somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

২৫ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা

৩০)

কান্নায় ভেসে গেছে কালিবিয়ে,আমি এসথার ঠিক করলাম তার জন্যে একটা ভাল স্বামী খুঁজে দিব।
‘আমার স্বামী কিন্ত আমাকে কোনদিন কিছু বলেনি’,একটু সর্তক হয়ে বললো কালিবিয়ে, ‘তবে জানি এনিষ্টে এফেন্দীর বাড়ীতে রাত্রিতে ছবি আঁকার পর সে আর ফিরে আসে নি,কাফেরের দল তাকে ফিরে আসতে দেয় নি’।

কথাগুলো শুনে বোঝা যাচ্ছিল কালিবিয়ের অনুশোচনার সাথে এনিষ্টে,সেকুরের উপরে রাগের কারণ।কালিবিয়েকে বললাম,ভাগ্যের কি অদ্ভুত পরিহাস,এনিষ্টে এফেন্দী আর জারিফ দুজনেই খুন হলো,হয়তো খুনী একই লোক।দুজন অসহায় মেয়ে যেন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল দুই কোনা থেকে।তবে এটা ঠিক সেকুরের অবস্থা কালিবিয়ের চেয়ে অনেকটা ভাল,আর যাই হোক একজন পুরুষ সিয়াহ তার সহায়।

কালিবিয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলামঃ ‘সেকুরের কোন ভুল হয়ে থাকলে সেটা মাফ করে দিতে,বললাম, ‘সেকুরে তোমাকে বোনের মত ভালবাসে,আর সে এমন একটা মেয়ে যে বুঝতে পারে তোমার কান্না,দুঃখ।সেকুরে চায় তোমার দুঃখে,যন্ত্রনায় বন্ধুর মত পাশে থাকতে,যতটুকু সম্ভব সাহায্য করতে।আচ্ছা জারিফ এফেন্দীর(এলেগান্ট)কি এনিষ্টে এফেন্দীর বাসায় যাওয়ার আগে কি অন্য কোথাও যাওয়ার কথা ছিল?তোয়াম্র কি জানা আছে এ ধরণের কিছু একটা’?

উত্তর না দিয়ে কালিবিয়ে বললো,‘দেখ,এটা ছিল তার সাথে’,তারপর সেলাই এর বাক্স সুচ,সুতার সাথে লুকানো কাগজটা বের করে দিল।কাগজটা খুলে দেখলাম,কালি দিয়ে আঁকা কিছু একটা,যার বেশী অংশটাই মুচড়ে গেছে তখন,খুব একটা বোঝা যাচ্ছিল না।তবুও আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম,যে সেটা কি?

‘ঘোড়া,ওটা একটা ঘোড়ার ছবি’,কালিবিয়ে বললো, ‘কিন্ত জারিফ তো শুধু রং দেয়ার কাজ করতো,ও তো কোনদিন ছবি আঁকে নি,আর তাকে তো ঘোড়ার ছবি আঁকতে বলার কথা না,অবাক হওয়ার মত ব্যাপার’।
‘যদি কাগজটা সেকুরের কাছে নিয়ে যেতে পারি,হয়তো সে বুঝতে পারবে ব্যাপারটা কি,আর খুশীও হবে’,আমি বললাম।
‘সেকুরের যদি ছবিটা দেখার ইচ্ছা থাকে সে নিজেই আসতে পারে এখানে,তবে ছবিটা এখানেই থাক’,কালিবিয়ের কথার মধ্যে রাগ ছিল অনেক।




আমাকে সবাই ডাকে,সিয়াহ বলে(ব্ল্যাক)

যারা আমাকে জানে,জানে আমার মত মানুষেরা ভালবাসা,সুখ,যন্ত্রনার দোহাই দিয়ে চিরন্তন একাকীত্ব খুঁজে নেয়,কিন্ত তাদের জীবনে না আছে সুখ,না আছে দুঃখে ভরা সারাটা পথ,স্থবির একটা জীব আমরা।আমরা মনের বলাগুলো ঠিকমত না বুঝেই মানসিক যন্ত্রনায় ডুবে থাকি,তাতেই হারায় আমাদের প্রতিভা,হারায় দুঃখ,সুখ অনুভতির সাধারণ পৃথিবীটা।

