Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
২৫)
পাড়ার দাওয়াতের মেয়েরা আত্মীয়স্বজনসহ,হেজাব একপাশে করে আমাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিল।সেকুরের ঘরে ছেলেদের চীৎকার,কান্না কিছুটা বেমানান ছিল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায়।আমার গোমরা মুখ দেখে নানান ধরণের মন্তব্য করছিল সবাই,কারও মতে বিয়ের সময় হঠাৎ এনিষ্টের অসুস্থতায় আমি বেশ অস্থির হয়ে গেছি হয়তো।এত হৈচৈ এর মধ্যেও সেকুরেকে এনিষ্টের জন্যে রাতের খাবার নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে ভুলে যাইনি,
আমি।ঘরে যেয়ে আমরা প্রথমে এনিষ্টের বরফের মত ঠান্ডা হাতে চুমু খেলাম,তারপর একপাশে সরে গিয়ে একজন আরেকজনকে চুমু খেলাম,সেকুরের জিভ থেকে লজেন্সের একটা মিষ্টি স্বাদ ভেসে আসছিল আমার জিভে।
আমি সেকুরে
মাগরেবের নামাজের কিছুক্ষন পরে লোকজন পেট পুরে পেস্তা বাদাম,আলু বোখারার পোলাও,খাসির মাংস খেয়ে,জুতাটুতা পরে ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাড়ী যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছিল।আঙ্গিনায় আশেপাশে কোথাও কোন শব্দ ছিল না,শুধু একটা চড়ুই পাখীর বালতি থেকে পানি খাওয়ার শব্দ আসছিল।
‘অর্হান,সেভকেত দুজনে এদিকে আয়’,ছেলেরা কোন বাদানুবাদ না করে ঠিকই উঠে আসলো।
‘সিয়াহ এখন তোদের বাবা,ওর হাতে চুমু খা দুজনেই’,কোন অভিযোগ না করে দুজনেই সিয়াহর হাতে চুমু খেটে সম্মান জানালো।আমি সিয়াহকে বললাম,‘বাবা ছাড়াই ওরা মানুষ হচ্ছে,আদব কায়দায় খারাপ না হলেও হয়তো অনেক কিছুই ঠিকঠাক জানা নাই ওদের, কোন রকম ভুল করলে,বাচ্চা ছেলের মত একটু জেদ করে,একটু সহ্য করো।তুমিই ওদের বাবা,শাসন শেখানোর দায়িত্ব তোমার হাতে’।
‘বাবার কথা আমার মনে আছে’,সেভকেত বললো।
‘চুপ করে আমার কথা শোন’,আমি বললাম,‘মনে থাকে যেন এখন থেকে এ বাড়ীতে সিয়াহর কথা আমার কথারও উপরে’।তারপর সিয়াহকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘ওরা যদি কথা না শোনে,অযথা বেয়াদবী করে,প্রথম দিকে ওদের মাফ করে দিও’,যদিও পেটানোর কথাটাই বলার ইচ্ছা ছিল আমার।
‘তুমি আমাকে যে ভাবে ভালবাস,জানি তুমি ওদেরকেও নিজের ছেলের মত ভালবাসতে কার্পন্য করবে না’।
‘আমি শুধু তোমার স্বামী হওয়ার জন্যে বিয়ে করিনি,ঐ ছেলেদের বাবা,আনুষাঙ্গিক অন্যান্য সব দায়িত্বও আমার’,সিয়াহ উত্তর দিল।
‘তোরা দুইজনে শুনলি তো’?
