somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ) ধারাবাহিক

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

Orhan Pamuk এর My Name is Red(অনুবাদ)
ধারাবাহিক
ফেনিত অর্হান পামুক
জন্মঃ জুন,১৯৫২
তুরস্কের খ্যাতনামা এক উপন্যাস লেখক
২০০৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান
খ্যাতনামা লেখার মধ্যে My name is red,Silent house,white castle আরও অন্যান্য অনেক লেখা
৩৩)

ওস্তাদ ওসমান আতস কাঁচ ঘোড়ার মাথার একপাশ থেকে আরেকপাশে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছবিটা দেখছিল,আমিও মাথা নীচু করে আতস কাঁচে বড় করা ছবিটা দেখছিলাম,ঘোড়ার নাকটা ছিল বেশ অদ্ভুতঃআর নাকের ছিদ্রগুলোও।
‘এখন দেখতে পাচ্ছ’?ওস্তাদ ওসমান জিজ্ঞাসা করলো।নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আমি নিজেই আতস কাঁচ নিয়ে মাটিতে বসে ছবিটা পরখ করা আরম্ভ করলাম।ওস্তাদ ওসমানের গাল ছিল আমার গালে,খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভঁরা ঠান্ডা একটা মুখ,আর একটা নিস্তব্ধতা।কেমন জানি অদ্ভুত একটা কিছু ঘটে যাচ্ছিল ছবিটাতে,আমার ক্লান্ত চোখ অবাক হয়ে সম্মানের সাথে ফিসফিস করে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি ব্যাপার,নাকটা কেমন জানি অদ্ভুত’?
‘সেটাই তো কথা,দেখছ না কি অদ্ভুত ভাবে আঁকা নাকটা’,ওস্তাদ ওসমান ছবি থেকে মাথাটা না তুলেই বললো।
‘এমনও হতে পারে ছবি আঁকার সময় শিল্পীর হাত ফসকে গেছে?হয়তো এটা ভুলে ও ভাবে আঁকা’?তখনও আমরা ছবিটা দেখছিলাম।
‘এটা কি ঐ ভেনিসের শিলীদের মত আঁকা,নাকি চীনা ওস্তাদদের ছবি আঁকার কায়দায় আঁকা,যা নিয়ে সবাই আলাপ আলোচনা করছে’,ওস্তাদ ওসমান ঠাট্টা করে বললো।
কৌতুকটা যেন এনিষ্টেকে উদ্দেশ্য করে বলা,তাই একটু উত্তেজিত হয়েই বললাম, ‘এনিষ্টে,আল্লাহ যেন তাকে বেহেশতবাসী করেন,সবসময় বলতেন ছবি আঁকায় খুতটা শিল্পীর প্রতিভার অভাবে না,বরং শিল্পীর মানসিক অনুভুতির গভীরতার অভাব থেকে আসে’।
যাকগে,শিল্পীর আঁকার ভুলে বা গভীরতার অভাবে হোক,হোক না হয় ঘোড়ার খুঁতে ঐ নাক ছাড়া আর ছাড়া কোন কিছুই খুঁজে পেলাম না আমরা।ঘোড়ার নাক,নাকের গর্ত ছাড়া ছবির আর কোন বিশেষত্ব আমাদের চোখে পড়ে নি।
বিভিন্ন বই এ ওস্তাদ ওসমানের শিল্পীদের আঁকা ঘোড়ার ছবিগুলো তদন্ত করা আরম্ভ হলো তখন,কেন না সালতানাতের অনুষ্ঠানের বই এর কাজ তখনও চলছে,সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের ছবি,সুলতানের সামনে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পায়ে হেঁটে যাওয়া শোভা যাত্রা,২৫০টা ছবির মধ্যে কয়েকটা ঘোড়ার ছবিও ছিল।সুলতানের যথাযথ অনুমতি নিয়ে হারেম,প্রাসাদের অন্যান্য জায়গায় যে সব বই ছিল সবই আনা হলো,এমন কি খাজাঞ্চীখানায় যে সব বই রাখা ছিল কোনটাই বাদ পড়েনি,আর আরম্ভ হলো তদারকী।

