somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৩:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা



২৯)


‘সব ওস্তাদ শিল্পীদের বাড়ী খানাতল্লাসী করার পর,হারানো ছবিটা পাওয়া গেলেই বোঝা যাবে সিয়াহ(ব্ল্যাক) নির্দোষ’,আমি বললাম।এটাও বললাম, ‘যতটুকু জানি,শিল্পীরা যারা বছরের পর বছর আমার সাথে কাজ করছে,তাদের পক্ষে সম্ভব না এ ধরণের নির্মম,নিষ্ঠুর একটা কাজ করা’।

সুবাদার মন্তব্য করলো, ‘জেয়তিন(জলপাই),লেইলেক(বক),প্রজাপতি(কেলেবেক),সকলের বাড়ী তন্ন তন্ন করে তলাসী করা হবে,শুধু তাই না তাদের দোকানপাট,বন্ধুবান্ধবকেউ বাদ পড়বে না।বাদ পড়বে না সিয়াহ(ব্ল্যাক)...’। ‘তা ছাড়া হাকিমের কথামত পরিস্থিতি দেখে অত্যাচারের অনুমতিও নেয়া আছে।শিল্পীদের মধ্যে আরেকজন খুনের পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে গেছে’,মন্তব্য করলো প্রহরীদের সুবাদার।

কিছুটা এলেমেলো হয়ে গেছি আমি,কোথায় গড়াচ্ছে সবকিছুঃ
১)অত্যাচারের অনুমতি,সেটা সুলতানের কাছ থেকে আসেনি।
২)যেহেতু সব শিল্পীকেই সন্দেহ করা হচ্ছে,প্রধান শিল্পী হয়েও খুনী কে আমি জানি না,তাতে আমার প্রতি সন্দেহ আরও বেড়ে যাচ্ছে।
৩)ওরা অনুমতি চাচ্ছে আমার প্রিয় ছাত্র,জেইতিন(জলপাই),কেলেবেক(প্রজাপতি),লেইলেক(বক) এদের উপরে অত্যাচার করতে,একসময় নানান ভাবে মোটামুটি সবাই আমার সাথে প্রতারনা করলেও,ওরা আমার শিষ্য,শিল্পী,ওরা কেন খুন করতে যাবে।

‘সুলতানের ইচ্ছা দুটা বই এর কাজ শেষ করা-আর অত্যাচারে শিল্পীদের শারীরিক ক্ষতি হলে তারা হয়তো আর কোন কাজই করতে পারবে না’,খাজাঞ্চী মন্তব্য করলো সুবাদারের কথায়।তারপরে আমার দিকে চোখ তুলে বললো খাজাঞ্চী, ‘ঠিক কি না,আপনার কি মনে হয়’?

‘একটা ঘটনার কথা বলছি,এই তো দিন কয়েকের আগের কথা’,সুবাদার বললো। ‘সুলতানের স্বর্নকার,জহুরী যাদের কাজ ছিল অলঙ্কার,অন্যান্য জিনিষপত্র মেরামত করা,শয়তানের চক্রান্তে তাদের হাতেই হলো একটা অবিশ্বাস্য চুরি।সুলতানের ছোট বোন নাজমিয়ে সুলতানের,নানান ধরণের গহনার সাথে ছিল মনি,মুক্তা,জহরতে সাজানো একটা কফির কাপ।কোন ভাবে তারা দুজনে মিলে চুরি করলো কফির কাপটা,নাজমিয়ে সুলতানের প্রিয় একটা জিনিষ ,বেশ মনমরা হয়ে গেল নাজমিয়ে সুলতান।প্রাসাদের সুবাদার হিসাবে আমার হাতে দায়িত্ব পড়লো ;দোষীকে খুঁজে বের করা আর কাপটা উদ্ধার করা।অবশ্য সুলতান আর নাজমিয়ে সুলতানের আদেশ ছিল যেন কোনভাবেই কারিগরদের হাত,চোখের ক্ষতি না হয়, ভব্যিষতে তাদের কাজ করতে কোন অসুবিধা না হয়।সবকিছু শোনার পর,আমি অত্যাচারের নতুন পদ্ধতি বের করলাম,ঠান্ডা বরফ দেয়া পুকুরে দুজনকেই ন্যাংটা করে নামালাম,সাথে ছেড়ে দিলাম কয়েকটা ব্যাঙ।মাঝে মাঝে তাদেরকে তুলে মারধর করতে ছাড়িনি,অবশ্য চোখ,মুখ, হাত বাদ দিয়ে।সাধারণ মানুষ অত্যাচার আর কতটুকুই বা সহ্য করতে পারে,শেষমেষ তারা দোষ স্বীকার করলো,উদ্ধার হলো সোনার কাপ।এত অত্যাচারের পরও কারিগরদের কোন শারীরিক ক্ষতি হয়নি যা তাদের কাজের দক্ষতায় বাধা আনতে পারে।এমন কি স্বয়ং সুলতান আর নাজমিয়ে সুলতান আমার প্রশংসা না করে পারেনি’।