‘আল্লাহ তোমার রহমত আমাদের থেকে কেড়ে নিও না,আমরা সবসময় তোমার রহমতের দরজায় হাত পেতে আছি’,হাইরিয়ে একপাশ থেকে বললো।
‘তোরা দুজন তো সব কিছুই শুনলি’?আমি বললাম,‘আমার দুই সাহসী পুরুষকে
তাদের বাবা এত ভালবাসে যে আগে থেকেই মাফ করে দিচ্ছে,সব কিছু’।
‘পরেও আমি মাফ করে দিব,অনেক কিছুই’,সিয়াহ বললো।
‘তবে দু তিনবার সাবধান করে দেয়ার পরেও যদি কথা না শুনে…তখন কপালে মার ছাড়া আর কিছু নাই।কি কারও বুঝতে কি কষ্ট হচ্ছে?তোদের বাবা সিয়াহ,অনেক যুদ্ধ গেছে,একই যুদ্ধ ছিল সিয়াহ যেখান থেকে তোদের বাবা আল্লাহর আদেশে আর ফিরে আসেনি।অনেক দেশ,অনেক যুদ্ধ,অনেক কষ্ট,অনেক যন্ত্রনা ছিল সিয়াহর জীবনে।তোরা নানার জন্যে খুব নষ্ট হয়ে গেছিস,জানিস তোদের নানা খুবই অসুস্থ’?
‘নানার কাছে যাব’,সেভকেত বললো।
‘ঠিকমত যদি কথা না শুনিস,সিয়াহ এমন মার দিবে যে জীবনেও ভুলবি না।তোর নানা যে ভাবে আমার কাছ থেকে তোকে বাঁচাতো,সেই সুযোগ পাবি না আর।তোর বাবার রাগ থেকে যদি বাঁচতে চাস,তবে ঠিকমত কথা শুনবি।কোন মিথ্যা কথা বলবি না,যেটা জানবি সেটা বাবা মাকে বলবি।আর হ্যা,হাইরিয়েকে অযথা বিরক্তি করবি না,বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না নিশ্চয়’?
অর্হানকে কোলে নিয়ে একপাশে সরে গেল সিয়াহ,দূরে একপাশে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিল সেভকেত,কেমন একটা বিষন্নতা ছিল তার চোখে মুখে।ইচ্ছা হচ্ছিল সেভকেতকে জড়িয়ে কাঁদতে,বাবা হারানো হতভাগা সেভকেত,একাকী এই পৃথিবীতে,কেউ নাই তার।সেভকেতকে দেখে আমার কৈশোরের কথা মনে পড়ছিল,একা তখন এই পৃথিবীতে মা নেই,মনে পড়লো বাবার কোলে খেলার কথা।তবে অর্হানের ভাবে কেমন জানি একটা জড়তা ছিল,অর্হান যেন একটা ফল যে তার গাছের সাথেই অপরিচিত।মনে পড়ছিল বাবা আর আমি ভাবে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে হাসাহাসি করতাম,বাবার চুলের গন্ধ শুকতাম,কান্না আসছিল,জোয়ারের মত,সবকিছু এখনশুধুই স্মৃতি।
নিজের অজান্তেই বললাম,‘কি ব্যাপার দেখি সিয়াহকে বাবা বলে ডাকলে না’?
প্রচন্ড শীতের রাত,আঙ্গিনায় শব্দ নেই কোথাও,দূরের কুকুরের কান্নার ডাক ভেসে আসছিল,নিস্তব্ধতা যেন কুড়ি থেকে ফুল হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিল চারপাশে।
‘ঠিক আছে সবাই ঘরে চল,যা ঠাণ্ডা’,কিছুক্ষন পর আমি বললাম।
সিয়াহ আর আমার মধ্যেই ছিল না বর কনের জড়তা,হাইরিয়ে আর ছেলেরাও ঘরে ঢুকলো অদ্ভুত এক জড়তা নিয়ে।নাকে আসছিল লাশের গন্ধ,তবে ঐ গন্ধটা আর কারও জানা ছিল না সেটা।সিড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে সবাই এ বাড়ীতে ঢুকছি আমরা।
