রাতুলের বয়স ২৭ বছর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে মাস্টার্স দিল মাত্র, আপাতত রেজাল্টের অপেক্ষায়! কিন্তু অবসর নেই মোটেই, রাতুলসহ ওর সব বন্ধুরা চাকুরীর জন্য ইঁদুর দৌড়ের নাম লিখিয়েছে। রাতুল থাকে শহীদুল্লাহ হলে, ক্যারিয়ার নিয়ে ওর তেমন একটা সিরিয়াস চিন্তা ভাবনা কখনই ছিল না, সহপাঠি নীলার প্রেমে পড়ে যাওয়ার কারণে ওকে এখন এই বিষয়টা নিয়ে খুব সিরিয়াস হতে হচ্ছে! ও সারাজীবন বই-পত্র আর আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখেই পার করেছে, এখন চাকুরীর জগতে পা রাখতে গিয়ে আর সবার মত বেচারা খুব বেশী সুবিধা করতে পারছে না। এ এক আজব রেস, কে কোন বিষয়ে পড়লো বিষয় না, বিষয় হচ্ছে মোটা বেতনের একটা চাকুরী, বাংলায় পড়ে ব্যাঙ্কে, অঙ্কে পড়ে আমলা, জিওগ্রাফি পড়ে জার্নালিজম-একবারে হযবরল! ছিলে রুমাল তাতে কী, হয়ে যাও বিড়াল- সময়ের প্রয়োজনে! একটা চাকুরী চাই-ই চাই, সমাজে একটা পরিচয় চাই, আরো কত কী চাই!
একদিন পার্কে সন্ধ্যায় রাতুল আর নীলা বসে গল্প করছিল। যেহেতু আমাদের শহরগুলোর কোথাও পাবলিক টয়লেটের তেমন কোনো বিষয় নেই, প্রকৃতির যে কোনো রকমের ডাক মানেই এক বিড়ম্বনা, তাই আমাদের রাস্তাঘাট ভেসে যায় ঝাঁঝালো তরল বর্জ্যে! রাতুলের জলত্যাগের প্রয়োজন বাড়াবাড়ি সীমানায় গেলে সে নীলা কে বসিয়ে পাশের একটা গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে যেই শুরু করেছে, অন্ধকারে যেইটা ঝোপ ভেবেছিল সেইটা নড়ে উঠলো! সে তো একদম লাফিয়ে উঠে সরে আসে, ওখানে ওদেরই মত দুইজন বসে ছিল, আরেকটু হলেই মহা কেলেঙ্কারী! এবার দেখেশুনে পাশে একটা নিরালা জায়গায় শান্তির সাথে রাতুল জল বিয়োগ করতে থাকে।
ঠিক এই সময়, তার মাথায় একটা ছেলেমানুষী মজার চিন্তা খেলে গেল। আচ্ছা, এই যে এত ঝামেলার মূত্র, এই ইউরিনের কোনো রিসাইকেল ভ্যালু নাই? ইউরিনে আছে প্রচুর পানি, আমোনিয়া, থেকে শুরু করে নানা কিছু। ইউরিনকে রিসাইকেল করে যদি কোনো কাজে লাগানো যায়? যত ছোটই হোক, সেইটা কী একটা বিশাল ব্যাপার হবে না? একদম বৈপ্লবিক আবিস্কার, যুগান্তকারী এক প্রকল্প! ভাবতে ভাবতে বেশ উত্তেজিত অবস্থায় রাতুল ফিরে আসে নীলার কাছে, এসে তার নতুন চিন্তার কথা বলতে থাকে!
