somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্ষুধা-খাবার-একটি ছেলে ও আমি.........

২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ২:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দিনটা সোমবার, সকাল, ২৪ফেব্রুয়ারি ২০১৪। সোমবার সাধারণত সকাল ৮টায় ক্লাস থাকে। কিন্তু সেদিন ছিলো নাহ। আজাহার স্যারের ক্লাস থাকে সেই সময়টাতে। স্যার আগেই বলে দিয়েছিলো সেদিন ক্লাস নেবেন নাহ। তাই একটু দেরি করেই ক্যাম্পাসে যাওয়া। হেদায়েত স্যারও সেদিন ব্যক্তিগত কিছু কারণে দেড় ঘন্টার ক্লাস এক ঘন্টা করিয়ে ছেড়ে দিল। যারা তাঁর ক্লাস করে বা আগে পরে করেছেন তা তারা বুঝবে তিনি কেমন ক্লাস করান বা তার ক্লাসে কেমন সচেতন থাকতে হয় সবাইকে। ৩০মিনিট আগে ছাড়া পেয়ে সবাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। তাড়াহুড়া করে ছুটে গেলাম কাদেরের দোকানে। কিছু খাবার জন্য কেউ বিড়ি ফুঁকতে গেল। যে যার মত সেখানে বসে গল্প করছিলাম আর খাবার সেরে নিচ্ছিলাম কেননা একটু পরেই আবার ছুটতে হবে পরের ক্লাসের জন্য। কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে খাচ্ছিলাম। আমি বসে ছিলাম। হঠাৎ একটা ছেলে আসল আমাদের সামনে। পরনে স্কুলের পোষাক, মাথার চুল এলোমেলো। জামা কাপড় দেখে মনে হয়েছে স্কুলের ছাত্র কিন্তু আবার তার মাথার চুল আর হাত পায়ের অবস্থা দেখে তা মনে হচ্ছিল নাহ। জানিনা সেই অল্প সময়ে অনেক কিছুই ভাবা যেত, কিন্তু পরের ক্লাসের তাড়া থাকাতে কিছু ভাবার সময় ছিল নাহ।

আমরা যে কয়জন বসে ছিলাম তাদের মাঝে সৈকতের কাছে এসে ছেলেটি বলল “ভাইয়া আমাকে একটু নুডুলস খাওয়াবেন? আমার খুব খিধা লাগছে।“
তার কথা শুনে সৈকত আমার দিকে তাকিয়ে বলল “বলেনতো এখন কি করি?”
আমি বললাম “কী করবা আর, দেখ কিছু করতে পার কিনা?”

ছেলের মুখ দেখে আমার কেন জানি মায়া হল খুব। ভিক্ষুককে আমি খুব একটা ভিক্ষা দেই নাহ, কারণ কিছু বাজে অভিজ্ঞতা আছে আমার। কিন্তু এই ছেলেটাকে দেখে আমার কেন জানি নিজের কথা মনে হল। নিজে একটা সময় তার পর্যায়ের ছিলাম কিনা।

আমাদের মাঝে কথা শুনে ছেলেটি হয়ত বুঝতে পেরেছে তার ক্ষুধার জ্বালা আমরা বুঝতে পারি নাই বা তার আবদার আমাদের মন গলাতে পারে নি। আমাদের সামনে থেকে চলে গেল।

আর আমরাও সেই মুহূর্তে রেডি হচ্ছিলাম পরের ক্লাস ধরতে হবে তাই, দেরি করে ক্লাসে গেলে আর উপস্থিতি দেন না স্যার।

কিন্তু নিজের সাথে, মনের সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেলাম। পেটের দায়ে পড়ে নিজেই খেতে আসলাম আর ছোট একটা ছেলের ক্ষুধার দায় মেটাতে চোরের মত পালাচ্ছিলাম? মাত্র এক বেলাইতো, মাত্র একটা বাটি নুডুলস। ভার্সিটির টঙ দোকানগুলোতে যারা নুডুলস খেয়েছে তারা বলতে পারবে সেই নুডুলস তেমন আহামরি কিছু নাহ।