‘ঘুমাতে যাওয়ার আমি কি নানার হাতে চুমু খেতে পারি’?সেভকেত বললো।
‘একটু আগেই দেখলাম’,হাইরিয়ে বললো, তোমার নানা প্রচন্ড ব্যাথায় কাতর হয়ে আছে,
কে জানে খারাপ কোন জিন তার উপর ভর করলো নাকি?প্রচন্ড জ্বর,আর জ্বরের ঘোরে ভুল বকছে,এখন তোমরা ঘরে যাও আমি খাবার নিয়ে যাচ্ছি’।
দুজনের হাত ধরে ঘরে ঢুকলো হাইরিয়ে,তোষক নতুন চাঁদর,লেপ দিয়ে বিছানা করে ছেলেদের শোয়ার বন্দোবস্ত করলো,যেন সুলতানের প্রাসাদের অতিথি।
পেশাবের গামলায় বসে অর্হান জিজ্ঞাসা করলো, ‘হাইরিয়ে আমাদেরকে একটা গল্প বলবে’।
‘এটা অনেক দিন আগেকার কথা,এক দেশে একটা নীল মানুষ ছিল’,হাইরিয়ে গল্প আরম্ভ করলো, ‘আর তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল একটা জিন’।
‘হাইরিয়ে অন্তত আজকের দিনে জিন ভূতের গল্প না হয় নাই বললে’,আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম।
‘কেন কি ব্যাপার,মা তুমি কি আমরা ঘুমালে নানার ঘরে যাবে’?সেভকেত জিজ্ঞাসা করলো।
‘তোমার নানা খুবই অসুস্থ,সবকিছু এখন আল্লাহর হাতে।আমাকে তো নানার কাছে যেতেই হয়,তারপর আমি তো এখানেই ফিরে আসি,ঠিক কি না’?
‘নানাকে দেখার দায়িত্বটা হাইরিয়ের উপরে ছেড়ে দাও,এমনিতেই প্রতি রাত্রে হাইরিয়ে নানার দেখাশোনা করে’,সেভকেত বললো।
‘অর্হান,তোমার পেশাব করা শেষ হলো’?হাইরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো।অর্হানকে পরিষ্কার করে,পেশাবের গামলাটা সরিয়ে নিল,হাইরিয়ে,অর্হানের চোখ তখন ঘুমে ঢুলু ঢুলু।
‘হাইরিয়ে’,আমি বললাম,‘পেশাবের গামলাটা একটু পরিষ্কার করে রাখলে ভাল হয়,এই ঠান্ডার মধ্যে সেভকেত না আবার রাতে পেশাব করতে বাইরে বের হলে খামাখা ঠান্ডা লাগাবে’।
‘কেন আমি ঘরের বাইরে যেতে পারবো না’?সেভকেত বললো, ‘আর এটা কি ধরণের কথা,হাইরিয়ে জিন ভূতের গল্প বলতে পারবে না’?
‘তোর মাথায় কি কোন বুদ্ধি নাই,গাধা?আমাদের বাড়ীতে এখন জিন আছে’,অর্হান পেশাব করার পর হাল্কা হয়ে মন্তব্য করলো,তার কথাগুলো ছিল ভঁয়ে না,জ্ঞানগর্ভ বিচক্ষন এক বুড়োর মত।
‘মা,আমাদের বাড়ীতে জিন আছে,এখন’?
‘তুমি যদি ঘরের বাইরে যাও,কথা না শুনে কোন কারণে নানার ঘরে যাও,জিন তোমার উপরেও আসর করতে পারে’।
‘সিয়াহ কোথায় বিছানা করবে’?সেভকেত জিজ্ঞাসা করলো, ‘কোথায় ঘুমাবে সিয়াহ’?
‘আমি ঠিক জানি না’,আমি বললাম,‘হাইরিয়ে একটু পরে সিয়াহর বিছানা করবে’।
‘মা,তুমি তো আমাদের সাথেই ঘুমাবে,তাই না’?সেভকেত জিজ্ঞাসা করলো।
‘কতবার বলবো আর?আমি তোদের সাথে যে ভাবে ঘুমাতাম ঠিক সে ভাবেই ঘুমাবো’।
‘সব সময়’?