কথা শুনে মনে হলো,সুবাদারের অত্যাচারের মাত্রা শিল্পীদের জন্যে নিঃসন্দেহে গহনার কারিগরদের চেয়ে খুব একটা কম হবে না।যদিও শিল্পীদের জন্যে তার শ্রদ্ধা কোন অংশে কম ছিল না,তবে তার ধারণা ছবি আঁকা,কালিগ্রাফী,শুধু মেয়েদেরকে মানায়,পুরুষদের না।আমার দিকে চোখ দিয়ে সুবাদার মন্তব্য করলো , ‘ওস্তাদ আপনি তো মুখ বুজে কাজ করে যাচ্ছেন,কিন্ত আপনার শিল্পীরা সবাই চিন্তায় ব্যাস্ত কে পাবে প্রধান শিল্পীর জায়গাটা’।

এ গুজবটা আমার কানে যে আসে নি,তা না?সুবাদার কি আমাকে নতুন আর কি বললো?সংযত হয়ে ছিলাম,কোন উত্তর দেয়াটা ঠিক খবে না।খাজাঞ্চী অবশ্য জানতো আমার রাগের কারণ,আমাকে না জানিয়ে সুলতানের বই এর দায়িত্ব ঐ বেকুব এনিষ্টের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে,আমি যে বেশ রেগে ছিলাম সেটা তার অজানা ছিল না।,শুধু তাই না,অন্যান্য শিল্পীরাও কটা রুপার মোহরের সব কাজ ছেড়ে ঐ বই এর ছবি আঁকার জন্যে ছুটে ছুটে যাচ্ছিল,এটা শিল্প,শিল্পীর জন্য একধরণের অবমাননা।

ভাবছিলাম,কি ধরণের অত্যাচারের সম্মুখীন হবে আমার শিল্পীরা?চাবুক দিয়ে মারবে নাকি ওদের,কয়জন যে মারা যাবে,কে জানে।তবে মনে হয় না বিদ্রোহীদের মত চাকু দিয়ে কাটাকাটি করবে না,তা ছাড়া শিল্পীদের আঙ্গুল,নখ ভেঙ্গে দেয়া,এমন কি নখে পিন দিয়ে খোঁচা দেয়া এ গুলোর প্রশ্নই আসে না।অত্যাচারের আরেক পদ্ধতি মানুষের চোখ তুলে ফেলা(আজ কাল অনেক এক চোখে অন্ধ লোক দেখা যায় ইস্তাম্বুলে),ওটারও প্রশ্নই আসে না।কি হতে পারে অত্যাচারের পদ্ধতি, তার একটা ছবি ভাসছিল আমার চোখে,সুলতানের বাগানে বরফ দেয়া পুকুরে পদ্মফুলের মাঝে চোবানো শিল্পীদের চেহারা,এঁকে অন্যের দিকে তাকাচ্ছিল রাগে,হাসতে ইচ্ছা হচ্ছিল আমার।ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল,জেইতিন(জলপাই) কি ভাবে চীৎকার করবে যখন গরম শিক দিয়ে তাকে পোড়ানো হচ্ছে,কি ভাবে কেলেবেক(প্রজাপতি) ব্যাথায় নীল হয়ে গেছে পায়ের শিকলের ব্যাথায়।বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে,কেলেবেক(প্রজাপতি) এর যন্ত্রনার কথা,যার ছবি আঁকার প্রতি ভালবাসা আর দক্ষতার কথা ভেবে যে কোন বোদ্ধার চোখেই কান্না নআসবে-অথচ তাকে সাধারণ একটা চোরের মত বেত দিয়ে মারা হচ্ছে ভেবে হতবুদ্ধি হয়ে ছিলাম,আমি।