পারলাম নাহ। সৈকতকে টাকা দিয়ে বললাম ছেলেটাকে নুডুলস কিনে দিতে, কিন্তু জানি নাহ কেন সৈকত নিজে দিতে রাজি হল নাহ, আমাকেই দিতে বলল। ছেলেটা এরই মাঝে অন্যদের কাছে একইভাবে একটু নুডুলস খুঁজছিল। তাড়াতাড়ি কামরুলের দোকানে গেলাম (কাদেরর পাশের দোকান)। নিজের খাবারের বিলের টাকা দিয়ে নুডুলসের টাকা রাখতে বললাম। আর ছেলেটাকে অন্যের কাছে ক্ষুধার দায় পেশ করা থেকে নিবৃত করে ডেকে নিয়ে আসলাম। কামরুলকে ডেকে বলে দিলাম যেন ওকে আমার নুডুলসটা রান্না করে দেয়। ছেলেটা খুশি হয়ে গেল। আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকাল। হাসিতে যেন খেলে যাচ্ছিল একটা কথাই “ধন্যবাদ”। কথাটা আমি মনে মনেই বানিয়ে নিলাম।

ভাইয়া ঝাল দিয়েন না বলে ছেলেটা যেন অপেক্ষা করতে শুরু করেছিল। আমি জানি সেই অপেক্ষা কেমন হয়, সেই আগ্রহ কেমন হয়। দোকানের পাশে পাতা বসার জায়গায় তাকে বসিয়ে আমি ছুটলাম ক্লাসের দিকে।

যাবার সময় নিজেকে নিজে প্রশ্ন করতে থাকলাম মনে মনে যেই আমি ভিক্ষুকদের দেখলে খুব একটা দয়া দেখাই নাহ কেন সেই আমি আজ এমনটা করলাম?

উত্তরটা নিজের কাছে রেডিই ছিল। নিজে যে জ্বালায় মরেছি অন্যের সে জ্বালা সহজেই মানুষ বুঝতে পারে। যে জ্বালায় মানুষ পুড়ে নি সে জ্বালা কী করে বুঝতে পারবে?

আজ আমি নিজের ল্যাপিতে টাইপ করে কী সুন্দর করে লেখাটা লিখছি। কিন্তু ছেলের কষ্টটা যে আমি নিজেও একটা সময় পেয়েছিলাম তা কী করে ভুলে যাই। আর তাই নিজের অজান্তে চোখ ভিজে যায় দুজনের দুঃখে। ছেলেটার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। তার জন্য খাবারের অর্ডার দিয়ে তাড়াতাড়ি সেই যায়গা থেকে পালিয়ে বাঁচলাম। পরে নিজের কথাই নিজের মনে আসল। সামাজিক পরিস্থিতির কারণে আমি তার মত অন্যের কাছে ক্ষুধার জ্বালা পেশ করতে পারি নাই। কোন দিন ৫টাকার ঝাল মুড়ি বা কোনদিন শুধু পানি খেয়ে ক্যাম্পাসের দুপুর পার করেছি। আমি এখন ক্ষুধাকে খুব ভয় পাই। একটু ক্ষুধা লাগলে আর সহ্য হতে চায় নাহ। মনে হয় যেন নাড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়।

বাবার রিটারমেন্টের পরে যা কিছু টাকা তিনি পেয়েছিলেন, একটা ব্যবসার পেছনে সেটা প্রায় পুরটাই ঢেলে দিয়েছিলেন। লাভের কোটা হয়ে গেল বিপরীত। বাসায় তখন এমন অবস্থা ছিল যে পাঁচজনের সংসার চালানোই তাঁর জন্য বিশাল বোঝা হয়ে গিয়েছিল। কোন টিউশনি নিজেও পাচ্ছিলাম নাহ আর বাবারও কোন কাজ ছিল নাহ। কী দারুণ কষ্টটা আমাকে পেতে হয়েছে তা জানি আমি। আল্লাহর কাছে লক্ষ কোটি শুকরিয়া যে তিনি আমাকে আমাদের পরিবারকে সেই অবস্থা থেকে বের করে এনেছেন। কিন্তু আমি সেই অবস্থাটাকে আমি খুব ভয় পাই এখন, খুব ভয় পাই।