হাইরিয়ে পেশাবের গামলাটা নিয়ে বাইরে গেল।আমি আলমিরা খুলে লুকানো নয়টা ছবি বের করলাম,যা খুনীর হাতে পড়েনি।মোমবাতির আলোতে ছবিগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলাম,ছবিগুলো অবিশ্বাস্য সুন্দর,যে দেখবে ভেসে আসবে তার পুরোনো স্মৃতি নতুন ভাবে।
আমি নিজেও তখন ছবিতে হারিয়ে গেছি,অর্হানের চুলের গন্ধে বুঝতে পারলাম,সেও ঐ অদ্ভুত লাল রং মুগ্ধ হয়ে দেখছে।অন্যান্য অনেক দিনের মত স্তনটা বের করে অর্হানের মুখে গুজে দিলাম,এক সময় আজরাইলের লাল ভয়াবহ চেহারা দেখে ভঁয়ে অর্হান মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিল।
‘আমি তোকে খেয়ে ফেলবো,বুঝলি’?
‘মা,আমার কাতুকুতু লাগছে’,এটা বলে অর্হান বিছানা থেকে নীচে নেমে গেল।
‘সর ওখান থেকে,ওখান থেকে সরে আয় জানোয়ার’,চীৎকার করে বললাম,অর্হান তখন ছবিগুলোর উপরে শুয়ে ছিল।ছবিগুলো পরীক্ষা করে দেখলাম,না কোন ক্ষতি হয়নি,ঘোড়ার ছবিটা একটু মুচড়ে গেছে যদিও,তবে খালি চোখে তেমন একটা বোঝা যাবে না।
হাইরিয়্ পেশাবের গামলা পরিষ্কার করে ঘরে ঢুকলো,আমি ছবিগুলো নিয়ে বের হচ্ছিলাম,
সেভকেত চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করলো,‘মা?তুমি কোথায় যাচ্ছ’?
‘এই এখনই ঘুরে আসছি’।
বরফের মত ঠান্ডা বারান্দাটা হেঁটে পার হয়ে বাবার ঘরে ঢুকলাম,দিন চার আগের মত সিয়াহ বাবার চেয়ারের উল্টা দিকে একটা চেয়ারে বসে ছিল।সিয়াহর সামনে ছবিগুলো একটা একটা করে সাজালাম,সব কিছু যেন জীবন্ত হয়ে ছোটাছুটি আরম্ভ করলো।
মুর্তির মত বসে আমরা অবাক হয়ে ছবিগুলো দেখছিলাম,একটু নড়াচড়া করলেই,
সবকিছু যেন প্রানবন্ত হয়ে ছোটাছুটি করছিল,এমন কি চারপাশের বাতাসও যেখানে ছিল শুধু লাশের গন্ধ।ছবিগুলো তখন নতুন এক ভাষায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল,তবে ওরাই তো আমার বাবার মৃত্যুর কারণ?আমি কি ঘোড়ার ছবিটা দেখে অভিভুত হয়ে গেছি নাকি অভিভুত হয়ে গেছি লাল রং এর রহস্যে।হয়তো অভিভুত আমি শুকনো গাছের হতাশায়,নাকি ঘুরে বেড়ানো ঐ দুই ফকিরের দুঃখে,নাকি আমি ভঁয়ে অনুভুতি হারানো একজন,তবে এই ছবি তো আমার বাবার মৃত্যুর কারণ।সিয়াহ আর আমি বুঝতে পারলাম এ ছবিগুলো আমাদের মাঝেও কেমন জানি একটা নিস্তব্ধতা টেনে আনলো,এক সময় আমরা দুজনেই কিছু একটা বলার জন্যে উদ্বিগ্ন হয়ে গেলান,‘কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাইকে বলতে হবে,বাবা ঘুম থেকে আর উঠেনি’,আমি বললাম।যদিও কথাগুলো ছিল নানসই,তবে কোথায় ছিল একটা শূন্যতা।
‘দেখবে,সকালে সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে’,বললো সিয়াহ,তবে তার কথায় ছিল আস্থার অভাব,যা আমার জন্যেও প্রযোজ্য।সিয়াহ মায়াবী এক চাহনি নিয়ে একসময় আমাকে আসলো,আমিও ওকে জড়িয়ে ধরতে চাচ্ছিলাম।ঠিক তখনই বাবার ঘরের দরজা খোলার শব্দ পেলাম,ভঁয়ে ছুটে গেলাম,দরজা খুলে দেখি আশেপাশে কেউ নাই।বাবার ঘরের দরজা অর্ধেক খোলা,ঘর গরম করা গামলার লাশ নষ্ট হওয়ার গন্ধে ভরে গেছে।সেভকেত না অন্য কেউ ঢুকলো নাকি ঘরটাতে?
