somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা



(২০)

কিছুটা আস্বস্ত হলাম যখন দেখলাম এনিষ্টে আর আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলছে না,লোকেরা যারা নিজেদের মহৎ,উদার ভাবে,যারা মনে করে অন্যদের চেয়ে তারা অনেক উচুদরের মানুষ,লজ্জায় তারা অন্যের মুখের দিকে তাকাতে পারে না,হ্য়তো অত্যাচার,
যন্ত্রনার মুখে ঠেলে দিতেও তার কোন দ্বিধা হবে না।বাইরে আঙ্গিনায় কটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছিল।
বললাম,‘‘বরফ পড়ছে আবার,বাড়ীর লোকজন কোথায় গেল,সবাই?বাইরে এত অন্ধকার হয়্র গেছে,বাড়ীতে আপনাকে একলা রেখে কোথায় গেল সবাই?একটা মোমবাতিও জ্বেলে দিয়ে যায় নি’?
‘হ্যা,আমারও বিশ্বাস হচ্ছে না,আমাকে এ ভাবে ফেলে কোথায় গেল সবাই’,এনিষ্টে উত্তর দিল।তার কথার মধ্যে এতই আন্তরিকতা ছিল,অন্যান্য চারুশিল্পীদের মত তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে পারলাম না,তাকে আরও কাছের মানুষ হচ্ছিল,তখন।হয়তো সবকিছু বুঝতে পেরেই এনিষ্টে আমার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিল,বুঝতে পারলাম ওস্তাদ ওসমানের হেরাতের চারুশিল্পীদের ছবি আঁকার নিয়মের ভবিষ্যত শেষ হয়ে আসছে।যদিও অনেক কান্না ছিল মনে,যতই হতাশ হই না কেন,এগিয়ে যাওয়াটাই জীবন,বেঁচে থাকা।
‘আমাদের বই এর কাজ থামানো যাবে না,চালিয়ে যাওয়াটাই ঠিক হবে’,আমি বললাম, ‘যে ভাবে চলছে সে ভাবেই চলুক’।
‘আমাদের এই চারুশিল্পীদের মধ্যে একজন খুনী আছে,আমি সিয়াহর সাথে আমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি’।
এনিষ্টেকে কি আমাকে উস্কাচ্ছে তাকে খুন করার জন্যে?
‘সিয়াহ কোথায় আছে,এখন’?জিজ্ঞাসা করলাম, ‘সেকুরে আর তার ছেলেমেয়েরাই বা কোথায় গেল’?মনে হলো,অন্য কোন এক মহাশক্তির ইঙ্গিতেই প্রশ্ন করলাম,
আশাবাদীর হওয়ার আর কোন কারণ নাই।আমি বুদ্ধিমান আর ব্যাঙ্গাত্মক এক চিত্রের এক প্রধান চরিত্র।আমার কাঁধের ফেরেশতাদের আমাকে যেন আনন্দে টানাটানি করে বলছিল-শয়তান লুকিয়ে কোথাও থেকে কোনভাবে আমাকে নিয়ন্ত্রন করছে।বাইরে কুকুরগুলো চীৎকাঁর করে যাচ্ছে যেন রক্তের গন্ধ ছুটে যাচ্ছে তাদের নাকে।

মনে হচ্ছে এই সময়টা আমি বসে আছি দূরের অজানা কোন এক শহরে অজানা কোন এক সময়ে,বরফে ঢাকা তবে দেখা যাচ্ছে না,আলোর অভাবে।আমি চোখের জলে জড়সড় বুড়োকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম-আমি সম্পূর্ন নির্দোষ।এনিষ্টের চোখদুটো শয়তানের চোখের মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে-যে কোন মুহুর্তে আমাকে যেন ধ্বংস করবে।মনে পড়লো,তখন বছর দশ বয়স,আমি চারুবিদ্যার শিক্ষানবীস কিন্ত চেহারাটা খুব একটা মনে পড়ছে না,বেশ ফ্যাকাসে সরল একটা মুখ,সেটা সরে গিয়ে আজকের এই ভয়ংঙ্কর কিছু একটা হারানো পুরোনোর চেহারায়।

