somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সামাজিক পরিবর্তনের স্বরুপ সন্ধানেঃ পরিবার প্রথার বিবর্তন-০২

২৩ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যৌথ পরিবার প্রথার সবচাইতে গুরুত্বপুর্ণ নিয়ামক হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে উৎপাদনশীল কাজে পরিবারের সদস্যদের সকলের সম অংশীদারিত্ব ও সেই কাজ একই ধরনের হওয়া। ইকোনোমিক হোমোজনিটির উপর ভিত্তি করেই প্রধানত এই ধরনের পরিবার প্রথা চলে আসছিলো যতক্ষন না পর্যন্ত শিল্পায়নের আগ্রাসী থাবা এই মৌলিক কাঠামোর উপর আঘাত হানলো। অর্থাৎ যেই পরিবার তাত বুনবে তাদের সবাই তাত সংশ্লিস্ট কাজের সাথেই জড়িত থাকবে, কেউ সুতা বুনবে, কেউ সুতা কাটবে আর কেউ কাপড় বুনবে অথবা কেউ কাপড় রঞ্জনের কাজ করবে। ঠিক একইভাবে আমাদের কৃষিভিত্তিক পরিবার প্রথাতেও এই ধরনের অলিখিত শ্রমবিভাজন কাজ করতো। শিল্পায়নের যুগেও শ্রমবিভাজন এসেছে, কিন্তু বড্ড কদর্য রুপ নিয়ে। যেমন যে ব্যক্তি শার্টের বোতাম লাগানোর কাজ করবে সে জানবে না কিভাবে শার্টকে সেলাই করতে হয়। একজন কেবল যন্ত্রকেই চালাবে, কিন্তু জানবে না যন্ত্রটি কিভাবে চলছে বা সমস্যা হলে কিভাবে তার সমাধান করতে হবে। ট্রাডিশনাল ব্যবস্থার সবচাইতে বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো এই জায়গাতেই যে এক পরিবারের শারিরীক ভাবে সক্ষম (এবং অক্ষমরাও বাদ যেত না) সবাই একই ধরনের মৌলিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িত থাকতো। যেমন এক পরিবারে যদি পাচ জন ভাই থাকতেন তাহলে তারা সবাই তাদের যোগ্যতা ও সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের পুর্বপুরুষদের অনুসারিত পেশা গ্রহন করতেন। আর যেহেতু প্রযুক্তির এত উৎকর্ষতা এত প্রবল ছিলো না, সেহেতু প্রকৃতির আর বয়স্কদের জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার উপর অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতা নির্ভর করতো। বয়স্ক সদস্যদের অবদানের মাত্রা নিশ্চিতভাবেই তাদের জেন্ডার আইডেন্টিটির উপর নির্ভরশীল ছিলো। আর এই সময়ের বাধা উত্তীর্ণ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের চর্চা থেকেই খনার বচনের সুত্রপাত যেমন কলা রুয়ে না কেটো পাত তাতেই কাপড় তাতেই ভাত। আর একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করলে আমরা বুঝতে পারবো ভারতীয় উপমহাদেশের হিন্দু সমাজব্যবস্থায় সামাজিক স্তরায়ণের অন্যতম প্রভাবক ছিলো এই ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের স্তরায়ন।
শিল্পায়নের যুগের শুরুতেই যৌথ পারিবারিক প্রথার কোর ডিনামিক্স অর্থাৎ অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার ভারসাম্যে বিশৃংখলা দেখা দেয়। এই সময়টাকে আমরা আমাদের সামাজিক ইতিহাসের একটা ব্রেকিং পয়েন্ট বলতে পারি যেখানে এসে একক/ক্ষুদ্র পরিবার ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। উপরের উদাহরনের পাচ ভাইয়ের মধ্যে হয়তো দুই জন গ্রাম ছেড়ে শহুরে জীবনের আশায় কলকারখানায় কাজ নিলেন আর কিছুদিন পরে নিজ নিজ স্ত্রী ও সন্তানদেরকেও নিয়ে আসলেন। আবার এই দুই ভাইয়ের মধ্যে কেউ একজন হয়তো ঢাকা থেকে কোলকাতা চলে গেলেন। আর ঠিক এইভাবেই একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার তারতম্য হওয়া শুরু হল। আর শিল্পভিত্তিক সমাজের অভিজ্ঞতা যেহেতু পল্লী অঞ্চলে ব্যবহারের পর্যাপ্ত সুযোগও নেই, তাই যারা একবার পরিবার ছেড়ে সুন্দর জীবনের আশায় বের হয়ে আসলেন তাদের ফেরার খুব বেশী সুযোগও থাকলো না।
এখান থেকেই হয়তো আধুনিক ইকোনমিক মাইগ্রেশনের (অনেক পুরনো ব্যবস্থা যদিও) সুচনা আর তার সাথে সাথে যৌথ পরিবার ব্যবস্থার ভাংগন যা আমাদের এক দ্বিধান্বিত ব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। যৌথ পরিবার ব্যবস্থার ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষুদ্র পরিবার ব্যবস্থার নামে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় রোপিত হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের বীজ। সামস্টিকতাবাদকে পেছনে ফেলে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের যাত্রা, যা পুজিবাদের মুলমন্ত্র হিসেবে পরিচিত, শুরু এখান থেকেই। যৌথ পরিবার ব্যবস্থার ধ্বংসস্তুপের উপর দাড়িয়েই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের আগমনের হুংকার আমরা শুনতে পাই সামাজিক পরিবর্তনের এই ধাপে। আর শিল্পায়নের ছদ্মাবরণে পুজিবাদ কিন্তু শুধু নিছক অর্থব্যবস্থাই নয়, বরং এক সর্বগ্রাসী জীবনব্যবস্থার ব্লুপ্রিন্টও বহন করে নিয়ে আসে যার নিউক্লিয়াস হচ্ছে ভোগবাদ, আর মুলভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ। উন্নত জীবন, একটু ভালোভাবে বেচে থাকার আশায় ঘর ছেড়ে সেই যে বের হওয়া, শত ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও খুব কম মানুষই পেরেছে তার শেকড়ে ফিরে যেতে।

পরবর্তী অংশে আমরা দেখবো স্বাধীনতা উত্তর ও পূর্ব বাংলাদেশে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের উন্মেষ আর আমাদের সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষিতে তার প্রায়োগিক অপব্যবহার।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×