আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি । কোনো এক ছুটিতে গিয়েছি নানাবাড়ি । বেশ কিছুদিন পর আমাকে পেয়ে নানা-নানি, মামা-খালা মিলে এমন হুলস্থুল লাগালো সেটা আর বলার মত না । সবাই মিলে অনেক মজা হচ্ছিল । আমিও হৈ-হুল্লোড়ে মেতে আছি,সময় যে কিভাবে কেটে যাচ্ছে টেরই পাচ্ছিনা ।
নানা বিএএফ শাহীন কলেজের একজন শিক্ষক হওয়ায় নানার বাসা তখন বি এফ শাহীন কলেজ এর কোয়ার্টারে । কোয়ার্টারের বক্স টাইপের বাসার এক কোনার দিকে আমার একমাত্র খালা থাকেন একা একা । খালা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী । পড়াশোনার সুবিধার্থে তার রুমটা একটু আড়ালের দিকে ছিল ।
যাই হোক, খেলছিলাম লুকোচুরি । লুকানোর জন্য খালার রুমের টেবিল এর নিচ টাকেই আমি বেছে নিলাম । সেখানে গিয়ে টেবিলের নিচে ঢুকে যখন নিজেকে "থিফ অফ বাগদাদ" এর মত মনে হচ্ছে ঠিক এরকম একটা সময় আমি আমার বাম পাশে একটা বই দেখলাম, এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে । উলটে দেখলাম । মলাটটা সবুজাভ, বইয়ের নাম "সে ও নর্তকী" । লেখক "হুমায়ুন আহমেদ" ।
কিছুদিন আগেই মুহম্মদ জাফর ইকবালের "যারা বায়োবট","টুকি ও ঝায়ের প্রায় দুঃসাহসিক অভিযান" পড়ে তখন মস্তিষ্কের সৃজনী অংশের রক্ত গরম হয়ে আছে । এই বইটি দেখে গরম রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকল ।
লুকোচুরি খেলার কথা ভুলে আমি তখন বইটা পড়া শুরু করলাম । গল্পের কাহিনী হল - একটা মেয়ে এক আর্টিস্টের সাথে ঘটনাচক্রে পরিচিত হয়ে প্রেমে পরে গিয়েছে । সেই আর্টিস্টের আবার একটি বাচ্চাও আছে । তো আর্টিস্ট মেয়েটার জন্মদিনে তাকে তার নগ্ন একটা পেইন্টিং উপহার দেয় - অত্যন্ত লোমহর্ষক ব্যাপার ।
টান টান উত্তেজনার মাঝে বইটি পড়ে প্রায় অর্ধেকের মত শেষ করেছি এমন সময় খালামনির গলা শুনতে পেলাম ।
তুমি কি পড় ? দেখি ?
আমি বইটা বের করে দেখালাম । খালামনি ছো মেরে বইটা আমার হাত থেকে নিয়ে নিল ।
বলল , খবরদার ! এই বইয়ে আর হাত দিবেনা । এইটা বড়দের, তোমার পড়ার নাহ !
বইটাকে খালা আলমারির উপরে রেখে দিল যাতে আমি ধরতে না পারি । তখন তো হাইট ৩ ফিট হবে সাকুল্যে ।
মনটা খারাপ হয়ে গেল । কাহিনী পড়ে আচ করতে পারছিলাম যে এইটা "বড়দের" বই, তাই বলে পড়া থামিয়ে দেব - এটা মোটেই মেনে নেয়া যায়না । এই বই আমাকে পড়তেই হবে যেভাবেই হোক ।
যাইহোক, রাত্রে বেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল, আমি তখন চুপি চুপি একটা চেয়ার নিয়ে আলমারি থেকে বইটা নিচে নামিয়ে ফেললাম ।
ড্রয়িংরুমে নিয়ে পড়া শুরু করলাম । কিন্তু কিছুক্ষন পরে কোত্থেকে জানি আম্মু এসে বলল , এতরাতে কি কর ?
আমি ততক্ষনে বুঝে গিয়েছি যে ওই বই "বড়" মানুষ দেখলেই লুকোতে হবে । সুতরাং আমি বই লুকিয়ে আম্মুকে ভগিচগি বুঝিয়ে লাইট অফ করে দিলাম ।
আম্মু যাওয়ার পর আমি আর রিস্ক না নিয়ে ডিরেক্ট বাথরুমে গিয়ে বই এর বাকি অংশ পড়ে শেষ করলাম ।
পরেরদিন সকালে খালার রুমের বুকশেলফ ঘাটতে গিয়েছিলাম এরকম বই আরো পাওয়া যায় নাকি দেখতে । গিয়ে দেখি তালা মারা । হতাশ হয়ে ফিরে এসেছিলাম । পরে রাতের বেলা খালা আমাকে ডেকে একটা বই দেয় , আর বলে সেটা নাকি আমার পড়ার মত বই । নাম "একি কান্ড !" । লেখক "হুমায়ুন আহমেদ" । এবার আর কোনো লুকোচুরি নেই । একনাগাড়ে বসে পড়ে শেষ করলাম বইটা ।
পরপর ওই বই দুটো পড়ে আমি কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম । ঘোর কাটতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল । নানাবাড়িতে যতদিন ছিলাম ততদিনই আমার মধ্য সেই ঘোরলাগা ভাবটা কাজ করেছে । অদ্ভুত এক ঘোরলাগার মধ্য দিয়ে আমি পরিচিত হয়েছিলাম এক নতুন জগতের সাথে । হুমায়ুন সাহিত্য - যে জগতের নাম । হুমায়ুন আহমেদ যে জগতের স্রষ্টা ।
সেই স্রষ্টা আজ নেই । কিন্তু অদ্ভুতভাবে জগত ঠিকই টিকে আছে । আর টিকে থাকবে বহুদিন । অমর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছে , আর আমি এই "বাজারি" "সস্তা অপন্যাস লেখা" মানুষটাকে মিস করা শুরু করেছি ।
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন স্যার ।