উঠে কাঁচের গেলাস,থালার পাশে রাখা পেতলের কালির দোয়াতটা হাতে তুলে নিয়ে এনিষ্টে এফেন্দীর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম-আমার মাঝে ওস্তাদ ওসমানের চারুশিল্পী এঁকে যাচ্ছিল ছবিটা যা দেখছি আর রং হারানো লুকানো পুরোনো।অনেকটা যেন আমাদের নিজেদের স্বপ্নে আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখে যাই।

‘আমি যখন দশ বছর বয়সের শিক্ষানবীস,ঠিক এ ধরণের একটা কালির দোয়াতের কথা আমার মনে পড়ে’।
‘ওটা তিনশ বছরের পুরানো মঙ্গোলীয়ান কালির দোয়াত’,এনিষ্টে এফেন্দী বললো, ‘ এটা সিয়াহর আমার জন্যে তাব্রিজ থেকে আনা এটা লাল কালির দোয়াত’।
ঠিক সে সময় শয়তান আমাকে খোঁচাচ্ছিল,ঐ কালির দোয়াত সব শক্তি দিয়ে
ঐ বুড়োর নোংরা মগজটা মেরে বের করে দেই।কিন্ত আমি শয়তানের কাছে আত্মসমর্পন করিনি,মিথ্যা এক হতাশায় এনিষ্টেকে বললাম, ‘জারিফ এফেন্দী আমার হাতেই খুন হয়’।

এটা নিশ্চয় কাঁরও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না,কেন আমার এই স্বীকারোক্তি?একটূ আশা,এনিষ্টে আমার অপরাধের কারণটা শুনলে,হয়তো আমাকে ক্ষমা করবে-কিছুটা ভঁয় পেয়ে আমাকে সাহায্যও করতে দ্বিধা করবে না।