সুলতানের যুদ্ধ জয়ের বই এ দুই পাতার একটা ছবি যা এক শাহজাদার কাছে ছিল,সেখানে সজেভতার যুদ্ধে মৃত্যুর পর সুলতান সুলাইমায়নের জানাজার কাফেলায়,ছিল সোনায়,রুপায় কাজ করা জিন গায়ে একটা বাদামী রং এর ঘোড়া মাঝে মাঝে ঝকঝকে সাদা দাগ,গাড়ীর অন্যান্য ঘোড়াদের সাথে যাচ্ছিল।জেইতিন,লেইলেক আর কেলেবেকের হাতে আঁকা ছবির অন্যান্য ঘোড়ার সাথে ছিল গাড়ীটানা ঘোড়া,পেছনে লাল কাপড়ে ঢাকা মনিবের লাশ দেখে কান্নায় ভেসে যাচ্ছে যেন ঘোড়াগুলো,সবাই দাঁড়িয়ে ছিল হেরাতের ওস্তাদদের ছবি আঁকার কায়দায়,সামনের পা টা আগানো আর পেছনের পা টা মাটিতে থমকে থাকা।

লম্বা গলা,যেন সুর করে বাঁকানো,লেজের চুল বেঁধে রাখা,ঘাড়ের কেশর সুন্দর করে কাঁটা,
কিন্ত কোন ঘোড়ার নাক ছিল না ও রকম অদ্ভুত ভাবে আঁকা।এমন কি সেনাপতি,উজির নাজির যারা সবাই সামিল ছিল সুলতান সুলাইমানের জানাজার কাফেলায় পাহাড়ের ওপরের রাস্তাটায়,কারও ঘোড়াই ছিল না ও রকম নাক নিয়ে।ঐ জানাজার কাফেলার দুঃখে আমরা কান্নায় ভেসে গেছি তখন,দেখে খারাপই লাগলো ওস্তাদ ওসমান আর অন্যান্য ওস্তাদদের হাতে ওতো কষ্ট করে আঁকা ছবিগুলোর অবস্থা দেখে,হারেমের মেয়েদের হাতে শাহজাদাদের হিজিবিজি খেলায় বইগুলোর দুরবস্থা দেখে।একটা গাছ যার নীচে আমাদের সুলতানের দাদা শিকার করতো,সেখানে একটা কাঁচা হাতের লেখা,‘আমার ভালবাসার এফেন্দী,আমি তোমাকে এত ভালবাসি সেটা কি ভাবে বলবো জানি না,আমি অনেক আশায় অপেক্ষা করে আছি এই গাছের নীচে’।অনেক হতাশা,দুঃখ নিয়ে দেখছিলাম বইগুলো,যার কথা কম শুনিনি।

বই এর দ্বিতীয় অংশ,‘প্রতিভার প্রকাশ’,সেখানেও ছিল তিন ওস্তাদের তুলির ছোঁয়াচ, কামানের ধোঁয়া,পায়ে হেঁটে যাচ্ছিল সৈন্য,বাদামী,নীল,ছাই রং এর শত শত ঘোড়া,
শব্দ করে হেঁটে যাচ্ছে একসাথে,পাহাড়ের এক দিকে,কিন্ত কারও নাকটা ছিল না কাগজের ঘোড়ার মত।‘কিন্ত ঘোড়ার দোষটা ঠিক কোথায়,বোঝা যাচ্ছে না’,ওস্তাদ ওসমান এক সময় বই এর পাতা দেখতে দেখতে বললো,প্রাসাদের গেট আর সৈন্যদের জমায়েতের ছবিটা দেখে (আমরা সেখানেই বসে আছি এখন)।কিন্ত ওখানেও সৈন্যদের,উজির নাজিরদের ঘোড়ায় কোথাও খুঁজে পেলাম না,ঐ অদ্ভুত ধরণের নাক।দেখলাম সুলতানের দাদা ‘হিংস্র’,সুলতান সেলিম ধুলকাধিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে নদীর ধারে তাবু থেকে,শিকারের কুকুর নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ভঁয় পাওয়া খরগোস আর হরিনদের পেছনে,এক পাশে পড়ে আছে একটা চিতা বাঘ রক্তের স্রোতে।কিন্ত সুলতানের বাদামী ঘোড়া,বা বাজপাখী হাতে শিকারীদের ঘোড়া কোনটারই নাক ছিল না অদ্ভুতভাবে আঁকা।