-দেখ, ঢাকার কথায় ধর, রাস্তা দিয় হাঁটা যায়? মুতে ভাইসা যায় মানুষের! মানুষের দোষ কী? ব্লাডার কি বাসায় রেখে আসবে? তা আসবে না, তাইলে নেচার কল করলে সাড়া তো দিতেই হবে, ফলাফল- ফুটপাথগুলো দিয়ে মূত্রধারা বয়ে যায়। এখন চিন্তা কর- একটা কোম্পানী খোলা হল, যারা এই ইউরিন সংগ্রহ করে রিসাইকেল করবে, জৈব সার হতে পারে, পানি হতে পারে! যে কোনো কিছু, বা অনেক কিছু! কাঁচামাল পুরো ফ্রি! চিন্তা কর কী অবস্থা দাঁড়াবে?
নীলা- কোম্পানী তো পুরা লাল হয়ে যাবে রে, টাকাই টাকা! তুই তখন রতন টাটা ওর বউকে যে ইয়ট কিনে দিসে, যেখানে ফুটবল খেলা যায়, তুই আমাকে ওরকম একটা ছোট জাহাজ কিনে দিস, যাতে একটা ক্রিকেট মাঠ থাকবে! দেখছিস না বাংলাদেশের টাইগারদের থেকে বাঘিনীরা কত ভাল ক্রিকেট খেলে?
- আরে রাখ তোর জাহাজ, আমি তোরে একটা মহাদেশ কিনে দেব!
- মহাদেশ তো সব আবিস্কার হয়ে গেছে, আমার জন্য নতুন কই পাবি?
- সমুদ্রে টাকার বস্তা ফেলে তোর জন্য আমি একটা নতুন মহাদেশ গড়ে দেব। তুই শুধু চিন্তা কর- ঢাকার রাস্তায় মোড়ে মোড়ে এসি বুথ, না না, টাকা তোলার জন্য না- হিসু করার জন্য! মানুষ হিসু করবে ফ্রি, বের হওয়ার সময় এক গ্লাস ঠান্ডা পানি! সামনের মোড়ে গিয়ে আবার হিসু কর, ,আবার পানি খাও! রাস্তা ঘাট পরিস্কার রাখার জন্য পৌরসভা লাগে নাকি! ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ, আমরা মূত্র রপ্তানী করলেও তো বাংলাদেশ ব্যাঙ্কে ডলার রাখার জায়গা হবে না! প্রতি বছর আমরা একটা করে পদ্মা-মেঘনা সেতু বানাবো! ইলেক্ট্রিক-ম্যাগনেটিক ট্রেন তো কত দেশ দেখালো, আমরা সুপারসোনিক ট্রেন দেখাবো! তুই শুধু চিন্তা কর!
নীলা আর রাতুল এই আইডিয়া নিয়ে বেশ মজা করে নানা রকম আলাপ করে, রাতে নীলাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে রাতুল ফিরে আসে হলে, কয়েকটা জায়গায় সিভি ড্রপ করতে হবে, একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী আছে, ওর মামা ওখানে চাকুরী করেন, রাতুলকে সিভি দিতে বলেছেন হয়ে যাবে নাকি! রাতুল জিজ্ঞেস করেছিল- মামা, কোম্পানীতে আমার কাজ কী হবে?
- কাজ জেনে তোর লাভ কী? শুরুতেই বেতন পঞ্চাশের উপরে পাবি, দুই বছর পর সিক্স ডিজিট! তোর আর কী জানার দরকার?
- মামা, তারপরেও, আমার কাজটা তো জানতে হবে?
- কী আর, একজিকিউটিভ!
- ও!
রাতুল পরে ভাবছিল- এক্সিকিউটিভ মানে তো কেরানী, নাকি? কিন্তু মামাকে এই কথা বললে খবর আছে!
আর একটা সার্কুলার আছে, ওর নিজের শহরে একটা স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষকের পদ, এইটা ওর নিজের পছন্দ, সারাজীবন নিজে যা পড়েছে, সেইটা নিয়েই থাকা যাবে। কিন্তু বাসায় বলে প্রতিক্রিয়া ভালো হয় নি, স্কুল মাস্টারদের বেল নাই, এত পড়ালেখা করে কেউ এখন স্কুলে মাস্টারী করে নাকি!