সেদিনের তাড়ার কারণে ছেলেটার সাথে কোন কথা বলা সম্ভব হয় নি। সময় থাকলে তার সাথে কথা বলার ইচ্ছা ছিল। তার খাওয়াটা দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ যেভাবে খাবার খায় সেটা খাবারকে ভালোবেসে খায়, পরম মমতায় তৃপ্তি নিয়ে খায়। জানার ইচ্ছা ছিল সে কোথায় থাকে, পরিবারে কে কে আছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আজ আমি বুঝি খাবারের আসল মজাটা কোথায়। আমরা অনেকেই শুধু শুধু খাই, সত্যি বললে আমি নিজেও তা করি। এটা আমার কাছে দোষ মনে হয় না। কিন্তু যখন দেখি একজন মানুষ খাবার নষ্ট করছে তখন আমার খুব খুব খুব খারাপ লাগে, আবার যখন দেখি খাবার নিয়ে মানুষের মাঝে নানা রকম নাক সিটকানো ভাব তখনো খারাপ লাগে। অনেকে খাবার পায় নাহ আর সেখানে কিনা একজন এমন হলে খাবে নাহ, এই জায়গার হলে খাবে নাহ ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বাস্থ্য সচেতন আমাদের সবারই থাকাটা জরুরি তাই বলে খাবারকে আমরা অপমান করতে পারি নাহ।

আজ সবার কাছে অনুরোধ আপনার কাছে খাবার আছে আপনি খান... ইচ্ছামতন পরিমানের খাবার খান, কিন্তু তাই বলে খাবার নষ্ট করবেন নাহ। রিযিক প্রদানের মালিক আল্লাহ কিন্তু আমাদের তা অর্জনের জন্য প্রচেষ্টা করতে হবে। আপনি আমি যে খাবারটুকু অনায়াসেই ময়লার মাঝে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছি সেই খাবারটুকুও অনেকে অর্জন করতে পারে না। শপথ করে বলে দিতে পারি সারাদিন খেটেও সেই পরিমাণের খাবার অনেকেই অর্জন করতে পারে নাহ। ক্ষুধার জ্বালায় কষ্ট পেয়ে কেউ যদি আপনার কাছে খাবারের জন্য টাকা খুঁজে তাকে তিরস্কার না করে, টাকা না দিয়ে সেই টাকা দিয়ে পারলে তাকে কিছু খাবার কিনে খাওয়ান। লিখে রাখতে পারেন ক্ষুধার্থের খাবার খাওয়া যখন দেখবেন তখন আপনি মন থেকে তৃপ্তি অনুভব করবেন। সৃষ্টিকর্তা আমাদের পরিশ্রম করে খাবার অর্জন করতে বলেছেন অর্থাৎ খাবার হচ্ছে আমাদের নিজের বুদ্ধি মেধা আর শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত সম্পদ। আপনি কি চাইবেন আপনার সম্পদ নষ্ট হোক নাকি তার সঠিক ব্যবহার হোক? কেউ খাবার নষ্ট করছে দেখলে তখন খুব কষ্ট হয় তার প্রতি রাগও হয় প্রচণ্ড......

জানি না লেখাটা কেমন হয়েছে। খারাপই হবার কথা কারণ আমার লেখার হাত ভালো নাহ। মনের ভাব প্রকাশ করতেও আমি অন্য অনেকের থেকে পিছিয়ে পড়া। তাই লেখাটা কারো বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ালে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন...... ......

৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×