আমরা সব কিছুকে একসাথে পেতে পারি না। একটা জিনিস পেতে গেলে আরেকটা জিনিস পাওয়ার সুযোগ হারাতে হয়। তাই প্রশ্ন ওঠে কোন জিনিসটা অধিক প্রয়োজন সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার। এক সময় পাট ছিল আমাদের দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। কৃষক খুব বেশি করে পাট চাষ করতে চাইত পাট বেচে লাভবান হওয়ার আশায়। আমাদের জমির পরিমাণ সীমিত। ইচ্ছা করলেই আমরা তার আয়তন বাড়াতে পারি না। যে জমিতে ধান হয় সে জমিতে পাটও বোনা চলে। এত জমি আমাদের নেই যাতে সমানভাবে ধান ও পাট উৎপাদন করা যেতে পারে। এ কারণে পাটের উৎপাদন বাড়াতে গেলে ধানের জমিতে পড়ত টান, আর ধানের উৎপাদন যেত কমে। ফলে দেশে দেখা দিত খাদ্যাভাব। ইংরেজ আমলে তাই এক পর্যায়ে পাটের আবাদভূমি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন দেখা দেয়। বর্তমানে পাট আর কোনো অর্থকরী ফসল নয়। কৃষক এমনিতেই তার আর আবাদ করতে চাচ্ছে না। কিন্তু এখন ফল চাষ যথেষ্ট লাভজনক হয়ে উঠেছে। মানুষ এখন ধানক্ষেত না করে সেই একই জমিতে করছে আমবাগান অথবা বাউকুলের চাষ। ফলে আগের দিনের ধান বনাম পাটের সমস্যা এখন দেখা দিচ্ছে ধানচাষ বনাম ফলচাষের সমস্যা হিসেবে। সমস্যাটা এতই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, এখনই এ বিষয়ে লক্ষ না দিলে আমাদের খাদ্যঘাটতির পরিমাণ না বেড়ে যাবে না।
আম বছরে একবার ফলে। আম খেয়ে মানুষের পেট ভরে না। ফল হিসেবে আমের পুষ্টিমূল্যও বেশি নয়। বাউকুল সম্পর্কে এ কথা আরও বেশি করে বলা যায়। আমরা আমাদের দেশে যেসব ফল চাষ করে থাকি তার মধ্যে কলা এবং নারকেলের পুষ্টিমূল্য সবচেয়ে বেশি। অনেক দেশ আছে যেখানে কলা হয়ে উঠেছে প্রধান খাদ্যফসল। আমরা কলা-নারকেলের আবাদের কথা ভাবছি না। কেবল করতে চাচ্ছি আপাতঃলাভের আশায় আম ও কুলের মতো ফলের চাষ। আমগাছ একবার হলে বহু দিন তা থেকে ফল পাওয়া যায়। এক বিঘা আমবাগান থেকে বছরে ফেলে-ছেড়ে পাওয়া যায় ৫০-৬০ হাজার টাকা। সে তুলনায় ধান চাষ মোটেও লাভজনক নয়। এক বিঘায় ধান চাষ করলে বছরে গড়পড়তায় পাওয়া যাচ্ছে ১৫-১৬ হাজার টাকা। আবাদের খরচ বাদ দিলে লাভের অঙ্ক খুব বেশি থাকছে না। লাভের হিসাবে আমের চাষ তাই বাড়ছে। বাউকুল লাগালে এক বিঘায় যা হচ্ছে তা নাকি বিক্রি হচ্ছে লাখ টাকায়। আবাদের খরচ বাদ দিলে লাভ হচ্ছে প্রচুর। কেবল লাভের হিসাব দেখলে ধান চাষ হয়ে পড়ছে মূল্যহীন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভাত না খেয়ে কি এ দেশের মানুষের পেট ভরবে? বিষয়টি আরেক দিক থেকেও ভেবে দেখার মতো। ধান চাষ করতে লোক লাগে অনেক। ধান চাষ করতে এ কারণে হতে পারে বহু লোকের কর্মসংস্থান। যেহেতু ধান এখন সারা বছরই হচ্ছে তাই ধান চাষের সাথে জড়িত ক্ষেতমজুররা সারা বছরই পাচ্ছে কাজ। কিন্তু ফল চাষ বাড়তে থাকলে এই কর্মসংস্থান সম্ভবপর নয়। ফলে গ্রামীণ দারিদ্র্য আরো প্রকট হতেই বাধ্য। টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় ফলচাষের কথা ফলাও করে বলা হচ্ছে, তুলে ধরা হচ্ছে লাভের দিকটি। কিন্তু বিচার করে দেখা হচ্ছে না কৃষি অর্থনীতিতে এর কী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। ফল চাষ করে কিছু মানুষ খুব অল্প সময়ে বিত্তবান হতে পারেন কিন্তু এর ফলে নিঃস্ব ক্ষেতমজুররা আরো বুভুক্ষার মধ্যেই পড়তে যাচ্ছে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে গুটিকয় লোকের লাভকেই আমরা বড় করে দেখব, না চেষ্টা করব দেশের অগণিত দরিদ্র আমজনতাকে বাঁচাতে।