গামলার আগুনে দেখা যাচ্ছিল বাবার গায়ের রাতের পোষাক,মনে পড়ছিল,অন্যান্য রাতে বাবা আমার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে বলতো, ‘আমার পানি আনা সুন্দরী কোনদিন কোন কিছুই চায় না’,তারপর আমার হাতে আলতো করে একটা চুমু দিত।আজকে বাবার দিকে তাকাতেই আমার ভঁয় লাগছিল,না জানি কত বীভৎস হয়ে গেছে তার চেহারাটা তখন।
ফিরে গেলাম নীল দরজার ঘরটায়,সিয়াহ ধীরে ধীরে কাছে আসলো,কিন্ত তাকে ঠেলে একপাশে ঠেলে দিলাম,রাগে না,আর কোন কিছু করার ছিল না সে মুহুর্তে।আমরা দুজনে একজনের আরেকজনের পাশাপাশি দাড়ানো,মাঝে মাঝে হাতের,পায়ের ছোঁয়া লাগছিল।
অনেকটা যেন নিজামীর হুসরেভ আর শিরিনের প্রেমের পর্বঃহতে পারে সিয়াহ যে নিজামীর লেখা অনেকবার পড়েছে,ভাবছে শিরিনের মত আমি বললাম, ‘হ্যা,বল’,আসলে আমি
বলছিলাম,‘চুমু খাবে ঠিক আছে,তবে আমার ঠোঁট রক্তাক্ত করে দিও না’।
‘বাবার খুনী না ধরা পড়া পর্যন্ত,আমি তোমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাবো না’,
আমি বললাম।
ঘরটা ছেড়ে গেলাম তাড়াতাড়ি,কিন্ত মনে ছিল প্রচন্ড একটা অস্বস্তি।কথাগুলো কি খুব জোরে বললাম,হাইরিয়ে আর ছেলেরা শুনে ফেললো নাকি কে জানে-হ্য়তো বাবা,এমন কি আমার মৃত স্বামীও,যার শরীর কোথাও ধূলায় মিশে গেছে,শুনতে পেল আমার কথা।
ছেলেদের ঘরে ঢোকার সাথে সাথে অর্হান বললো,‘মা,সেভকেত কিন্ত তোমার কথা রাঝে নি,ও একটু আগে বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল’।
‘তোকে এত করে বলে গেলাম,তবুও তুই বাইরে গেলি’?সেভকেতকে থাপ্পড় মারার জন্যে প্রস্ততি নিচ্ছিলাম।
সেভকেত ছুটে হাইরিয়েকে জড়িয়ে,‘হাইরিয়ে,হাইরিয়ে’,বলে কান্না আরম্ভ করলো।
‘ও তো বাইরে যায় নি’,হাইরিয়ে বললো, ‘ও তো সবসময় এই ঘরেই আছে’।
একটু থতমত খেলাম,হাইরিয়ের চোখের দিকে তাকানোর সাহস ছিল না আমার,বুঝতে পারলাম,বাবার মৃত্যুর খবর শোনার পর ছেলেরা হাইরিয়ের কাছেই ছুটে যাবে সান্তনার জন্যে,হয়তো তাদের গোপ্ন কথাগুলোও প্রথমে বলবে তাকে।হাইরিয়ে কি তাতে সান্তনা পাবে হয়তো না,বাবার মৃত্যুটাও আমার কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করবে,হাসানকে ছেলেদের অভিভাবক বানানোর চেষ্টাও করতে পারে!