আমি তোমার প্রিয় চাচা

অদ্ভুত একটা নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল চারপাশ,যখন সে বললো জারিফ এফেন্দী আমার হাতেই খুন হয়,ধরেই নিলাম ও আমাকেও খুন করবে।সারা শরীর কাঁপছিল-ও কি এখানে আমার জীবনটা শেষ করার জন্যেই আসলো,না কি আমাকে ভঁয় দেখাতে?বেশ ভঁয় হচ্ছিল-বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না ঐ দক্ষ শিল্পীর মনটা,যার তুলির আঁচড় আর রং এর চমৎকাঁরিত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে বছরের পর বছর,তবে এখন সে অন্য কেউ আরেকজন।অনুভব করছিলাম সে আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে,হাতে পেতলের বিশাল কালির দোয়াত,হয়তো আমাকে মারার জন্যে,তবু আমি পেছনে তাকায়নি একবার।
জানি আমার নিস্তব্ধতাও নিঃসন্দেহে ওকে বেশ বিচলিত করবে্‘কুকুরগুলো এখনও
চীৎকাঁর করছে,কেমন জানি একটা কান্নার সুর’,আমি বললাম।
দুজনেই চুপচাপ,বোঝা যাচ্ছিল আমার বলা বা করার উপরে নির্ভর করছে,মৃত্যু বা দূর্ভাগ্য কি আছে আমার ভাগ্যে!নিঃসন্দেহে সে খুব বুদ্ধিমান,আমরা যদি মেনে নেই একজন চারুশিল্পীর কোন সময়েই উচিত না তার নিজস্ব বিশ্বাসকে ছবিতে ঢেলে দেয়া,তা হলে বিপত্তির একটা সুরাহা হবে,বুদ্ধি বিরাট একটা সম্পদ।ও কি সুযোগ নিচ্ছে বাসায় কেউ নেই বলে?
বুড়ো মনটা নানান প্রশ্নের যুদ্ধে কাতর হয়ে আছে,সেকুরে কোথায় কি করে বেড়াচ্ছে?
‘তুমি জানতে যে আমিই সেই দোষী,তাই না’?সে জিজ্ঞাসা করলো।
আসলে আমি কিছুই জানতাম না,ও বলার আগে।ভাবছিলাম,একদিক দিয়ে চিন্তা করলে হয়তো এই খুনে পরিস্থিতি অনেক বদলে ভালই হলো,না হলে চারুশিল্পী জারিফ এফেন্দী তার অস্থিরতায় কখন যে কি করে ফেলতো,বলা মুশকিল ছিল।
একদিকে আমি কৃতজ্ঞ ঐ খুনীর কাছে,যদিও ভঁয়ে কাতর হয়ে ছিলাম তার পাশে।
‘তুমি যে ওকে খুন করেছ খুব একটা অবাক হয়নি’,আমি বললাম, ‘আমাদের মত মানুষেরা যারা বই আর ছবির জগতে ডুবে আছে,তাদের কাছে একটাই ভঁয়,আমরা যুদ্ধ করে যাচ্ছি পৃথিবীর ছবিটা তুলে ধরার,আমরা মুসলমানদের ছবি আঁকার চেষ্টা করছি।
ইস্পাহানের চারুশিল্পী শেখ মোহাম্মদের মত চারুশিল্পীরা এ জন্যে নিজেকে দোষী ভেবে অনুতাপ করে,অন্যান্যরা দোষ দেয়ার আগেই আমরা আল্লাহর কাছে মাফ চাই।আমরা গোপনে আমাদের বই আর ছবির কাজ করে যাই।এটাও জানি,হোজা,মোল্লা,কাজীদের,
সুফীদের কাফের ঘোষনা করার যুদ্ধ,যেমন ভঁয় আনে মনে,একই ভাবে উদ্ধুদ্ধ করে আমাদের।
‘তা হলে আপনি মনে মনে লোকটাকে খুন করার জন্যে,আমাকেই দোষী ভাবতেন’?
‘ছবি আঁকা,লেখা যা আমাদের টেনে নিয়ে যায় অন্য কোন এক পৃথিবীতে,লুকানো আছে অন্যদের চোখে।শুধু অর্থ আর খ্যাতির জন্যে সকাল থেকে সন্ধ্যা,মোমবাতির আলোয় ছবি আঁকা,লেখা না আমাদের-আমরা সমস্ত আবেগ দিয়ে ছবি আঁকি,লেখে যাই গল্প কথা,তবে এটাও আমাদের ইচ্ছা যে ঐ সব একপাশে পড়ে থাকা মানুষেরা যেন দেখে ছবিগুলো-তারা যদি আমাদের পাপী বলতে চায়,বলুক।কত যন্ত্রনাই না সহ্য করতে হয় চারুশিল্পীদের,
লেখকদের?ছবিতে লুকানো শিল্পীর প্রসব যন্ত্রনা,যা কাঁরও চোখে পড়ে না,পড়বে না কোনদিন।যদি সেটা কাঁরও চোখে ধরা পড়ে সে বলে উঠে ছবিটা অসম্পুর্ন,জঘন্য আর অপবাদ দেয়া হয় সামাজিক বিরোধীতার।শিল্পীদের সবাই চায় সেখানে পৌঁছাতে,যেখানে তারা বড় একাকী।কে চায় ঐ নিজর্নতায় ছুটে যেতে?নিজেকে দোষ দিয়ে শিল্পীরা মনে করে যদি কেউ কোনদিন তাকে অপরাধীও ভাবে হয়তো রেহাই পাবে সে।আবার অনেকে তার স্বীকারোক্তি শুনে ভাবে,নিঃসন্দেহে দোজখ যাওয়া ছাড়া উদ্ধার নেই-ইস্পাহানের চারুশিল্পীর নিজের হাতে জ্বালানো ঐ দোজখের আগুন’।

‘কিন্ত আপনি তো চারুশিল্পী না,আপনি হয়তো আমাদের কষ্ট ঠিক উপলদ্ধি করতে পারবেন না’,সে বললো, ‘তা ছাড়া,আমি কিন্ত ভঁয়ে তাকে খুন করিনি…’।
‘আমি চারুশিল্পী না হলেও তোমার খুনের কারণটা বুঝতে পারছি,তুমি ছবি আঁকতে চাও তোমার আবেগে মন ঢেলে তুলির আঁচড়ে,তুমি চাও না বাইরের কোন ভঁয়,চাপ তোমাকে দিকহারা করে’!

