পড়াশোনা করে কি হবে সেই প্রশ্নের যথোপযুক্ত উত্তর দেওয়া ছাড়া যতই মোটিভেশানের মধু গেলানো হোক না কেন তাতে মিষ্টি লাগবে না।
~তুহিন পড়াশোনায় তেমন ভালো নয় তাই বাবা-মা ছোট বেলাতেই রাজমিস্ত্রীর জোগালির কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। কিছু সময় পর একজন দক্ষ মিস্ত্রি হয়ে বিদেশে পারি জমিয়ে বাড়িতে এসে দালান করেছে। করোনার এই সময়টুকুতে দেশে বসে পরিবারের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে, আর সারাদিন বন্ধুদের সাথে বাইক রাইড দেয়-
~ইমন খুব ফাঁকিবাজি টাইপের ছেলে। পড়াশোনায় ফাঁকি দিলেও কাজে ছিলো মনোযোগী। ড্রাইভিং পেশায় সাহেব তাকে বিশ হাজার টাকা সেলারি দেয়, থাকা খাওয়া মালিকের উপরে। এতোদিনের কিছু কিছু করে জমানো টাকায় কেনা সিএনজি ভাড়া দিয়ে এখন অতিরিক্ত হিসেবে মাসে বারো হাজার টাকা করে আসছে। অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ায় কয়েকমাস আগে বিয়ে করে এখন বাবুর মুখ দেখার অপেক্ষায় আছে-
~মনির পড়াশোনায় খারাপ না হলেও একটা পর্যায়ে বুঝতে পারে যে পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি পেয়ে বাবা-মার মুখে হাসি ফুটানোর মতো সময়টুকু সে পাবে না, তাই পড়াশোনার পাশাপাশি থাই গ্লাসের কাজ শিখে কোনোরকম এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে এখন ফুল টাইম থাই গ্লাসের কাজে নেমে পড়েছে। দেশে খুব ভালো বেতন পাচ্ছে না বলে কিছু জমি বিক্রি করে টাকা জমা দিয়ে রাখছে। করোনার প্রকোপ শেষ হলেই হয়তো বিদেশের মাটিতে পা দিতে পারবে নতুন ভবিষ্যতের হাতছানি তে-
অন্যদিকে
~নিলয় পড়াশোনায় ভালো হলেও দেশের সেরাদের সাথে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠতে পারে নি, শেষ দিকের একটা পাবলিকে একটা ভালো বিষয়েই অনার্স কম্পলিট করেছে, শুধু ফলাফলটা আসতে বাকি। ছোট বেলা থেকে সে টিউশন করিয়ে মাসে ছাত্র প্রতি ৩০০ টাকা করে পেতো, যেখানে ওর বন্ধুরা স্কুল ফাকি দিয়ে একদিন কাজে যেতে পারলেই ৩০০ টাকা পেয়ে যেতো। নিলয়ের এক মাসের পরিশ্রম ওর বন্ধুদের এক দিনের পরিশ্রমের সমান। তারপরও সে আশা ছাড়ে নি এটা ভেবে যে, তাদের এই দৈনিক আয় টা কিছু বছর পর খুব না বাড়লেও সে যখন একটা বড় চাকরি নিতে পারবে তখন মাসে অনেক টাকা সেলারি পাবে, তাদের থেকে অনেক বেশি-
এখন বয়স পরিপক্ব হওয়ায় নিষ্ঠুর বাস্তবতা চাক্ষুষ করতে পারছে, ১২০০০ হাজার টাকার সোনার হরিণ পাওয়াটাও কতটা অসম্ভব! যেখানে এটা শহুরে রিক্সাচালকদের মাত্র ১২ দিনের আয়। ছোট বেলা থেকেই মানসিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত হওয়ায় তার পক্ষে এখন হুট করে শারীরিক পরিশ্রম করাটা সম্ভব নয়। তার শরীর সেভাবে গড়ে উঠে নি, যাতে দিনের পর দিন রিক্সার প্যাডেল চাপাটা তার শরীর সহ্য করতে পারবে। সে তো জীবনটাই পার করেছে মানসিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য, শরীরের প্রতি সেই মনোযোগটা কখনো ছিলো না-
যেই শিক্ষিতদের চেয়ে একজন রিক্সাওয়ালার আয় বেশি তারা কি শিক্ষা অর্জন করেছে এই প্রশ্নে মেয়ের বাবা কখনো মেয়ে দান করতে চায় না। অপাত্রে কন্যা দান করবে কে? ১২০০০ হাজার টাকা সেলারি থেকে প্রতি মাসে ৫০০০ টাকা সেইভ করলেও কাবিনের ৫ লাখ টাকা জমানোর জন্য তাকে প্রায় সারে আট বছর অপেক্ষা করতে হবে। অথচ এখনো সে চাকরিটাই পায় নাই!
~তাহলে পড়াশোনা করাটা কি বৃথা?! না, বৃথা নয়। পড়াশোনার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো, নৈতিকতা অর্জন ও বিবেকবোধ জাগ্রত করা। কিন্তু নৈতিকতা প্রয়োগ ও বিবেকবোধ চর্চা করার ক্ষেত্রটা যদি না থাকে তাহলে সেই শিক্ষার কোনো মূল্য থাকে না।
এজন্য পড়াশোনাটা হতে হবে অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে, যেহেতু যুগটাই এখন ক্যাপিটালিজমের। এতে করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি নূন্যতম বিবেকবুদ্ধি হলেও জাগ্রত হবে। শুধু বিবেকবুদ্ধির কোনো মূল্য নেই। পেটে যদি ভাত দেওয়া না যায়, স্ত্রীকে সাথে নিয়ে যদি কোথাও ঘুরতে যাওয়া না যায়, সন্তানদের পছন্দমতো জামাকাপড় কিনে দেওয়া না যায়, বৃদ্ধ বাবা-মার চিকিৎসার খরচ যোগানো না যায় তাহলে, "সেই নৈতিকতা লইয়া আমি কি করিবো!"
~পরবর্তী জেনারেশন আমাদের এসব কার্যকলাপকে পর্যবেক্ষণ করছে আর অসচেতন মনে তাদের মাথায় এটা সেট হয়ে যাচ্ছে যে, পড়াশোনা করে যেহেতু স্বাবলম্বী হওয়া যাচ্ছেই না তাহলে যেভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায় সেই পথটুকুতে পা বাড়াতে হবে। এতে করে তারা পড়াশোনা থেকে দূরে গিয়ে নৈতিকতা বিবর্জিত দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগী হচ্ছে। জন্মগত নৈতিকতা যেহেতু সবাই পায় না তাই অনেকেই টাকা উপার্জনের শর্টকাট উপায়; বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে, যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।
(বাস্তবতা থেকে নেওয়া, উপরের চারজন একই সার্কেলের চার বন্ধু।)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৮:০৮