রাতে চিন্তা করতে করতে রাতুল দেখে যে চিন্তাটা শুধুই মজার না, এর মধ্যে সার বস্তু আছে! মূত্রের রিসাইকেল ভ্যলু নিয়ে কাজ কোনো রসিকতা না, এইটা একটা সিরিয়াস কাজ! এর প্রয়োজনীয়তা আছে, এখন যতটা, সামনের দিনে আরো বেশি! সামনের বিশ্বযুদ্ধটাই নাকি হবে পানি নিয়ে! বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, জৈব সার বানিয়ে সাপ্লাই দিলে সারের অভাব থাকে? কিন্তু কাজটা সহজ না, খুবই কঠিন, না হলে তো করাই হত! কিন্তু অসম্ভব বলে তো কিছু নাই বলেই তো পড়ানো হয়। রাতুল চিরকাল বোকা টাইপের, মূত্র নিয়ে চিন্তা করা যে এখনো খুব বোকামী এইটা ও বুঝতে পারে না শুরুতেই!
রাতুল বিষয়টা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে যায় প্রথমে সরকারী গবেষনা প্রতিষ্ঠানে, সেখানে গিয়ে জানতে চায় যা বাংলাদেশের মূত্র গবেষনার অগ্রগতি নিয়ে। ওখানকার টেবিল চেয়ারের বিজ্ঞানীরা ওকে হেসেই উড়িয়ে দেয়, যেন খুব মজার কথা বলতে এসেছে বাতিক গ্রস্থ এক খেয়ালী যুবক! রাতুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি ল্যাবে যায়, ওখানকার স্যারদের সাথে কথা বলে, যারা এই বিষয়ে কাজ করতে পারে, সবার কাছে এক এক করে ও যায়, এবং প্রচন্ড বিস্ময় নিয়ে আবিস্কার করে যে ইউরিন নিয়ে কোনো কাজ তো হচ্ছেই না, বরং সবাই ওর এই আইডিয়া নিয়ে হাসাহাসি করে মজা নিচ্ছে, এইটা যে একটা খুব কাজের কাজ হতে পারে, এই সহজ জিনিসটা কাউকে সে বোঝাতে পারে না।
ডাক শুনে কেউ না আসলে একলা চলতে হয়, রাতুল একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে যে সে নিজেই এই কাজটা শুর করবে, সে সরাসরি কেমিস্ট্রির ছাত্র না, কিন্তু বিজ্ঞানের মূলগত পদ্ধতি সম্পর্কে তার ভালো ধারনা আছে, সেই কাজটা শুরু করবে, শেষ করতে না পারুক, কিছুটা এগিয়ে রাখবে। সে প্রথমে চিন্তাটা জানায় নীলাকে, এবং বুঝতে পারে উপড়ে ফেলা ধাক্কা কাকে বলে-
-তুমি কি সিরিয়াস? অ্যা! পাগল হয়ে গেছ নাকি? মজা এক জিনিস আর সেইটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া এক জিনিস! গতরাতেও বড়আপা ফোন দিয়েছিল আমেরিকা থেকে, সে নাকি ওখানে আমার জন্য একটা ছেলে পছন্দ করে বসে আছে। আমি সারাদিন আল্লাহ আল্লাহ করছি তোমার চাকুরিটা যেন হয়ে যায়, এর মধ্যে তুমি এই সব কী বলতেস? সমাজে তোমার পরিচয় কী হবে? মূত্র গবেষক? তুমি আমারে না, তোমার নিজের বাসায় রাজী করায়ে আসো, তারপরে তোমার সাথে কথা! আমি বিশ্বাসই করতে পারছিনা একজন এইটাকে পেশা হিসেবে চিন্তা করতে পারে!............
