তিনি সময়ের সেরা কোচ কি না - এটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে । কিন্তু তিনি যে সবচাইতে আলোচিত-সমালোচিত কোচ , সেটি নিয়ে কোনওপ্রকার দ্বিমত নেই কারও আশা করি । এতক্ষনে বুঝে ফেলেছেন কার কথা বলছি । মোরিনহো , হোশে মোরিনহো ।
২০০৯-১০ মৌসুমে রিয়াল মাদ্রিদ তাদের ইতিহাসের দ্বিতীয় গ্যালাক্টিকোস গড়ে । উড়িয়ে আনে রোনালদো-কাকা-এলোনসো-বেনজেমা কে । কিন্তু যেই লাউ সেই কদু । চ্যাম্পিয়ন্স লিগে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বাদ আর লা লিগায় বার্সার পিছে থেকেই মৌসুম শেষ । তাই মৌসুম শেষে কোচ ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনির চাকরিটা যে থাকছেনা - সেটা আগেই বোঝা যাচ্ছিল । অপরদিকে সেই মৌসুমেই ইন্টারকে তাদের ইতিহাসের প্রথম ট্রেবল জেতান পর্তুগিজ কোচ হোসে মোরিনহো ।
মোরিনহোর সাফল্যর সুত্র ধরেই ২০১০ বিশ্বকাপের আগ দিয়ে রিয়ালে মোরিনহোর নাম লেখায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ । শুরু হয়ে মোরিনহোর নতুন মিশন । সেই মিশনের শুরুটা হয়েছিল বিশ্বকাপ পরবর্তী গ্র্যান্ড ট্রান্সফার উইন্ডোর মধ্য দিয়ে । কি ছিল সেই ট্রান্সফার উইন্ডোতে ?
২০১০ বিশ্বকাপে ফুটবলামোদীরা এক নতুন জার্মানিকে আবিস্কার করে । যে জার্মানি শুধু যান্ত্রিক ফুটবল খেলে না । যে জার্মানির খেলাতে শিল্পের ছোয়া আছে , এবং সেই শিল্পটা শেষ পর্যন্ত গোলেও পরিণত হয় । জার্মানির এই নতুন মন্ত্রের পেছনে যে কজন তরুন মুখ্য ভুমিকা রাখছিলেন , তাদের মধ্যে একজন হল মেসুত ওজিল । তুরস্কের বংশভুত এই জার্মানকে নিয়ে পড়ে যায় টানাহেচড়া । বার্সেলোনা এক পর্যায়ে একরকম ঘোষণাই দিয়ে বসে যে ব্রেমেনের সাথে তাদের ওজিলের বিষয়ে চুক্তি সম্পন্ন । কিন্তু একেবারে শেষ মুহুর্তে ওজিলকে দলে ভেড়ায় রিয়াল মাদ্রিদ । সাথে আর্জেন্টাইন উইঙ্গার ডি মারিয়া আর জার্মান হোল্ডিং মিডফিল্ডার স্যামি খেদিরা ।
কেবলই ইনজুরি থেকে সেরে ওঠা কাকা মৌসুমের শুরুতেই পরেন হার্নিয়ার সমস্যাই । প্রায় ৭ মাসের মত বিশ্রাম নেয়া দরকার । তখন কাজে লাগে মোরিনহোর কেনা উইঙ্গার ডি মারিয়া কে । ওজিল-ডি মারিয়া মিলে রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে নিয়ে পার করান একের পর এক বৈতরনী । সাথে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা গোলমেশিন ক্রিস্টিয়ানো তো আছেনই । একসময় আসে পৃথিবীর সবচে মর্যাদার আর উত্তেজনার ম্যাচ "এল ক্লাসিকো" । সেবারের এল ক্লাসিকোকে বলা হচ্ছিল "গ্র্যান্ড এল ক্লাসিকো" । কেননা দুই দলে আছেন বিশ্বের সেরা দুই খেলোয়াড় আর সেরা দুই কোচ । ফুটবল আমুদেরা টিভিসেটের সামনে নড়ে চড়ে বসেন জমজমাট একটা ক্লাসিক দেখবেন বলে ।
কিন্তু হায় ! রিয়ালের জালে গুনে গুনে ৫ টি গোল দেয় বার্সা । বিপরীতে রিয়ালের গোল নেই একটিও । এরকম একটা বিধ্বংসী দল গড়েও যদি নিজেদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষের কাছে ৫ গোল খেতে হয় সেটি অবশ্যই হতাশার । তাই অনেকেই ওখানেই অনেকেই রিয়ালে মোরিনহোর শেষ দেখে ফেলেছিলেন ।
কিন্তু তিনি যে মোরিনহো ! হাল ছাড়ার পাত্র নন কোনওভাবেই ! বার্সার সাথে সমানতালে লড়ে চলল মাদ্রিদ । লা লিগায় একসময় আবার ঘুরে ফিরে আসল এল ক্লাসিকোর সেই মহারন । সবার মনে প্রশ্ন , এবার কি ফলাফল হবে ?