অবাক হয়ে এই বুড়ো ভাবছিল,একটা সময় ছিল যখন ছবি আঁকার জগতে শিল্পীরা ডুবে থাকতো,বাইরের পৃথিবীটা ছিল তাদের কাছে অচেনা,সব বদলে গেছে এখন,মোহর,হিংসা এমন কি খুন করতেও দ্বিধা হচ্ছে না তাদের।
‘এরা সুলতানের সবচেয়ে দক্ষ শিল্পী,কালিগ্রাফী শিল্পী,তাদের যেন কোন রকম ক্ষতি না হয়’,আমি বললাম।আমার কথায় কেন জানি কিছুটা খুশি হয়ে খাজাঞ্চী,টেবিলে ছবিগুলো সাজানো আরম্ভ করলো,দুটা মোমবাতীদানী আনলো টেবিলে যাতে ছবিগুলো ভালমত দেখা যায়।
জানি না কি বলবো,ছবিগুলো আতস কাঁচ দিয়ে দেখার সময় আমার হাসি পাচ্ছিল-তবে কারণ ছবির বিষয়বস্ত না।মনে হচ্ছিল এনিষ্টে এফেন্দীর নির্দেশ ছিলঃ ‘ভুলে যাও অন্যকিছু,আমি যে ভাবে বলছি,ঠিক সে ভাবে যেন আঁকা হয় ছবিগুলো’।অনেকটা এনিষ্টে এফেন্দীর জবরদস্তীতে শিল্পীরা এমন কিছু এঁকে গেছে, যেটা একেবারেই অবাস্তব ,সবচেয়ে মজার কথা এই যা তা জঞ্জাল একগাদা ছবির জন্যে শিল্পীরা একে অন্যকে খুন করে যাচ্ছে।

‘এই ছবিগুলো দেখে আপনার পক্ষে কি বলা সম্ভব,কোন ছবিটা কার আঁকা?প্রশ্ন করল খাজাঞ্চী।

একটু রেগেই উত্তর দিলাম, ‘কোথায় পেলেন ছবিগুলো’?

‘সিয়াহ(ব্ল্যাক) এই ছবিগুলো নিজে দিয়ে গেছে’,খাজাঞ্চী বললো, ‘হয়তো প্রমান করতে চাচ্ছে,এনিষ্টে আর সে,ওরা দুজন নির্দোষ।

‘ওকে জেরা করার সময় অত্যাচার করলে হয়তো জানা যাবে এনিষ্টে এফেন্দীর আর কি কি লুকানো রহস্য ছিল’,আমি বললাম।

‘ওকে আনার জন্যে পেয়াদা চলে গেছে’সুবাদার বললো, ‘ওদের বাড়ী খানাতল্লাসীও করা হবে’।

হঠাৎ খাজাঞ্চী আর সুবাদার দুজনের মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো,আর মাথা দুটো নত হয়ে গেল ভক্তিতে,বুঝতে পারলাম,আমরা তখন মহামান্য সুলতানের উপস্থিতিতে।


আমি এসথার

অন্য কারও দুঃখে, কাঁদতে পারা অদ্ভুত অজানা এক অনুভুতি।পুরুষেরা চলে গেছে সেকুরের বাবার জানাজায়,মেয়েরা,আত্মীয় স্বজন,বন্ধুবান্ধব,বাড়ীর অন্যান্যরা কান্নাকাটি করছিল,,বুক চাপড়ে আমিও ছিলাম সেই মানুষদের কান্নার দলে,তাদের দুঃখে দুখী।সুন্দরী সেকুরের দুঃখের স্রোতে ভেসে গেছি আমিও ,আর ভাবছিলাম নিজের জীবনের কথা।নিজের জীবনের কষ্ট,যন্ত্রনার কথা ভেবে মনে হচ্ছিল,আমি তো এভাবে সপ্তাহ দুয়েক কাঁদতে পারি।কিছুটা সময়ের জন্যে না হলে ভুলেই গেলাম,কষ্ট করে পেটের তাগিদে রাস্তায় রাস্তায় ছুটে বেড়ানোর কথা।ভুলে গেলাম না হয় কিছুটা সময় এই ভারিক্কী মোটা শরীরের কথা,ভুলে গেলাম ধার্মিক ইহুদীর মুখটা,হয়তো নবজন্ম হতে পারে এসথারের ও ভাবে।