সেকুরের বাবাকে কবর দিয়ে তাড়াহুড়া করে সেকুরের বাড়ীতে গেলাম,সেকুরে তার ছেলেরা কান্নাকাটি করছিল।আমি একপাশে জড়িয়ে সেকুরেকে সান্তনা দিচ্ছিলাম,দেখলাম সেকুরের ছেলেদের চোখে মুখে সন্দেহ,ঘৃনার একটা ছায়া।সেকুরের অভাবনীয় যন্ত্রনার এই সময়টার সাথে আমার এই বিজয়ের অদ্ভুত একটা যোগাযোগ আছে,যদিও সেটা ভাবতে খারাপই লাগছিল।বিয়ে হলো আমার স্বপ্নের রাজকন্যার সাথে,মুক্তিও পেলাম তার বাবার হাত থেকে সারা জীবনের তিরষ্কার থেকে,আবার বাড়ীর কর্তার দায়িত্বটাও এসে পড়লো আমার কাধে।কিন্ত আমি তো এ ভাবে চাইনি,আমার ভেতরটা তখন দুঃখ আর কান্নায় ভরা,বাবাকে তেমন একটা মনে পড়ে না,এনিষ্টে ছিল আমার বাবার চেয়েও বেশী।
জানাজার সময় ইমামের সবসময় একটা দোয়া আওড়ে যাচ্ছিল,এর ফাঁকে গুজব ছড়াচ্ছিল এনিষ্টের মৃত্যুটা যথাযথ না,মসজিদে চারপাশে অনেকেই কানাঘুষা করছিল নানান মন্তব্য দিয়ে।আমি যে কাঁদতে চাই না তা না,তবে কেন জানি কান্না ছিল না আমার চোখে,কার ভাল লাগে শুনতে, ‘পাষান মানুষ্টা,ওর মন বলে কোন কিছু নাই’।

জানি,দু একজন পাড়ার খালা এসে বলবে, ‘যে যাই বলুক না কেন,ছেলেটা ভেতরে ভেতরে কেঁদে কেঁদে শেষ হয়ে যাচ্ছে,আমাদের বোঝার ক্ষমতা নাই’,যেন অন্যান্যরা আমাকে ঠেলে অন্য জায়গায় না নিয়ে যায়।আমি কিন্ত সত্যি সত্যি দাঁড়িয়ে একপাশে কান্নার চেষ্টা করছিলাম,তবে ঐ পাশের লোকজন যারা বর্ষার কান্নায় ভেসে যাচ্ছিল,আ্মার চোখ দিয়ে কোনরকমে এক ফোঁটা জল বের হলেও খুশী হতাম।ভাবছিলাম আমিই তো বাড়ীর কর্তা,এখন তো সব কিছু একটু আয়ত্বে আনা দরকার,ঠিক সে সময় দরজায় ধাক্কার শব্দ শুনলাম।ভয়ে মনটা কেঁপে উঠলোঃওটা কি হাসান?যে ভাবেই হোক এই চক্রান্ত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে।