মনে হলো এই প্রথম যে চারুশিল্পী আমাকে খুন করার জন্যে ব্যাস্ত ছিল,বুদ্ধিমানের মত একটা কথা বললোঃ ‘আমি জানি সব কিছু এত সুন্দর ভাবে ব্যাখা করে বলছেন,আমাকে হতবুদ্ধি করার জন্যে,বোকা বানানোর জন্যে,যাতে নিজেকে উদ্ধার করতে পারেন’,তারপর সে বললো, ‘যা বললেন হয়তো সবই সত্যি,তবুও আমি চাই আপনি আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবেন’।
তার চোখ দুটো দেখে বুঝলাম,সে ভুলে গেছে যথাযথ নিয়ম কানুনগুলো,সে ভেসে গেছে তার চিন্তার স্রোতে,কিন্ত কোথায়?
‘ভঁয় পেও না,তোমার মত সম্মানী লোককে আমি অসম্মান করবো না’,বলে সে একটু বিরক্তির হাসি দিয়ে সামনে চলে এলো।‘এমন কি এখনও’,সে বললো, ‘আমি যা কিছু করে যাচ্ছি করে যাচ্ছি,সেটা যেন আমি না,অন্য কেউ।আমার মধ্যে লুকানো এক শয়তান ঠেলে দিচ্ছে আমাকে এই অপকর্মের দিকে।কিন্ত এ ছাড়া আমার আর কিছু করার নাই,এটা অনেকটা ছবি আঁকার প্রেরনার মত’।
‘এটা অনেকটা পুরোনো বই এর কাহিনীর,শয়তানের গল্প’।
‘তা হলে তুমি মনে কর,আমি মিথ্যা কথা বলছি’?
মনে হলো আমাকে খুন করার মত সাহস ছিল না তার,হয়তো আমাকে রাগানোর চেষ্টা করছে।
‘না তুমি মিথ্যা কথা হয়তো বলছো না,তবে তুমি তোমার মনের কথাটাও বলছো না’।
‘আমি আমার অনুভুতি প্রকাশ করছি,আমি কবরের আজাব অনুভব করছি,না মরেই।
আমাদের মাথা পর্যন্ত ডুবে গেছে পাপে শুধু তোমার কারণে,আর এখন তুমি সাহসের বক্তৃতা দিচ্ছ।তোমার কাঁরণেই খুনী আমি।নুসরেত হোজার লোকজন এখন খুঁজে খুঁজে আমাদের সবাইকে খুন করবে’।
যতই আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছিল সে,ততই চীৎকাঁর করে কথা বলছিল,আর কালির দোয়াতকে হাতে জোরে জড়িয়ে ধরছিল।হতে পারে বরফ ঢাকা রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কেউ কি ওর চীৎকাঁর শুনে এদিকে ছুটে আসবে?
‘তুমি কি ভাবে খুন করলে’?আমি জিজ্ঞাসা করলাম।‘কি ভাবে জারিফ এফেন্দীর সাথে কূয়ার ধারে তোমার দেখা হলো’?
‘ঐ দিন রাতে জারিফ এফেন্দী বাড়ীতে আমার সাথে দেখা করতে যায়’,অনেকটা স্বীকারোক্তির সুরে সবকিছু বলা আরম্ভ করলো সে।‘জারিফ দুই পাতার শেষ ছবিটার কথা বলা আরম্ভ করলো,ওকে বুঝিয়ে বললাম ওটা নিয়ে লাফালাফি করার মত এমন কিছুই নাই।একসময় আমরা আগুনে পুড়ে যাওয়া এলাকাটার দিকে গেলাম।আমি ওকে কূয়ার কাছে আমার লুকানো মোহরের গল্প বললাম,ও কিন্ত বিশ্বাস করলো আমাকে...,এর চেয়ে আর কি প্রমান দরকাঁর যে শিল্পীদেরও টাকার লোভ আছে?তা ছাড়া আরেকটা কাঁরণে আমার কোন অনুশোচনা নাই,ও তেমন একটা ভাল শিল্পী ছিল না,তেমন কিছু ক্ষতি হয়নি।বিশ্বাস হচ্ছিল না,লোভী গাধাটা নখ দিয়ে খুড়ে মোহরগুলো বের করার চেষ্টা করছিল।সত্যি সত্যিই যদি মোহর আমার লুকানো থাকতো,হয়তো খুনটা আমাকে করতে হতো না।হ্যা,তুমি কি ভাবে ও ধরণের একটা জঘন্য চরিত্রের লোককে বই এর অলঙ্কারের কাজ দিলে?জারিফের কাজের সৌন্দর্য ছিল ঠিকই তবে,তবে রং ব্যাবহার করে সে কোনদিনই সৌন্দর্যটাকে তেমন একটা তুলে ধরতে পারে নি।না,আমি কোন চিহ্ন রাখিনি...আচ্ছা ছবি আঁকার বিশেষত্বটা কি?
আজকাল আমরা পোট্রেট,মঙ্গোলীয়ান ছবি আঁকার পদ্ধতির কথা বলি।কিন্ত শুধু পদ্ধতিই কি একজন শিল্পীর চমৎকারিত্বের মাপকাঠি’?