কোন সন্দেহ নাই,বাড়ীর কতৃত্বের জন্যে হাইরিয়ে এই চেষ্টা তো করবেই,এই সব পরিকল্পনা,বাবার সাথে অনেক রাত কাটানোর অভিজ্ঞতার ফসল তার,আল্লাহ বাবাকে বেহেশত নসীব করবে।কেন এই কথাগুলো আমি লুকাবো?জানি হাইরিয়ে ইচ্ছা করেই এসব করছে,আমি সেভকেতকে কোলে তুলে চুমু দিলাম।
‘মা, আমি কিন্ত সত্যি বলছি,সেভকেত কিছুক্ষন আগে বাইরে ছিল’,অর্হান বললো,আবার।
‘যা দুজনেই এখন বিছানায় যা,আমি তোদের মাঝখানে ঘুমাবো।আর হ্যা,একটা গল্পটা বলছি লেজ ছাড়া শেয়াল আর কালো জিনের’।
‘কিন্ত তুমি তো হাইরিয়েকে জিনের গল্প বলতে না করলে’,সেভকেত বললো, ‘হাইরিয়ে কেন গল্পটা বলতে পারবে না,আজকে’?
‘ঐ শেয়াল আর জ্বিন কি যাবে এতিমদের শহরে’?অর্হান জিজ্ঞাসা করলো।
‘হ্যা,ওরা যাবে’,আমি বললাম, ‘ঐ শহরের কোন ছেলেমেয়েদের বাবা মা নাই।হাইরিয়ে বাইরে দরজাটা দেখে আসবে।আমরা সবাই হয়তো গল্পের মধ্যে শুয়ে পড়বো’।
‘আমি জানি,আমার ঘুম আসবে না’,অর্হান বললো।
‘সিয়াহ আজকে কোথায় ঘুমাবে’?সেভকেত জিজ্ঞাসা করলো।
‘কাজের ঘরটায়’,আমি বললাম,‘কাছাকাছি আয় সবাই,তাহলে লেপের আরামটা আরও ভাল লাগবে।কার ঠান্ডা পা এটা’?
‘আমার’,সেভকেত উত্তর দিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘হাইরিয়ে কোথায় ঘুমাবে’?
গল্পটা আরম্ভ করলাম আবার,অন্যান্য দিনের মত অর্হান কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেল,
আমার গলার আওয়াজটা তখন একটু নরম হয়ে গেছে।
‘আমি ঘুমালে,তুমি চলে যাবে না তো,মা’?সেভকেত বললো।
‘না,আমি কোথাও যাচ্ছি না’।
আমার কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না,বিয়ের রাতে আমি শুয়ে আছি অর্হান আর সেভকেতের সাথে-আর পাশের ঘরে একা শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে হয়তো আমার প্রিয় স্বামী।এক সময় আমিও ছুটে গেলাম ঘুমের রাজ্যে,তবে আমার ঘুমে ছিল কান্নায় জোয়ার,
ঘুম আর জেগে থাকার মাঝে আমি তখন চরম অস্থির হয়ে ছিলাম।ঘুমে বাবার রাগী আত্মার সাথেও বোঝাপড়া করলাম,এমন কি কোনভাবে খুনীর চাকু থেকে রেহাই পেয়ে ছুটলাম।ঘুমের দেশে খুনী,বাবার রাগী আত্মার থেকেও জোরে জোরে ভয়াবহ চীৎকার করে ঘর্ঘর করছিল,আর পাথরের পর পাথরের ছুড়ে মারছিল আমার দিকে।দুজনেই ছুটছিল জানালা থেকে জানালায়,কখনও ছাদে,খুনী একটা পাথর দিয়ে দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল।একসময় রাগী আত্মার চেহারাটা বদলে হলো একটা ভয়াবহ দানব,আমার বুকের ধড়ফড়ানি পৌঁছে গেল চরমে,সারা শরীর ঘেমে গেছে আমার তখন ঐ শীতেও,ঘুম ভেঙ্গে গেছে তখন।
জানি না শব্দটা স্বপ্নের নাকি বাড়ীর কোথাও থেকে?কিছুটা হতবাক আমি তখন,ভয়েই ছেলেদেরকে আর ও আঁকড়ে ধরে চুপচাপ শুয়ে ছিলাম।ভাবলাম হয়তো শব্দটা স্বপ্নের ঘোরেই শোনা,ঠিক সে সময় পাশের দেয়ালের একটা শব্দ কাঙে ভেসে আসলো,আর ভারী, বিরাট কোন কিছু একটা এসে পড়লো আঙ্গিনায়।ওটাও কি একটা পাথর পড়ার শব্দ নাকি অন্য কিছু?
