somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একাত্তরের চিঠি (পৃষ্ঠা ৭৯ ও ৮০)

৩১ শে জুলাই, ২০০৯ দুপুর ১:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৫.১০.৭১

বাবুজি,
আমার সালাম জানবেন। আশাকরি, আপনারা সবাই ভাল আছেন। আমরা বর্তমানে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে এখানে আছি। গত কয়েক দিন হয় আমাকে 'রফিক' ধরে নিয়ে গিয়েছিল জোহা হলে, কিন্তু কপালগুনে অনেক কষ্ট সইবার পর বের হয়ে এসেছি আপনাদের দোয়ায়। কিন্তু আমাদের অফিসের দুইজন এবং ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আলমগীর থেকে গেছে ভিতরে। তাদের কপালে কী আছে, তা কেবল আল্লাহই জানেন। আমার উপর নীর্ভর করছে সম্পূর্ণ সম্পত্তি আর প্রিন্সিপালের পরিবার। আমি আপনাদের কাছে গেলে সমস্ত ধুলিসাৎ হয়ে যাবে এবং মারা যাবে। তাই থাকতে হচ্ছে। আমি যেখানে আছি ট্রান্সফার হয়ে সেখানে কেবল রাজাকার, পুলিশ, শান্তি কমিটি, মিলিটারিরা আহত অবস্থায় আছে। ১৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৩টা বাদ দিয়ে বাদবাকি ভর্তি হয়ে আছে। এদের মধ্যে কাজ করা আর কচুর পাতার ওপর পানির মতো জীবন।রফিক একমাত্র লোক যে প্রধান শহরে সবচাইতে Active. আমার জন্য আপনি দোয়া করবেন, যেন শেষ অবধি বেঁচে থাকতে পারি স্ত্রী, পুত্র নিয়ে। চারদিকে কেবল মৃত্যু-বিভীষিকা। ঢাকা গিয়েছিলাম, অফিসের কাজে, বর্তমানে ঢাকা বিস্ফোরণোন্মুখ শহর। বিধ্বস্ত, আতঙ্কগ্রস্থ, মৃত্যুর ফাঁদপাতা নগর। প্রতিদিন রাজশাহীর মতো সেখানে ২০-২৫ করে আহত আসছে। (বাঙালীদের সাথে বিহারিও) আলমডাঙ্গায় দাঙ্গা হয়ে গেল। সাজাদপুরের ১১৮টা মাস্টার গ্যাসে আক্রান্ত রোগী এসেছে, পাবনা আগুনে জ্বলছে পাটগুদামে। পাবনা, ঈশ্বর্দী, রাজশাহী, নাটোরের ফায়ার বিগ্রেড পারছেনা নিভাতে তিনদিন ধরে। নগরবাড়ী ছয়টার মধ্যে তিনটা ফেরি ডুবেছে। ঢাকায় কারফিউর মধ্যে রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। ঘোড়ামারায় পাঁচজন মিলিটারি চাকুতে মারা গেল। কোর্টের কাছে সামাদ দারোগাসমেত সাতজন, জিপ উড়ে গেল। রাত ১০টার পর অঘোষিত কারফিউ। হাডুপুর খোলাবান অর্থাৎ কোর্ট হতে প্রেমতলী পর্যন্ত আগুনে পুড়ল। হাসপাতালে ১৪১ জন আহত, ২০০ জন মৃত। গওহাটা নদীর ওপার হতে ১৫ জন আহত এসেছে, হাসপাতালে স্থান নাই, মেডিসিন নাই। কেরোসিন, লবণ আকাশছোঁয়া দাম। গর্জ্জার কাছে বালাবনে, ফয়ার সার্ভিসের ছাদে, জোহা হলে, বড়কুঠিতে বিমানধ্বংসী কামান, প্রতিদিন মেয়েদের আর্তনাদ জেলখানার ভিতর। ৩০০ মেয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুলের আছে সেখানে। বর্তমানে মেয়েরা ধারালো ব্লেড রাখছে কাছে এবং চরম সময় ব্যবহার করছে পশুর ওপর। শহরের বিভিন্ন স্থানে ২৫ জন শেষ হবার পর পশুরা এখন বন্ধ করেছে। শয়তানগুলো কেবল রাতে চার-পাঁচ জিপ ট্রাকে ৪০-৩০ মাইল বেগে পেট্রোল দিচ্ছে। ধরপাকড়, জোহা হলের বন্দীদের জবাই চলছে প্রতিদিন। হেনার বাড়ির পুরুষমানুষদের নিয়ে গেছে। আফ্রোজ এখন নরোজের পরিবার সমেত মরবার তালে আছে। এক এক দিন বহুদূরে মর্টার মেশিনগানের শব্দ শোনা যায়। বীভৎস মৃত্যু-বিভীষিকার শহর। রাজাকারদের মধ্যে আল-বদর বর্তমানে Active খুব।তারাবির নামাজের উপর গুলি ২৫শে রমজান আট রাকাতের সেজদায় মানিকচর ও নবীনগর, ১২ রাকাতের সময় জামালকলি, পারুলিয়া মসজিদে। রহনপুরে ইফতার করার জন্য বসে থাকা মুসল্লিদের উপর গুলি চলেছে। মোমতাজ আলী বাদে ১৮ জন শহীদ হয়েছেন। ঈদের দিন পাড়ার মসজিদে নামাজ হয়েছে। ঈদগাহের নামাজিরা পালিয়ে এসেছে মিলিটারি ঘেরাও হবার আগে। নওগাঁয় নামাজ হয়নি। ঢাকা-রাজশাহী বিছিন্ন। শরদহ হতে ২২ জন (তার মধ্যে মারা গেল নয়জন) মিলিটারি এসেছে।
আমরা বর্তমানে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি। এত কাছে যে আমরা মঁত্যুকে যেন দেখতে পাচ্ছি প্রতি মুহূর্তে। শীতে কষ্ট পাচ্ছি, একটা সোয়েটার যেকোন দামেরই হোক (একটু ভাল) নীল অথবা সবুজ রঙের পাঠিয়ে দিবেন, আর মোজা জোড়া পাঠঅবেন। বাবুজি, এই চিঠি ডাঃকে দেখাবেন। দোয়া করতে বলবেন। মনে করেন জগলুর মতো হয়েছি অথবা রমজানের মতো।