‘ভঁয় পাবে না’,আমি বললাম, ‘নতুন পদ্ধতি শুধু শিল্পীর নিজের ইচ্ছাতেই আসে না।একজন শাহজাদা মারা যায়,একজন শাহ যুদ্ধে হেরে যায়,অবিশ্বাস্য শক্তিশালী ক্ষমতার শেষ হয়,ছবি আঁকা বন্ধ হয়,শিল্পীরা এখনে ওখানে চলে যায়,কাজ খুঁজে বেড়ায় জায়গায় জায়গায়।
হয়তো কোন এক দয়ালু সুলতান ঐ সব নির্বাসিত শিল্পীদের একসাথে নিয়ে আসে,দক্ষ চারুশিল্পী,কালিগ্রাফার,তার প্রাসাদে আর আসে নতুন শিল্প পদ্ধতি।এই সব শিল্পীরা যদিও এঁকে অন্যের কাজের সাথে তেমন একটা পরিচিত না,প্রথমে সবাই চেষ্টা করে তাদের নিজেদের পুরোনো পদ্ধতিতে,তবে শিশুদের মতই ঝগড়া করে তারা,তাদের মধ্যে সমঝোতা আসে আর উদ্ভব হয় নতুন পদ্ধতির।এই নতুন পদ্ধতির উদ্ভব হয় বছরের পর অসমঝোতা,ঝগড়াঝাটির পর।বেশীর ভাগ সময় সাধারণত প্রতিভাবান শিল্পীর হাত ধরে জন্ম নেয় নতুন পদ্ধতি।অন্যান্যদের হাতে সেটা মাজাঘষা,সৌন্দর্য প্রকাশের ছোঁয়া আসে’।

আমার দিকে ভঁয়ে তাকাতে পারছিল না সে,কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞাসা করলো প্রেমে অন্ধ এক কুমারীর মত,‘আমার কি নিজের কোন পদ্ধতি আছে’?

ভাবছিলাম হয়ত কান্নায় ভঁরে যাবে আমার চোখ,সব সহানুভুতি,দয়া সাজিয়ে মনের কথাটাই বললাম,সেটাই ছিল সত্যি,‘ষাট বছরের অভিজ্ঞতায় তোমার মত প্রতিভাবান শিল্পী আমি দেখিনি যার আবেগ,অনুভুতি,তুলিতে যাদুর ভাষায় ফুটে উঠে।অন্যান্য হাজারো শিল্পীর কাজের মাঝে তোমার একটা ছবিও যদি থাকে,সেটা বের করতে আমার একটুও কষ্ট হবে না,আল্লাহর দেয়া এই প্রতিভা এটাতে নিঃসন্দেহে আছে বেহেশতী ছোঁয়া’।