সকলকে অবাক করে সেই ম্যাচে অদ্ভুতুড়ে এক একাদশ বানালেন মোরিনহো । এলোনসো আর খেদিরা এই দুইজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এর পেছনে পেপে কে ডিপার ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডে খেলালেন । মাঝমাঠে তৈরী হল এক ডিফেন্সিভ ট্রিভোট । এই ট্যাকটিকসের কারনেই হোক আর অন্য কারনেই হোক , বার্সা তাদের স্বাভাবিক পাসিং ফুটবলটা ঠিক খেলতে পারলো না । রিয়াল রক্ষা পেলো বার্সার কাছে তাদের টানা ষষ্ঠ পরাজয়ের হাত থেকে । রোনালদো বার্সার বিরুদ্ধে তার প্রথম গোলটি করলেন , সে ম্যাচ ড্র হল ১-১ এ ।
আর কিছুদিন পর হঠাত করে লোকে আবিষ্কার করল , মাদ্রিদ কিভাবে কিভাবে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের সেমিতে উঠে গেছে । প্রায় ৭ বছরের পর রিয়ালের সেমিতে ওঠা ছিল সেটা - মোরিনহো যুগেই সেটি হয়েছে । সবাই "লা দেসিমা" এর স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল । কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে আর রেফারির পক্ষপাতদুষ্ট রেফারিং এ সেমিতে মাদ্রিদের ভাগ্যটা ঠিক ক্লিক করল না । প্রথম লেগে সব ঠিক ঠাকই এগুচ্ছিল কিন্তু পেপেকে অহেতুক রেডকার্ড দেয়ার পরের ৮ মিনিটেই লিওনেল মেসি করেন ২ টি গোল । দ্বিতীয় লেগে করা হিগুয়েনের গোলটি অহেতুক বাতিল করা হয় ।
যা হোক , কোপা দেল রে 'র ফাইনালে আবার দেখা দেখি হয় দুদলের । এবার আর ছাড়াছাড়ি নেই । অতিরিক্ত সময়ে রোনালদোর গোলে জয় পায় মাদ্রিদ । মোরিনহো পান মাদ্রিদে তার প্রথম শিরোপা । ওটা ছিলই বিগত ৭ দেখায় বার্সার বিপক্ষে মাদ্রিদের প্রথম জয় । এর পরের হিসাবটা দিলেই একটা ব্যাপার পরিস্কার হবে ।
সেই ম্যাচের পর থেকে বার্সা আর মাদ্রিদ কবার মুখোমুখি হয়েছে ?