রাজ ইলু-আব্বাসী, তোরা আল্লাহর কাছে কাঁদ। যেন বেঁচে থাকি দোয়া কর সজল ও লুৎফাকে নিয়ে ইজ্জতের সাথে সমস্ত জুলুম হতে। খালাম্মাকে দেখিস, তিনি হয়তো সইতে পারবেন না আমার চিঠি পড়ে। বাবন, ফয়েজ, ফরিদ, থাকল বংশের প্রদীপ। ওদের দেখিস। বড়দের সালাম।

বাবলু
==============================================
চিঠি লেখকঃ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবলু। পুরো নাম ফেরদৌস দৌলা বাবলু। ১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি শহীদ হন।
চিঠি প্রাপকঃ বাবুজি (বাবা) ফিরোজ দৌলা খান। মালোপাড়া, রাজশাহী।
সংগ্রহঃ আমিনুল আকরাম।
==============================================
চিঠি সংকলনের টেক্স্ট কন্টেন্ট প্রকল্পের অংশ হিসাবে প্রকাশিত
১৩‌ থেকে ৫০ পৃষ্ঠার চিঠির প্রথম পিডিএফ সংকলন ডাউনলোড করুন
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

দুলে উঠে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৬

দুলে উঠে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

মন খুশিতে দুলে দুলে ‍উঠে
যখনই শুনতে পাই ঈদ শীঘ্রই
আসছে সুখকর করতে দিন, মুহূর্ত
তা প্রায় সবাকে করে আনন্দিত!
নতুন রঙিন পোশাক আনে কিনে
তখন ঐশী বাণী সবাই শুনে।
যদি কারো মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তরে নিয়ে এ ভাবনা

লিখেছেন মৌন পাঠক, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩০

তরে নিয়ে এ ভাবনা,
এর শুরু ঠিক আজ না

সেই কৈশোরে পা দেয়ার দিন
যখন পুরো দুনিয়া রঙীন
দিকে দিকে ফোটে ফুল বসন্ত বিহীন
চেনা সব মানুষগুলো, হয়ে ওঠে অচিন
জীবনের আবর্তে, জীবন নবীন

তোকে দেখেছিলাম,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি পথখাবার খান? তাহলে এই লেখাটি আপনার জন্য

লিখেছেন মিশু মিলন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৪

আগে যখন মাঝে মাঝে বিকেল-সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, তখন খাবার নিয়ে আমার জন্য ওরা বেশ বিড়ম্বনায় পড়ত। আমি পথখাবার খাই না। ফলে সোরওয়ার্দী উদ্যানে আড্ডা দিতে দিতে ক্ষিধে পেলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×