দেখলাম দরজায় সুলতানের পেয়াদা,বোঝাই যাচ্ছেপ্রাসাদ থেকে তলব।আঙ্গিনা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চোখে পড়লো কাদামাটিতে পড়ে একটা রুপার মোহর,একটা শুভ চিহ্ন মনের করে হাতে নিলাম।সুলতানের দরবারে যেতে কি আমার ভঁয় লাগছে?বাড়ী ভঁরা কান্না দুঃখের সাজ ছেড়ে ভালই লাগছিল বাইরে ঘোড়া,কুকুর,গাছপালা আর অন্যান্য মানুষদের মাঝখানে।
ঐ পেয়াদার সাথে কথা বলে কিইবা লাভ,ফাঁসিতে যাওয়ার আগে জল্লাদের সাথে পুকুরের হাঁস,আকাশের মেঘ নিয়ে গল্প করার মত হবে সেটা,তবে ওটার প্রশ্নই আসে না,পেয়াদার মুখে কোন কথা ছিল না,ঠোঁট দুটো যেন সেলাই করা।
হাগিয়া সোফিয়ার পাশ দিয়ে যাচ্ছি তখন,একপাশের লম্বা দেবদারু গাছগুলো যেন দৌড়ে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে আকাশের দিকে,ভাবছিলাম সেকুরেকে বিয়ে করার পর পরই এভাবে কি শেষ হয়ে যাব?প্রাসাদের জল্লাদ,পেয়াদাদের হাতে এভাবে কেন শেষ হবে আমার জীবনটা,
একটা রাতও সেকুরের সাথে কাটানোর সূযোগ হলো না,হায়রে কপাল।

হেঁটে যাচ্ছিলাম আমরা কিন্ত প্রাসাদের কয়েদীখানার দিকে না,যেখানে জল্লাদ্‌,পেয়াদারা তাদের অত্যাচারের মহরত দেখায়,বরং গেলাম কাঠমিস্ত্রীদের এলাকায়।খাবারের গোলার মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখলাম,একটা বিড়াল শরীর থেকে কাদামাটি সরানোর চেষ্টা করছিল,সে নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত-আমাদেরকে দেখার সময় কোথায় তার?

গোলার পেছন থেকে প্রাসাদের পোষাক পরা দুজন লোক বের হয়ে আসলো,অন্ধকারে যদিও বোঝা যাচ্ছিল না তাদের পদবী-তবে সেটা নিয়ে চিন্তা করার কোন সময়ণ ছিল না,ওরা তখন আমাকে একটা ছোট্ট ঘরে বন্ধী করে রাখলো।এটা তো সবাই জানে অত্যাচারের আগে লোকজনকে অন্ধকারে বন্ধী করে রাখা হয়-মানুষের মনে ভঁয় সৃষ্টি করার জন্যে।ভাবছিলাম যদি গল্প সাজাতে হয় নিজেকে বাঁচানোর জন্যে কি কি মিথ্যা বলবো,পাশের ঘরের চীৎকার,
বাদানুবাদ আমার কানে ভেসে আসছিল।

অনেকেরই বোঝা সম্ভব হবে না,আমার মনের অবস্থা,যে অত্যাচারের প্রস্ততি হচ্ছে তার জন্যে।আমি তো আল্লাহর এক প্রিয় বান্দা,আর এতদিন পরে আমার প্রিয় সেকুরেকে বুকে জড়িয়ে ধরা সেটা যদি প্রমান না করে,তবে নিঃসন্দেহে আঙ্গিনায় পড়ে থাকা রুপার মোহর তার আর একটা প্রমান।অত্যাচারের কথা ভাবতে ভাবতে সান্তনা খুঁজছিলাম রুপার মোহরে,আর হাতের তালুতে মোহরটা ঘষছিলাম বারে বারে,চুমুও খেলাম কবার,ওটাতো আল্লাহর পাঠানো।কিছুক্ষন পরে গেলাম আরেকটা ঘরে,প্রধান সুবাদার বসে ছিল,পাশে কোরেশিয়ার টাক মাথা এক জল্লাদ,বুঝলাম অত্যাচার শুরু হতে যাচ্ছে,আর আমার সমস্ত আশায় গুড়েবালি,এত বিশ্বাস সবই ভেসে যাচ্ছে অজানার স্রোতে।হতাশ মন বলছিলঃরুপার মোহরটা আল্লাহর পাঠানো না,বিয়ের পর সেকুরেকে বরণ করার জন্যে আমার ছুড়ে দেয়া রুপার মোহরের একটা,আর ঐ জল্লাদদের হাত থেকে আমার কোন উদ্ধার নাই।