২০১১-১২ এর সুপার কাপে ২ বার
২০১১-১২ এর লা লিগাতে ২ বার
২০১১-১২ এর কোপা দেল রে তে ২ বার
২০১২-১৩ এর সুপার কাপে ২ বার
২০১২-১৩ এর লা লিগাতে ২ বার
মোট ১২ বার ।
এর মধ্যে মাদ্রিদ জয় পেয়েছে ৪ টিতে , বার্সা ৪ টিতে আর ড্র হয়েছে ৪টি ম্যাচ ।
অর্থাৎ , ০৮-০৯ মৌসুম থেকে রিয়ালের উপর বার্সার যে একক আধিপত্য ছিল সেটি কিন্তু আর নেই ।
চলুন আরেকটি হিসেবে আসি । মাদ্রিদ সর্বশেষ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে ০০-০১ মৌসুমে । এরপরে আর পাওয়া হয়নি । এর পরের মৌসুমে সেমিতে উঠেছিল । তার পরের মৌসুমে কোয়াটারে । এর পরে সর্বোচ্চ দৌড় দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত ।
মোরিনহো আসার পরে মাদ্রিদ টানা তিন মৌসুম চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিতে খেলল । এটা কি ছোটখাট সাফল্য মনে হচ্ছে ?
সুতরাং যারা "মোরিনহো হটাও" আন্দোলনে "ফাসি চাই , ফাসি চাই" করে তারস্বরে চেচাচ্ছেন , তাদের বলছি - ভাই থামেন । আগে স্ট্যাটস দেখেন । এরপরে না হয় এগুলি করেন ।
________________________________________________________________________________________
এইবার আসি হোসে মোরিনহোর খারাপ দিকগুলির ব্যাপারে ।
এটা খুবই সহজ কথা যে দুনিয়ার প্রতিটি ব্যাপারেই একটা ভাল দিক থাকবে আরেকটা খারাপ দিক থাকবে । মোরিনহোর ক্ষেত্রেও তাঁর ব্যতিক্রম নয় । আপনি একই মানুষের কাছ থেকে দুর্ধর্ষ ট্যাকটিকস , পিতৃতুল্য ম্যান ম্যানেজমেন্ট , বিজনেস ম্যাগনেটের মত সাইনিং আশা করতে পারেন না । মোরিনহো জন্মই নিয়েছেন তুখোড় ট্যাক্টিকাল ব্রেইন নিয়ে । কিন্তু তাঁর এটিচিউডেই ম্যান ম্যানেজম্যান্ট জিনিসটা নাই ।
যারা কাকার পাড় ভক্ত আছেন , তাদের মধ্যে অনেকেই দাবি করেন কাকার ক্যারিয়ার নষ্টের মুল হোতা হলেন মোরিনহো । কথাটা পুরোপুরি সত্য না হলেও উড়িয়ে দেয়া যাবে না বৈকি !
কাকা ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা প্লেমেকারদের একজন । মোরিনহো যখন মাদ্রিদে আসেন তখন তিনি হার্নিয়ার ইনজুরিতে ভুগছেন । কাকার রিপ্লেসমেন্টে ওজিল-ডি মারিয়া ভাল সার্ভিস দিচ্ছিল । তাই কাকার অভাবটা মাদ্রিদ টের পায়নি ।
কিন্তু কাকা যখন ব্যাক করলেন , এবং ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছলেন তাকে খেলানো ১০-১৫ মিনিটেই , তখনও কাকাকে নিয়মিত না খেলানোর বিষয়টি মোরিনহোই ভাল ব্যাখ্যা করতে পারবেন ।
সাথে যোগ করুন পরপর দুই মৌসুমে সাহিন আর মদরিচ কে সাইন করে কাকাকে আরও কোনঠাসা করে ফেলা । এরকম অবস্থায় একটা খেলোয়াড়ের কাছ থেকে আপনি কিভাবে সেরাটা আশা করেন ? যাকগে সে কথা ।
