ছোট একটা ব্যক্তিগত গল্প দিয়েই শুরু হোক!
১৮’তে কোর্সওয়ার্ক শেষে গ্র্যাজুয়েট ক্লাসের গবেষণার বিষয় নিয়ে প্রোগ্রাম ডিরেকটর এবং সম্ভাব্য সুপারভাইজারদের সাথে বাস্তবায়নযোগ্য বিভিন্ন টপিক নিয়ে আলাপ-আলোচনা (ফোরাম শপিং এর মত) চলছিলো। ক্লাস চলাকালীন সময়েই আমি মোটামুটিভাবে ঠিক করে রেখেছিলাম যে হেলথ ইক্যুয়ালিটি (স্বাস্থ্যের অধিকারে সমতা) নিয়ে কাজ করবো। সেই অনুযায়ী আমার প্রপোজাল প্রস্তুত করে রেখেছিলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোর যে গঠনগত দুর্বলতার কারনে আমরা রাইট টু হেলথ নিয়ে আদালতে যেতে পারি না তার একটা নির্মোহ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাওয়া আন্তর্জাতিক আইনের পরিপ্রেক্ষিতে।
মজার বিষয় হচ্ছে আমার প্রোগ্রাম ডিরেকটর শুনে এককথায় নাকচ করে দিলেন এবং বললেন যে এটার পরিধি ব্যাপক বিস্তৃত হয়ে যাবে। আর এই টপিকের টেকনিক্যালিটিজ ফেইস করার মত সুপারভাইজার তাদের স্টকে আপাতত নাই (আই মিন সাউথ এশিয়ান কনস্টিটিউশনাল ডিসকোর্স ডিল করার মত)। যদিও প্রফেসর সুর্য সুবেদি (নেপালি বংশোদ্ভুত) ছিলেন, কিন্তু অদ্ভুত কোন কারনেই হোক না কেন প্রোগ্রাম ডিরেকটর সেইটা রেখে বললেন রিজিওনাল ইন্টিগ্রেশন নিয়ে কাজ করতে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে এবং কিছু ব্যক্তিগত বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে সামলে সেই বিষয়ে কাজ করে থিসিস জমা দিয়ে দিলাম। কিন্তু মনের মধ্যে কাঁটার মত বিধে ছিলো সেই বিষয়ে কিছু লিখতে না পারার যন্ত্রণা। ২০২০ এর শেষের করোনা পরিস্থিতিতে নিজের পরিবারসুদ্ধ অসুস্থ হওয়া এবং মায়ের পাশে দু’ সপ্তাহ কোভিড ওয়ার্ডে অবস্থানের সময় কেন জানি নিজের এই ব্যর্থতার কথা বারবার মনে পড়তো। মনে হত যদি প্রোগ্রাম ডিরেক্টরকে আরেকটু কনভিন্স করতে পারতাম তাহলে কিছু না করতে পারার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হতো না দেশে ফিরে।
যে গবেষণা প্রস্তাবনা জমা দিয়েছিলাম তার তিনটি দিক ছিলো, দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর দুর্বলতা বিশ্লেষন, জাতীয় বাজেটের বিপরীতে দুর্নীতির প্রভাব এবং আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামো এড়িয়ে যাওয়ার অপকৌশল।
সাংবিধানিক প্রবঞ্ছনার ইতিহাসের শুরুটা সদ্য স্বাধীন দেশের সংবিধানের কারিগরদের মাধ্যমেই। কথাটা শুনতে হয়তো খুব কঠিন মনে হবে, কিন্তু প্রায় সাড়ে চার দশক ধরে চলমান রাস্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যায় আচরনের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন হয় পুজিবাদি আদর্শের তথাকথিত এলিট আইনবিদদের হাত দিয়ে যারা সিভিল এবং পলিটিক্যাল রাইটসকে ইকোনমিক, সোস্যাল এবং কালচারাল রাইটসের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন ক্যাপিটালিস্টিক হেজিমনিকে এস্টাবলিশ করার সুপ্ত বাসনা নিয়ে। পড়ন্ত সমাজতন্ত্রের সর্বশেষ প্রভাব এড়ানোর জন্য সুকৌশলে সদ্য স্বাধীন দেশকে নিয়ে যাওয়া হয় এমন এক ইউটোপিয়াতে যা কখনোই বাস্তবায়নযোগ্য ছিলো না।
ভোটের অধিকার যে কখনোই ভাতের অধিকারকে ছাড়িয়ে যেতে পারবে না সেইটা অনুধাবনের চুড়ান্ত ব্যর্থতা বিগত দশকগুলোতে হাজারো মানুষের জীবনকে কেড়ে নিয়েছে। যে দেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অকাতরে জীবন এবং সম্ভ্রম বিসর্জন দিলো সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রতিহত করার জন্য, সেই স্বাধীন দেশেই অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংষ্কৃতিক অধিকারকে সাংবিধানিকভাবে দ্বিতীয় কাতারে ঠেলে দেয়া হলো এবং বলা হলো যে এই অধিকারগুলো আদালতের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য হবে না (অনুচ্ছেদ ৮.২)। আমার সীমিত জ্ঞান বলে যে একবিংশ শতাব্দীর সাংবিধানিক আইনের ইতিহাসে কোন স্বাধীন দেশ তার নিজের নাগরিকদের সাথে এ ধরনের নিষ্ঠুর উপহাস করার কথা চিন্তায়ও আনে নি, বাস্তবায়ন তো অনেক দূরের বিষয়।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৪