কান্নায় অস্থির হয়ে গেছি তখন,হাত জোড় করে মাফ চাচ্ছিলাম আল্লাহর কাছে,কিন্ত কথা ছিল গলায়।এমন না যে আমি অত্যাচার,যন্ত্রনা,দেখিনি যুদ্ধে,হত্যায় (মোটামুটি সবই দেখা আমার),মানুষ জীবন হারাচ্ছে মুহূর্ত মুহুর্তেই,তবে এভাবে আমাকে সেটা উপলদ্ধি করতে হবে ভাবিনি কোনদিন।ওরা আমাকে এই পৃথিবী থেকে সরাবে ঠিক যে ভাবে নিয়ে গেল আমার পোষাক,সার্ট,আচকান।

একজন জল্লাদ হাঁটু গেড়ে আমার উপরে বসে ছিল,আরেকজন আমার মাথায় খাঁচা দিয়ে সামনের স্ক্রুটা কষা আরম্ভ করলো,ওটা খাঁচা না-অত্যাচার করার একটা যন্ত্র।যতদূর সম্ভব জোরে জোরে চীৎকার করছিলাম,এমন কি হাত পা ধরে মাফও চাচ্ছিলাম,কাদছিলাম জোরে জোরেসব কিছু যে আমার সহ্য সীমার বাইরে।
কিছুক্ষন পর একজন জল্লাদ জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমিই কি এনিষ্টে এফেন্দীর খুনী’?
একটা দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে উত্তর দিলাম, ‘না’।
আবার মাথার খাঁচার স্ক্রুটা কষে,একই প্রশ্ন।
‘এনিষ্টে এফেন্দীকে কে খুন করলো,জান’?
‘না’।
‘তুমি যদি না হও,কে তা হলে’?
‘আমি জানি না,সত্যিই আমি জানি না’।
‘আমি খুনী বললেই কি ভাল হবে’,ঠিক বুঝতে পারছিলাম না,তবে অসহ্য এই যন্ত্রনা,কথাটা আমার মাথায় ঘোরাঘুরি করছিল।হয়তো ব্যাথাটা সয়ে গেছে,কোন ব্যাথা অনুভব করছিলাম না আর,তবে ভয়ে সারা শরীর কাঁপছিল।

পকেটের রুপার মোহর যেন বলে দিল আমাকে, ‘আর যাই ওরা মেরে ফেলবে তোমাকে’।
কিছুক্ষন পর ওরা ছেড়ে দিল আমাকে,মাথায় ব্যাথা দেওয়ার খাঁচাটাও খুলে নিল।যে জল্লাদটা,আমার উপরে চেপে বসে ছিল,উঠে গেল,তবে কোন অনুশোচনার ছোঁয়া ছিল না,তার চোখে মুখে,কোন কথা ছিল না,কারও মুখে।ঘরের আরেক কোনায় বসে ছিল,ওস্তাদ ওসমান এফেন্দী,আমি তার হাতে নিয়মমত চুমু খেয়ে যথারীতি সম্মান দেখালাম।
‘চিন্তা করো না,তুমি’,ওস্তাদ ওসমান বললো, ‘ওরা তোমাকে শুধু পরীক্ষা করছিল’।
বুঝতে কষ্ট হলো না,এনিষ্টে এফেন্দীর জায়গায় ওস্তাদ ওসমান,এখন আমার নতুন অভিভাবক,
আল্লাহ এনিষ্টে এফেন্দীর আত্মাকে শান্তি দেয় যেন।