এর পরে আসে কিছু অযৌক্তিক ট্রান্সফার । ২০১১-১২ মৌসুমের প্রাক্কালে ডর্টমুন্ড থেকে মাত্র ১০ মিলিয়ন ইউরোতে টার্কিশ মিডফিল্ডার নুরি সাহিনকে যখন দলে ভেড়াল রিয়াল , চারিদিকে হৈ হৈ পড়ে গেল - বড় একটা দাও মেরেছেন , মোরিনহো ।
কিসের কি ! প্রায় পুরোটা মৌসুম বসিয়ে রেখে সাহিনের খেলার ধার নষ্ট করে পরের মৌসুমে তাকে ডর্টমুন্ডেই ফেরত পাঠালেন তিনি ।
র্যামোসকে ফ্ল্যাঙ্ক থেকে সেন্টারে আনা একটা কৃতিত্বের কাজ অবশ্যই । কিন্তু সেই র্যামোসের জায়গায় কাকে খেলানো হল ? আরবেলোয়া । ইউথ একাডেমিতে কারভাজালের মত রাইট ব্যাককে লেভেরকুসেনে পাঠিয়ে মাঠের মধ্যে চিরউদাস আরবেলোয়াকে নিয়মিত একাদশে রাখা শুরু করলেন অনলি ওয়ান । চুক্তি বাড়িয়ে নিলেন ২০১৭ পর্যন্ত ।
পুরো মাদ্রিদ পরিবার যখন জেসে রদ্রিগেজের নাম বলতে অজ্ঞান , মোরিনহো তাকে অভিষেকের পর আর নামালেনই না ! ইউথ প্লেয়ারদের এইরকম অপচয় কে কবে দেখেছে সৃষ্টিকর্তাই জানেন ।
সবশেষে ইকার ক্যাসিয়াস । ইকারের ইনজুরির পর সাইন করা লোপেজ অসাধারন খেলছিলেন । তাই ক্যাসিয়াস যখন ফেরত এলেন , তখনও অনেকেই কেবলই ইনজুরি থেকে ফেরা ক্যাসিয়াসের বদলে লোপেজকেই গুরুত্বপুর্ন ম্যাচগুলোতে খেলানোড় পক্ষপাতী ছিলেন । কিন্তু ইকারকে অন্তত কম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ গুলিতে নামার সুযোগ করে দেয়াটা উচিত ছিল , লা লিগা যেহেতু হাতছাড়া - সেখানে এই সিদ্ধান্ত নেয়াই যেত । মোরিনহো তা না করে , উলটো প্রেস কনফারেন্সে " লোপেজ কে আমার প্রথম মৌসুমেই কেনা উচিত ছিল । যারা নিজেদের অন্যদের থেকে উত্তম ভাবে তাদের সাথে কাজ করা যায়না । ইকার ভাল কিপার । সে পোস্টে অসাধারন সব সেইভ করে । কিন্তু আমি যে ধরনের রাশ অন করা কিপার চাই ইকার তা না । " এরকম কথা বলে পরিস্থিতি ঘোলা করে দিলেন ।
ইকার শুধুমাত্র মাদ্রিদের একজন খেলোয়াড় নন , তিনি একজন আইকন । গত ১৪ বছরে অনেক কোচ এসেছেন গিয়েছেন । কিন্তু পোস্ট আগলে একজোড়া বিশ্বস্ত হাতই ছিল । সেই ইকার ক্যাসিয়াস কে নিয়ে এরকম মন্তব্য মাদ্রিদে থাকা কোনও মাদ্রিদিস্তারই মেনে নেয়ার কথা না , মেনে নেয়নি । তারা পরের ম্যাচই দুয়োধ্বনি দেয় মোরিনহোকে । গেল গেল রব ওঠে আবার ।
ভাল খারাপ মিলিয়েই একজন মানুষের এট্রিবিউটস । কেউই একদম পারফেক্ট না । সেটি হওয়া সম্ভবও না । একজন অসাধারন ট্যাক্টিকাল গুরু হিসেবে মোরিনহোর যে সম্মান পাওয়া উচিত সেটি তাকে দেয়াটা আমাদের অবশ্য কর্তব্য । আর তারপরে এটাও মনে রাখতে হবে , সবকিছুর চাইতে রিয়াল মাদ্রিদ বড় । যেটাতে ক্লাবের ভালো হয় , আল্লাহ পাক সেটাই করুন ।
Hala Madrid !