‘মেনে নিচ্ছি তোমার কথা,হয়তো ওটাই সত্যি’,সে বললো, ‘তবে মনে হয় না তোমার ক্ষমতা আছে আমার ছবির রহস্য উপলদ্ধি করার।হয়তো ভঁয় পেয়ে বানিয়ে সব মিথ্যে বলে যাচ্ছ।আচ্ছা,বল আমার ছবিতে এমন কি বিশেষত্ব খুঁজে পেলে যে তুমি এত প্রশংসা করছো’?
‘তোমার কলম,তুলি খুঁজে নেয় যথাযথ একটা চেহারা,কোন এক অজানা ছোয়ায়।তোমার কলম যা আঁকে সেটা না সত্যি না কল্পনা!ভিড়ের একদল মানুষের ছবি আঁক,সেখানে থাকে চোখে চোখের ভাষার উত্তেজনা,সবকিছু সাজানো জায়গামত আর লেখায় সেটাই ছূটে যাওয়া যথাযথ ভাবে,কথাবার্তা,কানাঘুষা কোন কিছুই বাদ পড়ে না।আমার চোখে সেটা নতুন একটা ভাষা,যা ঐ ইউরোপিয়ান শিল্পীরাও ধারে কাছে যেতে পারেনি’।

‘ঠিক আছে ইউরোপীয়ান শিল্পীদের কথা ভুলে যাও।এখন নতুন করে বল’।
‘তোমার ছবির মুখ,চেহারাগুলো এতই আবেগে ভঁরা,স্পষ্ট,ঝকঝকে,যে ছবিগুলো দেখলেই
মনে হয়,ওর চেয়ে বাস্তব আর প্রানবন্ত কিছু হতে পারে না।তোমার ছবি প্রানবন্ত ভাব একজন বিশ্বাসীকে নিয়ে যেতে পারে বিপথে,আবার একজন কাফেরকে নিয়ে আসতে পারে আল্লাহর পথে’।
‘মনে হয় না আমি অত প্রশংসার যোগ্য।তবুও আবার আরম্ভ কর’।
‘মনে হয় না এমন কোন চারুশিল্পী আছে যার ছবির সৌন্দর্য আর রং এর বিচিত্র ছোঁয়ায় প্রানবন্ত হয়ে যায় যে কোন ছবি।তোমার তুলির মায়াবী ছোঁয়া আর প্রানবন্ত রং এর বৈচিত্রতা অতুলনীয়’।
‘ঠিক আছে,এ ছাড়া আর কি কিছু বলার নাই তোমার’?
‘হয়তো তুমি জান কি না আমার মতে তুমি বিহজাদ আর মীর সায়ীদ আলীর পরের সবচেয়ে খ্যাতনামা শিল্পী’।
‘সেটা আমি জানি।সে জন্যেই আমি বুঝতে পারছি না তুমি কেন ঐ সস্তাদরের শিল্পী সিয়াহ এফেন্দীকে দিয়ে এই বই এর কাজ করাচ্ছ’?
‘প্রথমত বইটার কাজ সিয়াহ যা করছে সেটার জন্যে জন্যে চারুশিল্পে কোন দক্ষতার দরকার নেই আর তা ছাড়া সে খুনী না,তার মনে কোন অন্ধ পাশবিকতা নাই’,আমি উত্তর দিলাম।
আমার কথা শুনে সে একটুঁ মুচকি হাসলো।ভাবলাম কথাবার্তার পর হয়তো ঐ দুঃস্বপ্নের মত কথা ‘পদ্ধতি’,থেকে অব্যাহতি পাব।এর পর আরম্ভ হলো ওর হাতে ধরা পেতলের মঙ্গোলীয়ান কালির দোয়াতের আলোচনা,তবে বাবা আর ছেলের মত না,বরং দুজন বুড়ো মানুষের মত।এ ব্যাপারে আমাদের দ্বিমত ছিল না,মঙ্গোলীয়ানরা যদি চীনের চারুশিল্পীদের কাছ থেকে লাল রং এর সৌন্দর্যটা খোরাসান,বোখারা আর হেরাতে না নিয়ে আসতো,ইস্তাম্বুলে আমরা ছবি আঁকার যে অন্যন্য সৌন্দর্য দেখতে পাই,তার কথা চিন্তা করতেই পারতাম না।আলোচনা হলো সময়ের স্রোতের সাথে সাথে ছবির ধরণ,রীতি বদলানোর কথা।আমার মনে বাসায় কেউ নেই আর এখনও তার হাতে ধরা ভারী কালির দোয়াতটা।
অন্যান্য যে কোন কাজের দিনের মত,সে জিজ্ঞাসা করলো, ‘বইটা শেষ হওয়ার যারা আমার ছবিগুলো দেখবে,তারা কি উপলদ্ধি করতে পারবে আমাদের মনের ঝড়টা’?