সন্ধ্যার অন্ধকার আসার আগেই আমরা কয়েক শ ঘোড়ার ছবি দেখলাম,জেইতিন,লেইলেক আর কেলেবেকের তুলির ছোঁয়ায় আঁকা,ক্রিমিয়ান কাহাম,মেহমুত,জিরাই লম্বা কানের কালো সোনালী ঘোড়া যাদের মাথা,ঘাড় দেখা যেত পাহাড়ী যুদ্ধে,হায়দার পাশার ঘোড়া তিউনিসিয়ার কাফেরদের কাছ যুদ্ধ জয়ের ফস্ল,হালকুল-ভাদের কেল্লা,স্পেনিশদের লাল-বাদামী ঘোড়াগুলো,পালানোর সময় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা কালো ঘোড়াটা,যাকে দেখে ওস্তাদ ওসমান মন্তব্য করলো, ‘এটা তো আগে খেয়াল করিনি,কার হাতে এত করুন ভাবে আঁকা ঘোড়াটা’?একটা লাল ঘোড়া যেন কান খাড়া করে ভেসে আসা বাশীর সুর শুনছিল,শিরিনের ঘোড়া সেভজিদ দেখতে শিরিনের মতই সুন্দর,অপেক্ষা করে আছে চাঁদের আলোতে লেক থেকে শিরিনের গোসল শেষ করে উঠে আসার উঠে আসার জন্যে।

ঝড়ের গতির ঘোড়া যা বল্লম ছোড়ার জন্যে ব্যাবহার হতো,ছবিটা দেখে ওস্তাদ ওসমান মন্তব্য করলো,‘ছোটবেলায় তাকে প্রচন্ড ভালবাসতাম,বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি এখন দেখে দেখে’, পয়গম্বর ইলিয়াসকে মুর্তিপূজার অবিশ্বাসীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে আল্লাহতালার পাঠানো সোনালী রং এর ডানাওয়ালা ঘোড়াটা,-ভুল করে ডানাটা আঁকা পয়গম্বর ইলিয়াসের গায়ে;সুলতান সুলাইমানের অপূর্ব সুন্দর ছাই রং এর ঘোড়াটা,ছোট্ট মাথা আর বিশাল দেহ দুঃখের চোখে তাকিয়ে আছে শাহজাদার দিকে,বিরক্ত একটা ঘোড়া,ছুটে যাওয়া ঘোড়া,ক্লান্ত ঘোড়া,ঘোড়া যাদের দিকে কেউ দেখছে না,ঘোড়া যারা এই পাতা ছেড়ে কোথাও যাবে না,ঘোড়া যারা এই বই এর পাতা ছেড়ে ছুটে যাবে।

কিন্ত একটা ঘোড়াও ছিল না দেখতে সেই বিশেষ ঘোড়ার মত,সেই নাকটা যা আমরা খুঁজছিলাম।তবুও আমাদের ক্লান্ত চোখে,মনে ছিল অদ্ভুত একটা উত্তেজনাঃবেশ কবার আমরা ঘোড়ার কথা ভুলে গিয়ে বই এর ছবিগুলো অবাক হয়ে দেখছিলাম।ওস্তাদ ওসমান বেশীর ভাগ সময়ই ছবিগুলো নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে ছিল,কেননা বেশীর ভাগই তার আঁকা,না হয় তার নির্দেশে আঁকা,না হয় অলঙ্কারের কাজটা তার হাতের।
‘এটা পাশা এলাহার কাশফুল’,ওস্তাদ ওসমান আমাদের সুলতানের দাদা,সুলতান সুলাইমানের লাল তাবুর কাছের ফুলগুলোর দিকে আগুল দিয়ে বললো।‘যার হাতে আঁকা এই ছবি তাকে কোনভাবেই কৃতী শিল্পী বলা যায় না,বই এর পাতার ফাঁকা জায়গাগুলো ভরাট করা ছাড়া আর এমন কিছুই করেনি সে,হঠাৎ লোকটা মারা গেল বছর দুই আগে।আমি সবসময় তাকে এ ধরণের ফুল আঁকার কাজটা দিতাম,কেননা ওর চেয়ে ভাল এ ধরণের ছবি আর কেউ আঁকতে পারতো না’।কিছুক্ষন চুপ করে ওস্তাদ ওসমান আবার বলা আরম্ভ করলো,
‘এটা সত্যি খুবই দুঃখের একটা ঘটনা,দুঃখের কথা’,ঐ কথাগুলোর মধ্যে,ঐ দীর্ঘশ্বাসে লুকানো ছিল ইতিহাসের এক অধ্যায় শেষ হয়ে যাওয়ার দুঃখ।
বাইরের অন্ধকারের আঁচল একসময় গ্রাস করে নিল আমাদেরকেও,দেখি অস্বাভাবিক আলোর জোয়ারে হঠাৎ ভেসে গেল ঘরটা।বাইরের হৈচৈ এর শব্দ আসছিল,আমার হ্রদয় তখন ঘোড়ার মত ছোটাছুটি করছেঃএই পৃথিবীর শাসনকর্তা আমাদের মহামান্য ঘরে ঢুকলো।সাথে সাথে ছুটে গিয়ে আমি কদমবুছি করে তার হাতে চুমু খেলাম।আমার মাথা ঘুরছিল চরকীর মত,তার চোখের দিকে তাকানোর মত সাহস ছিল না আমার।