ভঁয়ে কাপছিলাম,উত্তেজনাও বেড়ে গেছে কয়েকগুন,বাড়ীর ভেতর থেকে আরও শব্দ ভেসে আসছিল।হাইরিয়ে আবার কোথায় গেল?সিয়াহ কোন ঘরে রাত কাটাচ্ছে?দুঃখী বাবার শরীরটা কি ভাবে পড়ে আছে?আল্লাহ তোমার রহম দিয়ে আমাদেরকে রক্ষা কর।ছেলেরা তখনও গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে আছে।
আগে এ ধরণের ঘটনা হলে,আমি ঠিকই উঠে বাড়ীর মালিকের মত ভঁয় না করে,জিন ভূতদের দূর করতাম।এখন আমি নিজেই ভঁয়ে ছেলেদের সাথে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছি।মনে হচ্ছিল দূর্বিষহ কিছু একটা ঘটবে,তাই আল্লাহর কাছে দোয়া পড়া আরম্ভ করলাম।শব্দ করে আঙ্গিনার গেটটা খুলে গেল,আঙ্গিনার গেটটাই হবে?না,আমার আর কোন সন্দেহ নাই।
চাদর গায়ে বিছানা থেকে নেমে ‘সিয়াহ,সিয়াহ’,ফিসফিস করে সিড়ির থেকে ডাক দিয়ে,জুতা পায়ে তাড়াতাড়ি নীচে গেলাম।হাতের মোমবাতি ছিল,কিছুদূর যেতে না যেতেই প্রচন্ড বাতাসে নিভে গেল,যদিও আকাশটা ছিল একেবারেই পরিষ্কার,কিন্ত কোথা থেকে যে দমকা এক ঝলক বাতাসের ধাক্কা ছিল জানি না।চাঁদের আলোয় আঙ্গিনাটা দেখা যাচ্ছিল ভালই,আল্লাহ না জানি কি ঘটছে,এখানে?আঙ্গিনার গেটটা খুলে গেল,আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।কেন যে একটা চাকু হাতে নিলাম না,খুবই বোকা আমি?মোমবাতিদানীও ছিল না সাথে,একটা লাঠিও নাই হাতে,নিজেকে রক্ষা করার কোন উপায় নাই।গেটটা শব্দ করে বাতাসে আপনা আপনিই খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে,পাথরের মত চুপ দাড়িয়ে ছিলাম,নড়াচড়া করার সাহসটাও ছিল না।ছাঁদের দিক থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছিল,বুঝলাম বাবার আত্মার বাড়ী ছেড়ে যেতে কষ্ট পাচ্ছে।যদি সত্যি সত্যি বাবার আত্মা হয়,তবে আমার ভঁয় পাওয়ার কোন কারণ নাই।যখনই মনে হচ্ছিল,বাবার আত্মাটা অযথাই এত কষ্ট পাচ্ছে,
আল্লাহ আমার বাবার আত্মার প্রতি যেন রহম করে।বাবার আত্মা আমার ছেলেদেরকে নিশ্চয় রক্ষা করবে,এটা ভেবে স্বস্তিতে ভঁরে গেল মনটা।যদি কোন জিন,ভূত,বা শয়তান হয়,তাহলে বাবার আত্মা নিশ্চয় আমাদেরকে রক্ষা করবে।
০০০০০০০০
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২৩ রাত ১২:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