‘আল্লাহর ইচ্ছায় যদি আমরা বইটা শেষ করতে পারি,বইটা যাবে সুলতানের কাছে,আর উনি পর্যবেক্ষন করে দেখবেন,সোনার পাতাগুলো যেভাবে দেয়ার কথা সেটা ঠিকভাবে দেয়া হলো,কি না।নিজের কাছে নিজের গল্পকথা বলার মত পরিস্থিতিতে,সুলতান নিজের পোট্রেটের দিকে তাকিয়ে অবাক হবেন।সুলতান আরও অবাক হবে দেখবেন ঘন্টার পর ঘন্টায় আবেগ,ছন্দে আঁকা আমাদের হাতে তৈরী ছবিটা।তারপর কি হবে তোমার জানাই আছে,
সুলতান বইটা তালাচাবি দিয়ে বন্ধ করে রাখবে।হয়তো কোন একদিন হঠাৎ আলোর মুখ দেখবে বইটা কোন এক অলৌকিক সুরে,খুঁজে পাবে কেউ আমাদের ঐ অজানা অন্ধকার থেকে’।
চুপচাপ বসেছিলাম,যেন কোন কিছু একটা ঘটবে বলে মনে হচ্ছিল।
‘কখন ঘটবে সেই অলৌকিক ব্যাপারটা’?সে জিজ্ঞাসা করলো আমাকে,‘কবে কখন কোথায় আমার হ্রদয়ের রক্ত,আবেগের ছবিগুলো আমাকে যথাযথ সম্মান দিবে,যার জন্যে হারিয়ে যাচ্ছে আমার বিরাট একটা সময়,সেটা কি এই জীবনকালে’?
‘না,হয়তো না,হতে পারে কখনও না’।
‘কেন’?
‘তোমাকে কেউ কোনদিন দিবে না যা তোমার প্রাপ্য’,আমি বললাম, ‘আর ভবিষ্যতের মানুষ তোমাকে কাজের সৌন্দর্যটা আরও কম বুঝতে পারবে’।
‘বই তো থাকে যুগ যুগ ধরে থাকে’,বেশ গর্বের সাথেই সে বলল,তবে কথায় ছিল না আত্মবিশ্বাস।
‘জানি না বিশ্বাস করবে কি না,ভেনিসের ওস্তাদ শিল্পীদের কাঁর ও ছবিতে তোমার কাব্যিক অনুভুতি,হ্রদয়ের ছোঁয়াচ,রং এর ছোঁয়াচ,কোনটাই নাই তবে যা আছে সেটা বাস্তবতার কাছাকাছি,রুঢ় সত্যিটা।ভেনিসের শিল্পীরা চিলেকোঠার ঘরে বসে ছবি আঁকে নি,তাদের ছবি রাস্তার ধারে মানুষের কাছে বা প্রাসাদের শাহজাদার ঘরে বসে তার বিছানা,চাদর,আয়না,
তার মেয়ে,বা মোহরের পাশে থেকে বাস্তবতার ছবিটা তুলে ধরা।তারা চেষ্টা করে সবকিছুই ছবিতে তুলে ধরতে যেন ঐ ছবি দেখে যে কেউ পৌঁছে যাবে ঐ পৃথিবীতে,আমি মনে করি না তোমার ছবিতে সেটা আছে।পৃথিবীর চেহারাটা কোন ছবির মাধ্যমে নকল করার বিপক্ষে,আমি,বরং বলতে পার আমি সেটা ঘৃনাই করি।
কিন্ত নিঃসন্দেহে তাদের ঐ ছবিগুলোতে আছে অদ্ভুত এক আর্কষন,যেটা এড়ানো সম্ভব না।ওরা আঁকে যা দেখা চোখে,আর আমরা এঁকে যাই যা দেখা আমাদের মনে।ছবিগুলো বিচার করলে এটা বোঝা যায় ওদের মনছোঁয়া ছবি আঁকার পদ্ধতিতেই চরিত্র,মুখটা অমর হয়ে থাকে।শুধু ভেনিসের উঁচুতলার বাসিন্দারা না,এমন কি দর্জি,কসাই,পুরোহিত,মুদির দোকানদার সবার মন ছুঁয়ে যায় এই ছবি আঁকার পদ্ধতি।একবার দেখায় তোমার মনে হবে,আমার ছবিটাও যেন এ ভাবে জীবন্ত হয়ে ধরা থাকে।মানুষের পোট্রেট,চেহারা আঁকাটা এমন না যা তোমার মন বলে দেয় সেটাই তুলে ধরবে তুলির ছোঁয়ায়,বরং যা তোমার চোখ দেখে সেটাই তো তুলে ধরা উচিত তুলি,রং এ।কোন একটা সময় আসবে যখন হয়তো একদিন সবাই ও ভাবেই ছবি আকবে।যখন চারুশিল্পের কথা মানুষ বলবে ভবিষ্যতে,সেটা বলবে ভেনিসের ছবি আঁকার ধরণ নিয়ে।এমন কি সাধারণ মানুষ শিল্পীর চোখে মনে হবে,সে একজন সাধারণ দর্জি না,বরং নাক,চোখ মুখের বিশেষত্বে বিশেষ একটা মানুষ’।
‘তাতে কি হলো?আমরাও তো পোট্রেট আঁকতে পারি’,উত্তর দিল,আমার আততায়ী।

