somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তরের চিঠি ( পৃষ্ঠা ৪১, ৪২ ও ৪৩)

০৭ ই মে, ২০০৯ সকাল ৮:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


২০.৭.৭১

অনু,

ভালো আছি। তোমার মনের বাঁধ বেঙে গেলে বলব, লক্ষী আমার, মানিক আমার, চিন্তা করো না। তোমার নয়ন কুশলেই আছে। বিধাতার অপার করুনা। যখন আমায় বেশি করে মনে পরবে তখন এই ভেবেই মনকে বোঝাবে, এই বলেই বিধাতার কাছে পার্থনা জানাবে- শুভ কাজে অনড় থেকে শুভ সমাধা করে যেন ঘরের ছেলে ঘরে ফিরতে পারি। ফিরতে পারি মায়ের বুকে-মুছিয়ে দিতে মায়ের এত কান্নাকে। নতুন দিনের আলোয় ভরা উজ্জ্বল প্রভাতে গিয়ে যেন মাকে মা বলে ডাকতে পারি। দোয়া করো। তোমরা সবাই নামায পরো। তোমার মনের দৃঢ় প্রত্যয় আমায় জাগাবে এগিয়ে চলার শ্বাশ্বত মনোবল। আমি এ বলে বলীয়ান হয়ে অন্যায়কে পদদলিত করতে জানব, সত্যকে আঁকড়ে ধরতে পারব বেশি করে। এবং এ পারাই আমায় এগিয়ে নিয়ে যাবে শেষ লক্ষ্যস্থলে, যেখানে ভবিষ্যত বংশধরেরা হাসস্তে পারবে-কথা বলতে পারবে-বাঁচার মতো বাঁচতে পারবে নিজ শক্তিতে শক্তিমান হয়ে।

পাহাড়ের শ্যামল বনরাজির এ মেলায় প্রায় প্রতিদিন বর্ষা নামে চারদিক অন্ধকার করে। বর্ষার অশান্ত বর্ষণে পাহাড়ি ঝড়নায় তখন মাতন নেমে আসে। দুর্বার বেগে ঝরনার সে জলধারা কলকল গান করে এগিয়ে চলে সমতলের দিকে। আমার মনের সবটুকু মাধুরী ঢেলে তখন সে ধারাকে কানে কানে বলি-ওগো ঝরনার ধারা, তুমি সমতলের দেশে গিয়ে আমার অনুকে আমার এ বারতা বলে দিয়ো, ‘ওকে আমার একান্ত কাছে পাই যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। নিকষ কালো অন্ধকারের একাকিত্ব তখন আর থাকে না। মনের আলোয় আমি সবকিছু দেখতে পাই। দূরকে দূর মনে হয় না। একাকার হয়ে যায়। ওগো ঝরনার ধারা, তুমি অনুকে এও বলো-তোমার নয়ন তোমার কথা ভাবে-মনের প্রশান্তিতে ভরিয়ে আনতে তাকে সাহায্য করে সবদিক দিয়ে’ তুমি ওকে বলো-মিছে মিছে আমার অনু যেন মন খারাপ করে না থাকে। ওর হাসিখুশি মন ও আত্নশক্তিই তো আমার প্রেরণার উৎস।

আচ্ছা, সত্যি করে বল তো লক্ষী, তুমি কি গোমরা মুখ করে সারা দিন ঘরের কোণে একাকী বসে বসে কাটাও? না, এ চিঠি পাবার পর থেকে তা করো না। আমি কিন্তু টের পেয়ে যাব। তিন সত্যি করে বলছি-দেশে গিয়ে তোমার সেই কিচ্ছাটা সুন্দর করে শোনাব। না, না, মিথ্যে বলছি না। অবশ্য আগে বলতাম। বিশ্বাস করো আগের আমি আর এখনকার আমি অনেক তফাৎ। এখনকার আমি ভবিষৎ বংশধরের প্রাথমিক সোপান।

তোমার শরীরে পরিবর্তন এসেছে অনেকটা বোধহয়। নিজের প্রতি বিশেষ যত্নবান হয়ো। মনকে প্রফুল্ল রেখো। মনের প্রফুল্লতা ভবিষ্যৎকে সুন্দর করবে।প্রয়োজনবোধে ঔষধ সেবন করো। সাবধানে থেকো। বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেয়ো না। আম্মাকেও কোথাও যেতে দিয়ো না। বুঝি, আমার কথা তুমি একটু বেশি করেই ভাব। সত্যি বলছি, ভাববার কিছুই নেই। আজ আমি ধন্য এই জন্য যে আমি আমার দেশকে ভালবাসতে শিখেছি। আমার এ শিক্ষা কোনো দিন বিফলে যবে না। তোমার সন্তানেরা একদিন বুক উঁচু করে তাদের বাবার নাম উচ্চারণ করতে পারবে। তুমি হবে এমন সন্তানের জননী, যে সন্তান মানুষ হবে, মানুষকে মানুষ বলে ভাবতে জানবে। এবং এ মানুষ হওয়া সম্পূর্ণ নির্ভর করবে তোমার উপর। কেবল মাত্র আত্নশক্তিতে বলীয়ান মা--ই তেমন সন্তান দেশকে দিতে পারে। আশাকরি তুমি সেই আদর্শ জননীর ভূমিকাই পালন করে যাবে-কাজে, কথায়, চিন্তায়।