যাকগে এর মধ্যে মহামান্য সুলতানের সাথে ওস্তাদ ওসমানের আলাপ আলোচনা আরম্ভ হয়ে গেছে।গর্বে আমার মাথাটা উঁচু হয়ে ছিল-একটু আগে যার সাথে আমি হাঁটুতে হাঁটু আলাপ আলোচনা করছিলাম,তার সাথেই আমাদের মহামান্য সুলতান এখন আলোচনায় ব্যাস্ত।আমি ঠিক যেখানে বসে ছিলাম,সেখানে বসেই আমাদের মহামান্য সুলতান ওস্তাদ ওসমানের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল।পাশে বসে খাজাঞ্চী,আর শিকারী বাজপাখীর ওস্তাদ,আরও কয়েকজন ছিল যাদের পরিচয় আমার জানা নাই।আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম সবাই বই এর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কি আলাপ আলোচনা করছিল।আমি আমার সমস্ত শক্তি জড় করে এক পাশে দাঁড়ানো আমাদের মহামান্য সুলতানের মুখ দেখে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছিলাম,
সত্যিই অপূর্ব সুন্দর চেহারার একজন মানুষ!মানানসই,শক্তিশালী একটা মুখ,অন্যন্য এক চেহারা!আমার হ্রদয়ের ভয়ের ছোঁয়াটা চলে গেছে তখন,সেই মূহূর্তে হঠাৎ চোখাচোখি হলো সেই শক্তিশালো চোখদুটোর সাথে, ‘আমাদের সুলতান’।

‘আমি অনেক শ্রদ্ধা করতাম তোমার এনিষ্টেকে,কত ভালবাসতাম ঐ লোকটাকে সেটা ভাষায় বর্ননা করা সম্ভব না’,হ্যা আমার সাথেই সেই সময় কথা হচ্ছিল মহামান্য সুলতানের,
উত্তেজনায় অনেক কথাই আমার কানে পৌঁছায়নি।
‘…আমার মনের কষ্টটা,হয়তো তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারবো না।তবে প্রতিটা ছবি দেখে অভিভুত হওয়া ছাড়া আর উপায় নাই,মনটা আনন্দে ভঁরে গেছে।ভেনিসের রাষ্ট্রদূত দেখে শুধু অবাকই হবে না,আমাকে ভঁয়ও করবে।এখন তোমাদের খুঁজে বের করতে হবে কার হাতে আঁকা এই ঘোড়ার ছবি আর নাক।তা না হলে জান কি হবে,যত ওস্তাদ শিল্পী আছে,
সবাই পড়বে চরম যন্ত্রনার খপ্পরে’।
‘মহামান্য সুলতান,পৃথিবীর শাসনকর্তা’,ওস্তাদ ওসমান বললো,‘হয়তো ঐ ওস্তাদ শিল্পীর তুলির এই পোঁচটার ভুলের জন্যেই তাকে খুঁজে বের করতে পারবো।যদি সব ওস্তাদ শিল্পীদের একটা সাদা কাগজে কোন গল্প ছাড়াই আঁকতে দেয়া হয়’?
‘অবশ্যই,এটা যদি সত্যি সত্যিই তুলির ছোঁয়ার ভুল হয়,আর যদি সত্যিকারের নাকের ছবি না হয়’,আমাদের সুলতানের মন্তব্যটা ছিল বিজ্ঞের মতই।