বাসার প্রতিক্রিয়া-
কী বলছিস বাপ তুই? এত পড়াশোনা করে কী তোর মাথা নষ্ট হয়ে গেল? তোকে নিয়ে আমাদের কত আশা! তুই কত বড় হবি, আমাদের খাওয়াতে হবে না তোর, কিন্তু এমন কিছু করবি যেন আমরা তোকে নিয়ে গর্ব করতে পারি, তুই যা বলছিস তাতে আমরা মুখ দেখাবো কী করে? এত পাস দিয়ে আমাদের ছেলে প্রসাব-বিজ্ঞানী হতে চায়! তুই কারো কথা ভাবছিস না? এখনো তোর এইসব পাগলামো করার বয়স আছে? ...............
বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া-
তুই শালা পুরাই আবুল, তোর মামা তোর জন্য এত ভালো একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করতাসে, আর তুই পেশাব বাবা হইতে চাস! মানুষ হ ব্যাটা মফিজ, আর কত লোক হাসাবি? ওই রোমান শুইনা যা, আমাগো রাতুল কী কয়, হালায় মূত্র নিয়ে রিসার্চ কইরা কোম্পানী খুলবো, বিল গেটসরে টক্কর তো দিবোই- লগে নোবেল ফ্রি! হা হা হা হা, ওই কেউ আমারে ধর, আমি আজকে হাসতে হাসতে শহীদ হইয়া যামু............
এর মধ্যে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর আপয়েন্টমেন্ট লেটার হাজির, মামা সেইটা বাসায় আগেই জানিয়েছেন, জয়েন করার শেষ তারিখ ২৫, এর মধ্যে মফস্বলের সেই স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষকের পদে যোগদানের আমন্ত্রনপত্র এসে হাজির! কয়েক দিনের মধ্যের রাতুলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, জীবন তার সামনে দুটো পথ খুলে রেখেছে- চাকুরী কর, টাকা কামাও, বিয়ে কর সুখী হও, টাকা কামিয়ে দেশ ও দশের মুখ উজ্জ্বল কর। আরেক পথে- গ্রামে গিয়ে মাস্টারী শুরু কর, নিজে পড়, অন্যদের পড়াও, অনেক পড়, ভাব, গবেষনা কর, করতেই থাক, হয়তো একদিন তুমি পেতেও পার কিছু একটা মহা অমূল্য! এখানে তোমার পাশে কেউ নেই, তুমি একা, পূর্নিমা নয়, আমাবস্যার চাঁদের মত একা!
২৪ তারিখ রাত, হলের রুমে রাতুল ওর টেবিলে বসে আছে চুপচাপ, একটা মোমবাতি জ্বালানো, নীলা জানিয়ে দিয়েছে খুব দ্রুত রাতুলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ওর বাবা অসুস্থ, ও বুঝতে পারছে যে নীলার হাতে একদমই সময় নেই। ওর হাতেও নেই, কাজ করলে অনেক কাজ পড়ে আছে। রাতুলের সামনে দুইটা খাম রাখা, একটা ঝলমলে, একটা হলুদ, রোদে ঘামে পোড়া! একটায় দাসখত, একটায় স্বপ্ন! একটাতে সুখ- একটাতে যুদ্ধ! একদিকে প্রিয় মানুষদের হাসি মুখ, অন্যদিকে তাদের হতাশায় মরা চোখ! রাতুল দুটো খাম সামনে নিয়ে বসে থাকে- ওকে যে কোনো একটা বেছে নিতে হবে! আজকে রাতের মধ্যে!
রাতুল কী করবে? কোন খামটা বেছে নেবে? পাঠক, আপনি হলে কোনটা নিতেন?
*** শেষমেশ একটা গল্প লিখেই ফেললাম! গল্পখানা সুপ্রিয় শ্রদ্ধেয় ব্লগার মামুন রশিদ ভাই সমীপে নিবেদিত হইলো! গল্প সঙ্কলনে তাঁর যে ক্লান্তিহীন নিবেদন- সেইটা আমাকে সবসময় মুগ্ধ ও বিস্মিত করে!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৮