‘সুলতানের আদেশ তোমার উপরে অত্যাচার শেষ করার জন্যে’,প্রধান সুবাদার মন্তব্য
বললো।
‘সুলতানের আদেশ তুমি এখন ওস্তাদ ওসমানকে সাহায্য করবে খুনীকে খুঁজে বের করার জন্যে,কে খুন করে বেড়াচ্ছে শিল্পীদের এভাবে,এটা শিল্পীদের জন্যে না সুলতানের জন্যেও লজ্জার কারণ।তিনদিনের মধ্যে,সব শিল্পীদের অত্যাচার করতে হলেও,আঁকা ছবিগুলো ঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করে,যে ভাবেই খুনীকে খুঁজে বের করতে হবে তোমাদের।সুলতানের কাছে এটা অসহনীয় যে কজন লোক নানান ধরণের গুজব ছড়াছে সুলতানের ওস্তাদ শিল্পীদের নামে।
খাজাঞ্চী হাসেম আগা আর আমি,আমরা দুজনেই সাধ্যমত সাহায্য করবো তোমাকে।তোমার সাথে এনিষ্টে এফেন্দীর ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক ছিল,তোমার নিশ্চয় জানা আছে এনিষ্টে এফেন্দীর নতুন বই এর কাহিনীর কাঠামো।আর ওস্তাদ ওসমানের মোটামুটি জানা সব শিল্পীকেই।তিন দিনের মধ্যে তুমি যদি ঐ শয়তান খুনীকে খুঁজে বের করতে না পার,তা হলে তোমার উপরে অত্যাচার আরম্ভ হবে জারিফ(ব্ল্যাক)এফেন্দী,আর এক এক করে কোন ওস্তাদ শিল্পীই বাদ যাবে না’।

একটা চক্রান্ত মনে হলেও,মনে হলো না,খাজাঞ্চী আর ওস্তাদ ওসমানের মধ্যে গোপন কোন ষড়যন্ত্র আছে-যদিও ওরা দুইজনে তো বন্ধুর মত অনেকদিন ছিল সুলতানের প্রাসাদে,
তবে খাজাঞ্চীর দায়িত্ব রাজকোষের মোহরের,ওস্তাদ ওসমানের দায়িত্ব ছিল সুলতানের নতুন বই এর যথাযথ শিল্পী,কালিগ্রাফার,কাহিনীকারদের।

‘কে না জানে সুলতানের রাজত্বে অপরাধ হলে,অপরাধী খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আইনের চোখে সেই বিশেষ এলাকার সবাই অপরাধী।কোন এলাকায় খুনীকে বের না করতে পারলে,হাকিমের কাছে সবাইকে খুনী হিসাবেই পাঠানো হয়।আর সে ভাবেই শাস্তির ব্যাবস্থা হয়’,প্রধান সুবাদার বললো।
‘তা ছাড়া কোন সন্দেহ নাই যে ওস্তাদ ওসমান সব কিছুর উপরে একটা শ্যেন দৃষ্টি রাখবে,প্রতিটা ছবি বিশ্লেষণ করে চেষ্টা করবে জানতে,কে সে যে নিরীহ শিল্পীদের গলায় র্নিদ্বিধায় চাকু বসাচ্ছে।ওস্তাদ ওসমানকে যে কোন সাহায্য করার জন্যে আমরা প্রস্তত,এই মুহুর্তে পেয়াদারা সব শিল্পীদের বাড়ী থেকে যা যা ছবি আছে,সংগ্রহ করছে’।



আমি,ওস্তাদ ওসমান

প্রধান সুবাদার আর খাজাঞ্চী সুলতানের আদেশ,আমাদেরকে জানানোর পরে চলে গেল।
অবশ্য সিয়াহ(ব্ল্যাক),ভয় আর অত্যাচারে কিছুটা ক্লান্ত তখন,একটা ছোট্ট ছেলের মত তার চোখ মুখ,শান্ত শিষ্ট একটা চেহারা।