‘মহামান্য সুলতান’,ওস্তাদ ওসমান বললো, ‘আজকে যদি আপনার আদেশে একটা প্রতিযোগীতা ঘোষনা করা হয়,আর প্রতিটা ওস্তাদ শিল্পীর কাছে একজন পেয়াদা পাঠানোর পর সবাইকে একটা সাদা কাগজে ঘোড়ার ছবি আঁকার দায়িত্ব দেয়া হয়…’।
সুলতান সুবাদারকে বললো, ‘শুনলে তো,সব কিছু’?
তারপর সুলতান ওস্তাদ ওসমানকে আবার বললো, ‘জান নিজামীর কোন প্রতিদন্দীতার গল্পটা আমার সবচেয়ে বেশী পচ্ছন্দ’?
দাঁড়ানো লোকজনের মধ্যে কেউ বললো, ‘জানি’,আবার কেউ বললো, ‘কোনটা’?
আমি সহ কয়েকজন অবশ্য একেবারেই চুপচাপ ছিলাম।
‘আমি অবশ্য কবি লড়াই এর খুব একটা ভক্ত না,বা চীনা,পশ্চিমা শিল্পীদের প্রতিযোগীতার গল্পেরও খুব একটা ভক্ত না’,মন্তব্য করলো আমাদের সুপুরুষ সুলতান।‘আমি পচ্ছন্দ করি ডাক্তারদের প্রতিযোগীতা যাদের যুদ্ধ মৃত্যুর সাথে’।
এটা বলার পরে হঠাৎ মহামান্য সুলতান উঠে চলে গেল,মাগরেবের নামাজের জন্য।
অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে গেছে তখন,আমি প্রাসাদের গেট ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছি,ঈসার আজানের সুর চারপাশে,আমার চোখে ভাসছে সেকুরে,তার ছেলেদের কথা,আর ভেসে উঠলো ডাক্তারদের প্রতিযোগীতার কথাঃ
প্রতিযোগীতার দুইজন ডাক্তার আমাদের সুলতানের সামনে,একজনের হাতে গোলাপী একটা বড়ি যার ক্ষমতা একটা হাতীকেও কাবু করে দিতে পারে,সেটা সে দিল আরেকজন নীল পোশাকের ডাক্তারকে।ডাক্তার বড়িটা খেয়ে সাথে আর একটা নীল বড়ি খেল প্রতিশেধক হিসাবে,যা তার নিজের তৈরী।তার মুখে হাসির কটুক্তি যাতে বোঝা যাচ্ছিল,ঐ বিষের বড়িতে তার কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি।তখন নীল পোষাক পরা ডাক্তার,প্রতিদন্দীর হাতে দিল তার বানানো বিষের বড়ি।
সেই ডাক্তারও বিষের বড়িটা খেয়ে ছুটে গোলাপী গোলাপের কটা পাপড়ি মুখে দিয়ে
চিবানো আরম্ভ করলো,সাথে সাথে অদ্ভুত একটা কবিতা পড়ছিল গোলাপ ফুলটার কাছে।
কিছুক্ষন পরে সে একটা গোলাপ তুলে দিল আরেকজন ডাক্তারের হাতে,সেই ডাক্তার ঐ কবিতা শোনার পর,ফুলের গন্ধটা নাকে দেওয়ার সাথে সাথে ভঁয়েই মারা গেল।


সবাই আমাকে ডাকে জেইতিন(জলপাই) বলে

মাগরেবের নামাজের আগে,দরজায় কেউ একজন ধাক্কা দিচ্ছিল,খুলে দেখি সুলতানের প্রাসাদের সুবাদার,ঝকঝকে দাড়ি মোচ কামানো চমৎকার দেখতে সুন্দর একজন জোয়ান।হাতে একটা সাদা কাগজ,আর লেখার জন্যে ছোট্ট একটা তক্তা ছাড়াও ছিল,তেলের বাতি যা আলো দেয়ার থেকে তার মুখে বরং কিছুটা ছায়াই আনছিল।সে তাড়াতাড়ি তার আসার কারণটা বললোঃ ‘সুলতানের আদেশে সব ওস্তাদ শিল্পীদের মধ্যে একটা প্রতিযোগীতা হবে,কোন শিল্পী সবচেয়ে কম সময়ে ঘোড়ার ছবি আঁকতে পারবে।আমি মেঝেতে লেখার তক্তাটার উপরে কাগজ নিয়ে বসবো,আর ঐ সাদা কাগজে যে লাইনগুলো আছে আপনি ওখানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা ঘোড়ার ছবি আঁকবেন’।