০০০০০০০০০০
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ২:৪৮
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদির আসল হত্যাকারি জামাত শিবির কেন আলোচনার বাহিরে?

লিখেছেন এ আর ১৫, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৪


গত মাসের শেষের দিকে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ারের ছেলে সালমান, উসমান হাদির সঙ্গে খু*নি ফয়সালের পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সময় হাদিকে আশ্বস্ত করা হয়—নির্বাচন পরিচালনা ও ক্যাম্পেইনে তারা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

লিখেছেন নতুন নকিব, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৩

বাংলাদেশ একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই

ছবি এআই জেনারেটেড।

ভিনদেশী আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সত্যের বজ্রনিনাদে সোচ্চার হওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে দেশপ্রেমিক আবরার ফাহাদকে। সেদিন আবরারের রক্তে লাল হয়েছিল বুয়েটের পবিত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজাকারের বিয়াইন

লিখেছেন প্রামানিক, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:০৪


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

রাজাকারের বিয়াইন তিনি
মুক্তিযোদ্ধার সন্তান
ওদের সাথে দুস্তি করায়
যায় না রে সম্মান?

কিন্তু যদি মুক্তিযোদ্ধাও
বিপক্ষতে যায়
রাজাকারের ধুয়া তুলে
আচ্ছা পেটন খায়।

রাজাকাররা বিয়াই হলে
নয়তো তখন দুষি
মেয়ের শ্বশুর হওয়ার ফলে
মুক্তিযোদ্ধাও খুশি।

রচনা কালঃ ১৮-০৪-২০১৪ইং... ...বাকিটুকু পড়ুন

দিপুকে হত্যা ও পোড়ানো বনাম তৌহিদী জনতা!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস বিডি লিমিটেড (Pioneer Knitwears (BD) Ltd.) হলো বাদশা গ্রুপের (Badsha Group) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। বাদশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান কর্ণধার হলেন জনাব বাদশা মিয়া, যিনি একইসাথে এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাজানো ভোটে বিএনপিকে সেনাবাহিনী আর আমলারা ক্ষমতায় আনতেছে। ভোট তো কেবল লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

লিখেছেন তানভির জুমার, ২১ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:২২



১০০% নিশ্চিত বিএনপি ক্ষমতায় আসছে, এবং আওয়ামী স্টাইলে ক্ষমতা চালাবে। সন্ত্রাসী লীগকে এই বিএনপিই আবার ফিরিয়ে আনবে।সেনাবাহিনী আর আমলাদের সাথে ডিল কমপ্লিট। সহসাই এই দেশে ন্যায়-ইনসাফ ফিরবে না। লুটপাট... ...বাকিটুকু পড়ুন

×