অনেকে বলবেন, ফলচাষে লাভ হলে সেই টাকা দিয়ে আমরা বিদেশ থেকে খাদ্য কিনতে পারব। আর তা দিয়ে পূরণ করতে পারব আমাদের খাদ্যঘাটতি। কিন্তু বাস্তবে সেটা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ বাড়তি চাল পৃথিবীতে খুব কম দেশই এখন উৎপাদন করছে। আর যেহেতু চালের উৎপাদন কমছে তাই বাড়ছে তার বাজারমূল্য। এই মূল্য আমরা দিতে পারব বলে মনে হচ্ছে না বাস্তব কারণেই। এবার ভারত থেকে চাল কিনতে গিয়ে আমরা যে অসুবিধায় পড়েছি সে অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের এ বিষয়ে এখনই সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন কমবে। এর একটা কারণ, আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের দাম যত বাড়বে ততই প্রয়োজন দেখা দেবে বিকল্প জ্বালানির। পেট্রলের সাথে অ্যালকোহল মিশিয়ে গাড়ি চালানো যায়। ফিলিপাইনে অ্যালকোহল সস্তা বলে তার সাহায্যে মোটর গাড়ি চালানো হচ্ছে অনেক দিন ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে একই ভাবে তার ইন্ধন-স্বল্পতা কমাতে। অ্যালকোহল তৈরি করা হয় গোল আলু, ভুট্টা, গম ইত্যাদি গাঁজিয়ে। যদি পেট্রোলিয়ামের অভাব পূরণের জন্য এসব খাদ্যফসলকে কাজে লাগানো শুরু হয় তবে মানুষের খাদ্য সরবরাহে যে টান পড়বে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আখের রস থেকেও যথেষ্ট অ্যালকোহল প্রস্তুত করা হয়। আমাদের দেশে অনেকে হয়তো চাইবেন আখের চাষ বাড়িয়ে অ্যালকোহল উৎপাদন করে লাভবান হতে। সেটাও নিশ্চয়ই সৃষ্টি করবে আমাদের চালের অভাব। অর্থাৎ কেবল লাভের কথা ভাবলেই আমাদের চলবে না। ভাবতে হবে বৃহত্তর সমাজের খাদ্যসঙ্কট নিয়েও। কিন্তু সেটা আমরা করতে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে না। কেবলই আমাদের প্রচারমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে সেইসব কৃষিপণ্যের উৎপাদনের কথা যাতে আপাতঃলাভের পরিমাণ খুবই বেশি। ভাবা হচ্ছে না আমাদের খাদ্য পরিস্থিতির পরিণাম নিয়ে।
অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি (Growth) আর অগ্রগতি (Progress) শব্দগুলো সমার্থক নয়। প্রবৃদ্ধির সাথে জড়িত নয় কোনো মূল্যবোধ (Value)। কিন্তু অগ্রগতির সাথে আছে আমাদের মূল্যচেতনার সংযুক্তি। অগ্রগতি বলতে বুঝতে হবে মানুষের খাদ্যনিশ্চয়তা বাড়া। যে অর্থনীতিতে অধিক সংখ্যক মানুষ পেট ভরে খেতে পায় সেই অর্থনীতিকে চিহ্নিত করতে হবে অধিকতর উন্নত বলে। অর্থনীতির উন্নতি-অবনতির মানদণ্ড হতে হবে খাদ্য।
ভালোভাবে খেতে পাওয়া বলতে কী বুঝতে হবে তা নিয়ে অতীতে হয়েছে অনেক বিতর্ক। কিন্তু এখন বিষয়টি নিয়ে আর বিতর্কের অবকাশ নেই। কারণ পুষ্টিবিজ্ঞানীরা নিরূপণ করতে পেরেছেন এর একটা মানদণ্ড। তাই ভালোভাবে খেতে পাওয়ার সংজ্ঞা এখন হতে পেরেছে যথেষ্ট সুনির্দিষ্ট। মানবাধিকার নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। অথচ এখনো খেতে পাওয়ার অধিকারকে সেভাবে সাধারণত তালিকাভুক্ত করা হয় না মানবাধিকার বলে। কিন্তু এখন দাবি উঠছে, খেতে পাওয়ার অধিকারকে স্থান দিতে হবে মানবাধিকারের তালিকায় সর্বপ্রথমে। মানুষের জীবনে থাকতে হবে খাদ্য-নিরাপত্তা।