আমি সুবাদারকে ঘরে ঢুকতে বললাম,তারপর কালি আর বিড়ালের কানের চুল দিয়ে তৈরী আমার সবচেয়ে সুন্দর ব্রাশটা নিয়ে মেঝেতে বসে কিছুটা বিব্রত হয়ে গেলাম!এটা সুলতানের কি ধরণের খেলা বা পরিকল্পনা,যার কারণে হয়তো আমার মাথাটাই যাবে নাকি কে জানে?
হয়তো বা,হয়তো বা না!হেরাতের ওস্তাদদের সবচেয়ে ভাল ছবিগুলোই তো মৃত্যু আর জীবনের সৌন্দর্যের মাঝে দাঁড়িয়ে আঁকা।আমি ছবিটা আঁকার জন্যে উদগ্রীব হয়ে ছিলাম,তবে পুরোনো ওস্তাদদের মত ছবি আঁকতে গিয়ে কেন জানি থমকে গেলাম।সাদা কাগজটায় যেন আমার মনের ভয়টা ঝেড়ে ফেলে ভাবছিলাম,একটা ঘোড়ার কথাঃআমার সমস্ত শক্তি আর সাহস জোগাড় করে,যা হবে অনন্য।

এই জীবনে আঁকা যতগুলো ঘোড়া ছিল,সবাই যেন জীবন্ত হয়ে আমার সামনে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে।আমি এমন একটা ঘোড়ার ছবি আঁকতে যাচ্ছি,যেটা আজ পর্যন্ত কারও চোখে পড়েনি।আমি আমার স্মৃতিতে খুঁজছিলাম শুধুই একটা ঘোড়া,সারা পৃথিবী সরে গেছে আমার কাছ থেকে,সব কিছু ভুলে গেছি,ভুলে গেছি আমি,শুধু একটা ছবি খুঁজছি আমার ঐ সাদা কাগজের ক্যানভাসের।
ব্রাশটা ঠিক যতটুকু কালি দরকার ততটুকু নিয়ে উঠে আসলো।‘হাত,তুমি এখন তোমার কাজ করে যাও,মনের ঐ ঘোড়াটাকে টেনে আনো ছবির পাতায়’,ঘোড়া আর আমি যেন এক হয়ে ছুটে যাচ্ছি ছবিতে।মনের সব অনুভুতি সাজিয়ে সাদা কাগজটায় ঘোড়াটাকে সাজাচ্ছিলাম,
ঘোড়াটা তো আমার সামনেই দাঁড়ানো।

চিন্তা করার আগেই,আমার হাতটা আপন মনেই ঘোড়ার খুর থেকে শুরু করে,পেছনের পা সুর করে সাজালো,হাত ছন্দ করে ছুটে গেল কোমরে,ঘাড়ের কেশর পর্যন্ত।ছবি দেখে আমি নিজেই অভিভুত, এ কার তুলিতে আঁকা ছবি!তারপর একজন যুদ্ধ বিজয়ী সম্রাটের মত শেষ করলাম,ঘোড়ার বুক,যা কবিতার মত ছন্দে ছন্দে চলে গেছে কাঁধে।ঘাড়,কাঁধ সবই যে আমার মনের ঘোড়াটার।।ব্রাশটা না তুলে আমি এঁকে গেলাম,গাল,তার বলিষ্ঠ মুখ,কিছুটা সময় ভেবে নিয়ে,ঘোড়ার মুখটা খোলা রাখলাম: ‘এ ভাবেই হবে তোমার মুখটা,খুলে দাও তোমার মুখ ঘোড়া’,আস্তে করে তুলির টানে আঁকলাম জিভ।নাকটার দিকে তাকালাম,সেখানে দোনোমোনো হওয়ার কোন কারণ ছিল না।তারপর একপাশে সরে গিয়ে নিজের আঁকা ছবিটা দেখছিলাম,আমার মনের ছবিটাই আঁকা ঐ সাদা পাতায়।ভুলে গেছি কি আঁকছিলাম আমি,
সুন্দর বাঁকা ঘাড় আর গলার অংশটা যেন অজান্তেই আলাদা ভাবেই টেনে দিলাম।সম্পুর্ন ডুবে ছিলাম ছবিটায়,আমি নিজেই যেন ছবিতে ঘোড়াটার একপাশে দাঁড়ানো।হয়তো এটা একটা যুদ্ধের ঘোড়া,হয়তো একটা রেসের ঘোড়া,লেজ একটু পেঁচানো,সেটা আবার একটু কায়দা করে উপরের দিকে তুলে দিলাম।বেশ আনন্দের সাথে ঘোড়াটার নিতম্ব,পাছার ছবিটা এঁকে যাচ্ছিলাম,নিজেই অবাক হয়ে ছিলাম,আঁকা ঘোড়াটার ছবি দেখে।