আমি যে কোন অনুষ্ঠানে,জমায়েতে যেতে খুব পচ্ছন্দ করি,ইচ্ছামত খাওয়া দাওয়ার সুযোগ হয়,ভুলে যেতে পারি সেখানে আমি অযাচিত একটা মুখ,মনে হয় তখন আমি তো তাদেরই একজন।আমি পচ্ছন্দ করি বাকলাভা,মার্জিপানরুটি,ছুটির দিনের শুকনো ,পোলাও,
মুসলমানীর কেক;চেরীর সরবত যা সুলতানের অনুষ্ঠানগুলোতে,আর বিশেষভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে দেয়া হয়,এ ভাবে পেটপুরে খাওয়ার আনন্দ অতুলনীয়। রুটির উপরের তিল ফেলে দিয়ে,পাড়া পড়শীদের পাঠানো হালুয়া খাওয়ায় মজাটাও খুব একটা কম না

চুপচাপ জুতা পরে রান্নাঘরে যাচ্ছিলাম,আস্তাবলের পাশের ঘর থেকে আসা অদ্ভুত একটা শব্দ শুনে কৌতুহলে ছুটে গেলাম ঐ ঘরের দিকে।দেখি সেভকেত আর অর্হান পড়শীর এক ছেলেকে বেঁধে নানার মত তার মুখে রং দিচ্ছে,আর সেভকেত থাপ্পড় দিয়ে বলছে ‘তুই যদি পালাবার চেষ্টা করিস,এ ভাবে মারবো তোকে’।

‘এটা কি ঠিক হচ্ছে,শান্তশিষ্ট ছেলেদের মত খেলাধূলা কর,মারামারি করো না’?যতদূর সম্ভব গম্ভীর গলায় বললাম।
‘তোমাকে নাক গলাতে হবে না’,সেভকেত চীৎকার করে বললো।

দেখলাম পাড়ার ছেলের ছোট্ট বোন একপাশে দাঁড়িয়ে ভঁয়ে ভঁয়ে সবকিছু দেখছে আর কাঁদছে।খারাপ লাগছিল মেয়েটার জন্যে,তবে নিজেকে বললাম,ভুলে যাও এসথার,এটা তোমার মাথা ব্যাথা না।রান্নাঘর থেকে হাইরিয়ে উঁকি মারছিল।
‘হাইরিয়ে,কাঁদতে কাঁদতে গলা শুকনা হয়ে গেছে’,আমি বললাম, ‘এক গ্লাস পানি দাও’।
বেশী কিছু না বলে হাইরিয়ে পানি দিল,কাঁদতে কাঁদতে হাইরিয়ের চোখ ফুলে গেছে।
বললাম,‘শুনলাম এনিষ্টে এফেন্দী সেকুরের বিয়ের আগেই মারা গেছে,বেচারা নিজের মেয়ের বিয়েটাও দেখতে পেল না,মানুষের মুখ তো আর বস্তা না,যে সেলাই করা যাবে,নানান ধরণের গল্প গুজব আরম্ভ হচ্ছে’।
অদ্ভুত একটা চাহনি দিয়ে হাইরিয়ে নিজের পায়ের দিকে দেখছিল,একসময় মাথা তুলে বললো, ‘আল্লাহতালা আমাদেরকে যেন এ সব গুজব,চুগলী থেকে রক্ষা করে’।