আমার হাতে তিনটা দিন আছে,এর মধ্যে ছবিগুলো দেখে আমাকে খুঁজে বের করতে হবে শিল্পীদের মধ্যে কে খুনী,দোষী কে?ছবিগুলো দেখার পর আমার মনের অবস্থা বেশ কিছুটা টলোমোলো,আর সিয়াহ(ব্ল্যাক) খাজাঞ্চী হাসেম তাজকে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার জন্যে ছবিগুলো আগে দিয়ে গেছে,তবে কেন?ছবিগুলোর মধ্যে নিশ্চয় এমন কিছু একটা আছে,যা নিরীহ কোন একজনকে,শিল্পী থেকে খুনীতে বদলে দিল।নতুন করে ছবিগুলো দেখছিলাম,একটা পাতায় শুধু একটা গাছ আর চারপাশে জারিফ(এলেগান্ট)এফেন্দীর নকশা।উপলদ্ধি করার চেষ্টা করছিলাম দৃশ্যটা,সাথে গল্পটা যেখানে ঐ গাছটা থাকবে।আমি যদি গাছ আঁকতে বলতাম,আমার প্রিয় কেলেবেক,চালাক লেইলেক,কূটবুদ্ধির জেইতিন এটা একটা গল্পের অংশ মনে করেই গাছটা আঁকতো।গাছটার ডালপালা,পাতা থাকলে না হয় বলা কি সম্ভব গল্প,কথা শিল্পীর মনের।

দুঃখী একা,একটা গাছ,পেছনের আকাশ স্বর্গের দিকে ছুটে যাচ্ছে,সিরাজের ওস্তাদ শিল্পীদের ছোঁয়া আছে সেখানে।তবে আর কিছুই ছিল না,একটা গাছ আর শূন্য আকাশ মাঝখানে,মনে হচ্ছে হয়তো শিল্পী চেষ্টা করছিল পারস্যের ওস্তাদফের সাথে ভেনিসের শিল্পীদের দক্ষতা মেশাতে,তবে শেষমেষ তেমন কিছুই হয়নি,একটা জগাখিচুড়ী।হয়তো পৃথিবীর শেষ মাথার গাছগুলো দেখতে ঐ রকম।ভেনিসের শিল্পের ছোঁয়ার সাথে,সিরাজের ওস্তাদ শিল্পকে মেশাতে গিয়ে বেকুব লোকটা এমন একটা জিনিষ তৈরী করলো যাকে কোনভাবেই শিল্প বলা যায় না।কারণটা এই না যে দুটা ভিন্ন পদ্ধতি মেশানোর চেষ্টা,বরং বলা যায় দক্ষতার অভাব,ওটাই আমার রাগের কারণ।

একই কথা মনে হচ্ছিল অন্যান্য ছবিগুলো দেখেও,ঘোড়ার ছবিটায়ে এমন কি আছে,যে মেয়েটা মাথা নত করে সম্মান দেখাচ্ছে।বিষয়গুলোও বেশ বিদঘুটে,সব কিছু দেখে আমার রাগই বাড়ছিল,দুজন দরবেশ আর শয়তান যেটাই হোক,কেন জানি বেমানান,ছবি আঁকলেই হলো না,সেখানে একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে,সব কিহুর মধ্যে একটা স্মঝোতা থাকা দরকার।বুঝলাম না,আমার ওস্তাদ শিল্পীরা কেন এসব নিম্নমানের ছবি সুলতানের বই এর জন্যে ব্যাবহার করার চেষ্টা করছিল?

আল্লাহর বিচারের কথা ভাবছিলাম যখন,আমার ঈমান মাথাটা নত করে দিল,বইটা শেষ হওয়ার আগেই আল্লাহ ঐ শিল্পীকে এ পৃথিবী থেকে নিয়ে গেছে।এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না,এই বই শেষ করার দায়িত্ব নেওয়ার কোন ইচ্ছা নাই আমার।কে বিরক্ত হবে না এ রকম একটা কুকুর দেখে ঠিক যেন আমার নাকের নীচে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে,যেন আমার ভাই বা কাছের কোন এক আত্মীয়।তবে নিঃসন্দেহে কুকুরের ছবির বাস্তব চেহারা অকল্পনীয়,অদ্ভুত দক্ষতায় আঁকা,শ্যেন দৃষ্টি ভরা চোখ,ঝকঝকে সাদা বীভৎস দাঁত,ঘাড় বেঁকে তাকানোর ভঙ্গী,মনে হয় জানা আছে আমার,শিল্পীটা কে?