কাগজ থেকে হাতটা যখন তুলে নিলাম,উত্তেজনা,দুঃখে ভরা ছিল আমার চোখ,তবে কোন দ্বিধা ছিল না আমার,ওর নাক আর জিনটা আঁকার সময়।ঘোড়ার কেশরের প্রতিটা চুল এক এক করে আঁকলাম।ঘোড়াটার লিঙ্গ,কোন কিছুই বাদ পড়েনি।

সুন্দর একটা ঘোড়াটা আঁকার সময়,আমি নিজেই তখন একটা সুন্দর ঘোড়া।


আমাকে সবাই বলে কেলেবেক(প্রজাপতি)

মনে হয় ওটা মাগরেবের নামাজের সময় ছিল,দরজায় কেউ একজন ধাক্কা দিচ্ছিল।দাঁড়ানো পাহারাদার বললো,সুলতানের ছবি প্রতিযোগীতার কথা।মহামান্য সুলতানের আদেশ,তবে
এটা তো জানাই আমার চেয়ে ভাল ঘোড়ার ছবি আর কেই বা আঁকতে পারবে?

ছবিটা রং না কালি দিয়ে আঁকতে হবে শুনে একটু থতমত খেলাম,ঠিক বুঝলাম না,রং দ্দিলে কি অসুবিধা হতো?হয়তো এমনও হতে পারে,রং দেয়ায় আমার চেয়ে ভাল তো আর কেউ নাই,কারণটা কি আমি যাতে আমি কোন ভাবেই না জিতি?কে জানে বিচার করবে,কোন ছবিটা সবচেয়ে ভাল?প্রাসাদের সুন্দর চেহারার পেয়াদার কাছে শুনলাম,ওস্তাদ ওসমান এই প্রতিযোগীতার উদ্যোক্তা।ওস্তাদ ওসমান তো ভাল ভাবেই জানে আমার প্রতিভার কথা,আর ওস্তাদ আমাকে যথেষ্ট ভালবাসে অন্যান্য যে কোন ওস্তাদের তুলনায়,এটা তো আমার জন্যেই সুবিধা।

সাদা কাগজটার দিকে তাকিয়ে একটা ঘোড়ার কথা ভাবছিলাম,যা দেখে শুধু ওস্তাদ ওসমান না আমাদের মহামান্য সুলতানও অবাক হয়ে যাবে।ঘোড়াটার চেহারায় জীবন্ত ভাব থাকতেই হবে,বিশেষত্বও থাকতে হবে,অনেকটা বছর দশ আগের ওস্তাদ ওসমানের তুলির ছোঁয়ার বাড়ীর ছবি।যদি আমি জিততে পারি,কতগুলো সোনার মোহর পাওয়া যাবে,জানি না?মীর মুসনাভী ছবিটা আঁকবে কি ভাবে?বিহজাদ যদি আঁকতো তবে সেটাই বা কেমন হতো?

০০০০০০০০

(
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৩ রাত ১১:২৯
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এশিয়ান র‍্যাংকিং এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান !!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:২০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' ২০২৪ সালে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। এশিয়ার সেরা ৩০০ তালিকায় নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়।তালিকায় ভারতের ৪০, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×