হাইরিয়ের চাহনি দেখে বোঝা যাচ্ছিল,আমার সন্দেহটাই ঠিক ,হাইরিয়ে উত্তরটা ছিল জোর করেই অনিচ্ছায় বলা।
‘কি সব আজগুবি কাণ্ডকারখানা ঘটে গেল’,বন্ধুর মত বললাম হাইরিয়েকে।হাইরিয়ে জানে,এনিষ্টে চলে যাওয়াতে সেকুরের উপরে তার জোর খাটানোর শক্তিটাও চলে গেছে।
‘কি হবে আমার,এখন’?হাইরিয়ে বললো।
‘চিন্তা করো না,সেকুরে তোমাকে খুব সম্মান করে’,হাইরিয়েকে বললাম।হালুয়ার বাটির হালুয়া খেতে জিজ্ঞাসা করলাম হাইরিয়েকে,কোন বাড়ীর,কোন হালুয়াটা,এটা ওটা।
হাইরিয়ে ফিসফিস করে বলছিলঃ ‘এটা কায়েসেরির কাসেম এফেন্দীর বাড়ীর,এই দুতিনটা বাড়ী পরে,এটা শিল্পীদের সহকারীর বাসা থেকে,আর এটা তালাচাবির কারিগরের বাড়ীর,এটা ন্যাটা হামদির,এটা এদেমীর নতুন বৌ এর হাতের…’মাঝে সেকুরে এসে আমাদের কথাবার্তা থামালো।

‘খুব অবাক হলাম জানো,কালিবে,জায়রিফ এফেন্দীর বিধবা বৌ আসেও নি,কোন খবর পাঠায়নি,হালুয়াও পাঠায়নি’।
সেকুরে রান্নাঘর থেকে সিড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছিল,বুঝলাম সেকুরে কোন কিছু একটা বলতে চাচ্ছে,আমিও গেলাম সেকুরের পেছনে পেছনে।

‘জারিফ এফেন্দীর সাথে আমার বাবার তো কোন মন কষাকষি ছিল না,জারিফ এফেন্দীর জানাজার দিন,আমরা তো ওদের বাড়ীতে হালুয়া পাঠালাম।তুমি কি জান ব্যাপারটা কি’?সেকুরে বললো।

সেকুরেকে বললাম,‘দেখি,কোন কিছু জানা যায় নাকি’।
কথা না বাড়িয়ে সেকুরে আমার গালে একটা চুমু দিল।আঙ্গিনার ঠান্ডায় আমরা দুজনে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়েছিলাম,আমি আদর করে সেকুরের চুলে বিলি কাটছিলাম।
‘এসথার আমার খুব ভঁয় লাগছে,জানি না কি ভাবে কি সব ঘটে যাচ্ছে’?বললো সেকুরে।
‘শোন সেকুরে,ভয় পাওয়ার কি আছে,সাময়িক বিপদ তো সবার জীবনেই আছে,মেঘের পেছনেই থাকে সূর্যের আলো।আর ভাল দিকটা দেখছো না কেন,তোমার বিয়ে হয়ে হলো,তোমার একজন সঙ্গী আছে,ভরসা করার একজন লোক আছে,ভ্র করার মত একটা কাঁধ আছে’।
‘জানি না,হুট করে বিয়ে করলাম,কাজটা ঠিক হলো কি ন্‌বুঝতে পারছি না’,সেকুরে বললো, ‘এখনও যুদ্ধ করে যাচ্ছি,মনে মনে,এখনও সিয়াহকে কোন কাছে আসতে দেইনি।সারাটা রাত কেটে গেছে বেচারার আমার হতভাগা বাবার পাশে’।

চোখটা বড় বড় করে জিজ্ঞাসা করলো সেকুরে, ‘বুঝতে পারছো,আমি কি বলতে চাচ্ছি’?