মার সাথে দেখা করে আসতে পারিনি। পারিনি আজ পর্যন্ত সন্তানের কর্তব্য পালন করতে। আমার অবর্তমানে তাঁকে দেখার ভার তোমার ওপর রইল। সন্তান হয়ে যা করতে পারিনি, বধূ হয়ে তোমায় তা করতে হবে।

পরিশেষে বলব, যত্রা সবে শুরু হলো। পথ এখনো অনেক বাকি। পথের দুর্গমতা দেখে থমকে দাঁড়ালে চলবে না। এগিয়ে যেতে হবে দৃঢ় পদক্ষেপে, সকল বাধা কে দলিতমথিত করে। এর জন্য চাই অটুট মনোবল। সে মনোবলের অধিকারিণী হয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরদের মানুষ করে গড়ে তোলো।

গকুল নগর থাকতে কি মজার ব্যাপার হয়েছিল তা অনেকদিন পর হলেও লিখে আজকের লেখার ইতি টানব। কী কারণে যেন সেদিন সারা বেলা উপোস থাকতে হয়েছিল। খওয়া আর হয়ে উঠেনি। সকালবেলাতেও না-রাতেও না। একেবারে কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েও কিন্তু ঘুমিয়ে থাকতে পারিনি।

তুমি এসে ঘুমের বারটা বাজিয়ে হরেক রকমের এত খানা খইয়ে দিয়েছ যে আর খেতে পারি না বলে তোমার হাত চেপে ধরে যই দুষ্টুমী করতে গিয়েছি, অমনি ঘুম ভেঙে গেল। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে দেখি আমি বাড়িতে শুয়ে নেই। সুউচ্চ পাহাড়ের মালভূমিতে তাঁবুর এক কোণ ঘেঁষে আমার ব্যাগটার (যেটা বালিশের কাজ দিচ্ছিল) হ্যান্ডেল ধরে ওপরের দিকে চেয়ে আছি।তাঁবুর সামনের পর্দা সরিয়ে দেখি ভোর হতে আর দেরি নেই।... সেই যে একদিন এলে- এরপর আর আসনি। এলেই তো পারো! এবার কিন্তু ইতি টানব না-শুধু বলব-নিচে একটা ধাঁধা দিলাম, মাথ ঘামিয়ে ভেঙে দাও। ভঙতে পারলে জানতে পারবে আমি কোথয় আছি।

ধাঁধা

তিন অক্ষরের নাম আমার হই দেশের নাম

মধ্যের অক্ষর বাদ দিলে গছেতে চড়লাম

শেষের অক্ষর বাদ দিলে কাছে যতে কয়

বলো তো অনু, আমি রয়েছি কোথায়?

আব্বা আম্মাকে সালাম দিয়ো দোয়া করতে বলো। চোটদের স্নেহাশিস জানিয়ো। তুমি নিও সহস্র চুমো-অনেক আদর।

তোমার নয়ন

===============================
চিঠি লেখক: মুক্তিয়োদ্ধা পাটোয়ারি নেসারউদ্দিন (নয়ন)

চিঠি প্রাপক: স্ত্রী ফাতেমা বেগম (অনু), গ্রাম: মৈশাদী, ইউনিয়ন: তরপুরচণ্ডী, থানা ও জেলা: চাঁদপুর বর্তমান ঠিকানা: চ ২৭/৭ স্কুল রোড, চতুর্থ তলা, ওয়্যারলেস গেট, মহাখালী, ঢাকা।

চিঠিটি পাঠিয়েছেন:
ফাতেমা বেগম (অনু)
==============================

একাত্তরের চিঠি সংকলনের টেক্স্ট কন্টেন্ট রিভার্সিং: একটি প্রকল্পের প্রস্তাবনা
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০০৯ সকাল ৮:১৬
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হালহকিকত

লিখেছেন স্প্যানকড, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:১২

ছবি নেট ।

মগজে বাস করে অস্পষ্ট কিছু শব্দ
কুয়াসায় ঢাকা ভোর
মাফলারে চায়ের সদ্য লেগে থাকা লালচে দাগ
দু:খ একদম কাছের
অনেকটা রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ।

প্রেম... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×