ভাবতে খারাপ লাগছিল ও ধরণের এক দক্ষ শিল্পীর তুলির টানকে বদলানোর চেষ্টা করার কি দরকার?ভেনিসের পদ্ধতির অনুকরন হোক,বা আমাদের সুলতানের বই এর বাস্তবতার জন্যেই হোক,এ ভাবে ছবিগুলো আঁকার যুক্তি খুজে পাচ্ছিলাম না।একটা ছবির টকটকে লাল রংটা আমাকে বেশ অবাক করলো,চারপাশে আমার পরিচিত শিল্পীদের তুলির ছোঁয়াটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল না,তবে অজানা শিল্পীর লাল রং এর ছোঁয়াটাই ছিল ছবির সৌন্দর্য।রহস্যময় ঐ লালের ছোঁয়া,অদ্ভুত এক মায়াবী রুপ নিয়ে ছড়িয়ে ছিল ছবিটাতে।
মাথা নীচু করে ছবিটা দেখতে দেখতে সিয়াহ(ব্ল্যাক)কে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম গাছটা কার আঁকা হতে পারে,(লেইলেক-বক,জাহাজ আর বাড়ীটা(জেইতিন-জলপাই),ঘুড়ি আর ফুল(কেলেবেক-প্রজাপতি)।
‘এটা তো কোন আপনার জানার কথা-বছরের পর বছর আপনি শিল্পিদের প্রধান
হিসাবে কাজ করলেন,ওদের তুলির ছোঁয়া,পেন্সিলের টান কোনটা না আপনার জানা’,বললো সিয়াহ(ব্ল্যাক)।
‘কিন্ত এনিষ্টে এফেন্দীর মত বই পাগল লোক যখন শিল্পীদের নতুন অজানা পদ্ধতিতে ছবি আঁকতে বলে,তখন কি ভাবে বলা সম্ভব কোন ছবিটা কার আঁকা’?

একটা উদহারণ দিয়ে সিয়াহকে বোঝানোর চেষ্টা করলামঃঅনেক দিন আগের ইস্পাহানের এক বাদশাহ একাই কেল্লায় থাকতো-প্রচন্ড বই আর শিল্পের প্রেমি্ক।ক্ষমতাশালী বাদশাহের এই পৃথিবীতে ভালবাসার জিনিষ ছিল দুটো-তার মেয়ে,আর তার আদেশে তৈরী বইগুলো।এতই ভালবাসতো বাদশাহ তার মেয়েকে যে পাশের রাজ্যের কোন শাহজাদা,বাদশাহ বিয়ের প্রস্তাব দিলে,বাদশাহ সাথে সাথে আক্রমন করে সেই দেশ দখল করতো,লোকজন কানাঘুষা আরম্ভ করলো বাদশাহ হয়তো নিজেই তার মেয়ের প্রেমে মত্ত,তাই বিয়ে দিতে এত অজুহাত।