‘হাসান যা বললো,তাতে মনে হয়,তোমার এই বিয়েটা বেআইনী’,আমি বললাম, ‘আর হ্যা এই চিঠিটা হাসানের’।
যদিও সেকুরে বললো, ‘না,না আর না’,তবুও চিরকূটটা হাতে নিয়ে পড়লো,তবে অন্যান্য দিনের মত আমাকে শোনালো না চিঠির কথাগুলো।

অবশ্য এ অবস্থায় সেটাই ঠিকঃআমরা দুজন ছিলাম না শুধু আঙ্গিনায়-আরেকপাশে দাঁড়িয় ভুরু কুচকানো কাঠের কারিগর,ভাঙ্গা জানালায় কাজ করতে করতে উঁকি দিচ্ছি ,বারে বারে।এক ফাঁকে হাইরিয়ে পড়শীর এক ছেলের জন্যে দরজা খুলে দিল,ছেলেটা চীৎকার করে বললো,‘এটা আমাদের বাড়ীর হালুয়া’।

‘অনেক সময় কেটে গেছে বাবাকে কবর দেয়ার পর’,বললো সেকুরে, ‘মনে হয় বাবার আত্মা শরীর ছেড়ে বেহেশতের দিকে চলে গেছে’।সেকুরে আমার কাছ থেকে সরে হাত তুলে দোয়া করছিল তখন।কেন জানি মনে হচ্ছিল,এই সেকুরে একেবারেই আমার অচেনা।হঠাৎ তার সাথে দূরত্বটা অনেক বেড়ে গেছে,অনেকটা ঐ আকাশের মত,যেখানে হাত তুলে সেকুরে দোয়া করছিল।দোয়া শেষ করে আমাদের সুন্দরী সেকুরে আমার দুই গালে চুমু দিল।

‘এসথার’,সেকুরে বললো,‘যতদিন বাবার খুনী ঘুরে বেড়াবে,আমি,আমার ছেলেরা কেউ শান্তি পাব না,হয়তো শান্তি পাবে না বাবার আত্মাও’।শুনে ভাল লাগলো মেয়েটা সবকিছু ভুলে যায়নি,তখনও তার মনে বাবার কথা ভাসছে,নতুন স্বামীর কথা সে কিছু বললো না।
‘শোন জারিফ এফেন্দীর বাসায় যাও।দেখ ওর বিধবার সাথে কথা বলে জানতে পার নাকি,কেন হালুয়া পাঠাইনি ওরা।আর হ্যা পারলে আমাকে সাথে সাথে এসে জানাবে’।
‘হাসানকে কিছু বলবো’?প্রশ্নটা করে কেন জানি নিজেই একটু অপ্রস্তত হয়ে গেলাম,তবে যে কারনেই হোক সেকুরের চোখের দিকে আর লজ্জায় আর তাকাতে পারছিলাম না।
নিজেক লুকানোর জন্যে হাইরিয়ে হাতের হালুয়ার বাটিটা খুলে খেতে খেতে বললাম, ‘সুজির হালুয়া সাথে পেস্তা বাদাম,বাহ সাথে আবার কমলা লেবু’।
সেকুরের মুখে হাসি দেখে মন কিছুটা হাল্কা হলো।ঝুড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলাম সেকুরেদের বাড়ী থেকে,রাস্তায় ক পা যেতেই দেখা হলো সিয়াহ (ব্ল্যাক)এফেন্দীর সাথে।কবরস্থান থেকে ফিরে আসছে তখন,চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছিল একটু খুশি খুশী ভাব হয়তো নতুন জীবন আর সেকুরের কথা ভেবে।তার সামনাসামনি দিয়ে না হেঁটে ইহুদী ডাক্তার মশে হামোনের(যে আত্মহত্যা করেছিল),বাড়ীর বাগান দিয়ে পাশ কেটে গেলাম।বাড়ীটা,বাগানটা দেখলেই কেমন মৃত্যুর একটা কালো ছায়া ছুটে আসে আমার চোখে,অনেকটা ভুলেই যাচ্ছিলাম সেকুরের দেয়া কাজটার কথা।

জারিফ(এলেগান্ট)এফেন্দীর বাসায়ও ছড়ানো ছিল মৃত্যুর গন্ধ,কিন্ত তাতে কান্নায় আমি হারিয়ে যায়নি।আমি তো এসথার,আমি সেই একজন,যে সহজেই হাজার হাজার বাড়ীতে ঘোরাফেরা করে,অনেক বিধবাদের সাথে যোগাযোগ আছে যার,যাদের মনে আছে যুদ্ধে স্বামী হারানোর দুঃখ রাগ,(সেকুরেও তো ছিল এই দলে এক সময়)।কালিবিয়ের মনে কান্না,রাগ থাকলেও তার প্রকাশ ছিল না,তাতে আমার আলাপ আলোচনা করতে একটু সুবিধাই হবে।

