাঙ্গা দেয়াল যা পড়ে আছে তাই।
(ছবিঃ ১৯৯০ সালে ছোট কাটরা)
আনুমানিক ১৬৬৩-৬৪ সালের দিকে শুরু হয়ে ১৬৭১ সালের দিকে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এটি দেখতে নাকি বড় কাটরার মতই ছিল, শুধু আকারে বেশ ছোট ছিল। মুলত প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়।
শায়েস্তা খাঁর আমলের এই দুটি স্থাপত্য বহু চেষ্টা করেও নাকি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তাদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি। আর তাই এই দুটি ইমারত এখন প্রায় ধ্বংস। আর এমন ধ্বংসাবশেষ দেখে আমার মনও যে বড় অসন্তুষ্ট। যাক গে, কি আর করার? অসন্তুষ্ট হৃদয় এবং কিছু হতাশাকে সঙ্গে নিয়েই সেদিনকার মতন বাড়ির পথে ফিরে এলাম।
-২০/আগস্ট/২০১৫ ইং, ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৩১