বাদশাহের যুক্তি ছিল,যারা প্রস্তাব আনছে তাদের মধ্যে কোন শাহজাদা,বাদশাহ তার মেয়ের যোগ্য পাত্র না,আর জেনেশুনে মেয়েকে পানিতে ফেলে দিতে পারে না।মেয়ে যাতে ভুল করে অযোহ্য পাত্রকে বিয়ে না করে ফেলে ভেবে,বাদশাহ মেয়েকে একটা ঘরে বন্দী করে রাখলো।
ইস্পাহানে প্রচলিত একটা বিশ্বাস ছিল,অবিবাহিত পরপুরুষ অবিবাহিতা মেয়ের দিকে নজর দিলে,নিঃসন্দেহে নষ্ট হয়ে যাবে মেয়েটার চেহারা।গুজব ছড়ালো শিরিনের প্রেম কাহিনীর বইটার ছবি সেটা আর কেউ না,বাদশাহের মেয়ে।গুজবটা শাহের কানে যাওয়ার পর শাহ বইটা খুলে দেখে কান্নায় ভেসে যাচ্ছিল,সত্যিই শিরিন আর কেউ না তার মেয়ে।যদিও বাদশাহের মেয়ে কোনদিন ঘর থেকে বের হয়নি তার ছবি শিল্পীর তুলিতে আসলো কোথা থেকে,শোনা যায় অবশ্য গুজবও বলতে পার,একাকীত্বের হতাশায় এক রাতে শাহজাদী যখন তার মহলের ঘরটার বারাব্দায় ঘোরাফেরা করছিল,তার সৌন্দর্যের ছটা সূর্যের আলোর মত ছড়িয়ে ছিল চারপাশে,রাতে কাজ করছিল যে শিল্পী,মুখটা তার চোখ এড়ায়নি।আর দক্ষ শিল্পীর তুলির আচড়ে বই এর পাতায় দেখা দিল শাহজাদীর ছবি।দৃশ্যটা ছিল যেখানে শিরিন বাগানে ঘোরার সময় হুসরেভের ছবিটা দেখে তার প্রেমে পড়ে’।

‘ওস্তাদ,এটা একটা কাকতালীয় যোগাযোগ’,সিয়াহ(ব্ল্যাক)বললো, ‘আমিও হুসরেভ আর শিরিনের ঐ প্রেমের দৃশ্যের খুবই ভক্ত’।


০০০০০০০০০০০০
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০২৩ রাত ১২:৫৯
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঢাকার মানুষের জীবন

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪


ঢাকাতে মানুষ বড় বিচিত্র ভাবে বেঁচে থাকে। নিয়মিত ঢাকার রাস্তার ঘুরে বেড়ানোর কারণে এই রকম অনেক কিছু আমার চোখে পড়ে। সেগুলো দেখে মনে হয় মানুষ কত ভাবেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ কখনো এমন করে বলতে পেরেছে কি?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫


ভারতে গরু ও গোমাংস নিয়ে হত্যা বা সহিংসতার নির্দিষ্ট সংখ্যা বলা কঠিন কারণ এটি রাজ্য, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং 'গরু রক্ষা' বাহিনী ইত্যাদীর কারণে একেক যায়গাতে একেক রকম। ভারত গোমাংস... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশ, পাকিস্তানের ধর্মীয় জংগীবাদ ভারতের মুসলমানদের সাহায্য করছে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৪০



এনসিপির জল্লাদরা, ফেইসবুক জেনারেলরা ও ৫/১০ জন ব্লগার মিলে ৭ সিষ্টার্সকে আলাদা করে দিবে বলে চীৎকার দিয়ে ভারতের মানুষজনকে অবজ্ঞা ও বিরক্ত করার ফলে ভারতের ২২ কোটী... ...বাকিটুকু পড়ুন

গৃহবধূ থেকে প্রধানমন্ত্রী; অভিভাবক শূন্য হলো বাংলাদেশ |

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:১২


খালেদা জিয়া। ইস্পাতসম বজ্রকঠিন দেশপ্রেমের নাম খালেদা জিয়া। যিনি ভালো বেসেছেন দেশকে, নিজের জীবনের চেয়েও দেশকে ভালো বেসেছেন। দেশের বাহিরে যার নেই কোন লুকানো সম্পদ। নেই বাড়ি, গাড়ি অথবা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেগম খালেদা জিয়াঃ এক দৃঢ়চেতা, সাহসী অধ্যায়ের সমাপ্তি

লিখেছেন সামহোয়্যারইন ব্লগ টিম, ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:৩৭



প্রিয় ব্লগার,
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া আর আমাদের মাঝে নেই, ইন্না লিল্লাহি ওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

×