অন্যান্য আরও অনেক দাম্ভিক মেয়েদের মত,কালিবিয়ে সন্দেহ করে যারা তার দুঃখে সমবেদনা জানাচ্ছে,দেখা করতে আসছে,তারা আসলে দেখাতে চায় তাদের আনন্দ,হাসি,বেশী কিছু না বলে সব কথায় সম্মতি জানাচ্ছিল,সে।কালিবিয়ে অবশ্য বুঝতে পারেনি,কি জন্যে এসথারের আসা,যদিও তার দুঃখী ক্লান্ত মন হয়তো একটু বিশ্রাম নিতে চাচ্ছিল?এসথারের চীন থেকে আসা নতুন সিল্কের কাপড় দেখার কোন উৎসাহ ছিল না কালিবিয়ের,বা উৎসাহ ছিল না বার্সা থেকে আসা রুমাল দেখার।

বাক্স খুলে অযথা কিছু দেখানোর ভান না করে সোজাসুজি সেকুরে কথাটা জিজ্ঞাসা করলাম কালিবিয়েকে,‘সেকুরের মন খুব খারাপ,ও ভাবছে হয়তো কোন ভাবে তোমার মনে কোন কষ্ট দিল নাকি,আর তুমি তো সেকুরেকে জান,এত কান্না কষ্টের মধ্যেও ভাবছে তোমার কথা’।

অহংকারী কালিবিয়ে বললো,সেকুরের বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরও সে যায় নি, প্রথামত হালুয়া পাঠায়নি,বলা যায় সেটা অনেকটা ইচ্ছাকৃত। জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা এসে গেছে,বেঁচে থাকার আগ্রহ নাই আর,অন্যের সুখদুঃখ নিয়ে ভাবার সময় নাই।কালিবিয়ের কথাবার্তায় মনে হলো এসথার সেকুরেকে কথাগুলো জানালে,কালিবিয়ের খুশী হবে আরও। এসথার জানার চেষ্টা করলো কালিবিয়ের রাগের কারণ,প্রথমে অস্বীকার করলেও, কালিবিয়ে বললো যে এনিষ্টের বই আর ছবিগুলোয় সব অনিষ্টের মূল।বললো লালিবিয়ে,তার স্বামী কটা সোনার মোহরের জন্যে ছবি আঁকতে রাজী হয়নি,বরং সেটা সুলতানের নতুন একটা বই এর সহযোগীতা করা কম গর্বের বিষয় না,সেটাই ছিল বড় কারণ।তবে তার স্বামী ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে দেখলো,সেখানে এনিষ্টের ইচ্ছায় বই এর ছবিগুলো,
অবিশ্বাসী,কাফেরদের মত করে আঁকতে হচ্ছে,আর জারিফ(এলেগান্ট)এফেন্দী বিশ্বাস ক্রতে পারেনি সুলতান,এনিষ্টে এফেন্দী খ্যাতি,নিজেদের স্বার্থে নিজেদের ঈমানকে ছুড়ে ফেলছে।কালিবিয়ে,যে জারিফের(এলেগান্ট) চেয়ে অনেক বেশী বুদ্ধিমতী,বললো জারিফের সন্দেহ তো আর একদিনে হয়নি,অনেক কিছু দেখার পরেই সেটা ছিল তার ধারণা।জারিফ অবশ্য একজন ঈমানদার মানুষ কোন কিছুতেই তার বিশ্বাসে আঘাত হানতে পারে না,সে তো ইরুজুমের নুসরেত হোজার আসরে সব সময় উপস্থিত থাকতো,পাচ ওয়াক্ত নামাজের কোনটা বাদ যায়নি তার।জানতো জারিফ এফেন্দী,শিল্পীদের অনেকেই তার নামাজ,ঈমান নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে,তবে সেটা আর কিছু না হিংসা,তার প্রতিভাকে উপলক্ষ করে।

০০০০০০০০০

সর্বশেষ এডিট : ২০ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ৩:২০
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×