আমার আব্বু খুব অদ্ভুত সহজ সরল মানুষ ছিল। স্বামী, মামা, ভাই এবং অন্যান্য রোলগুলো খুব সুন্দর করে পালন করলেও, বাবার রোলে ছিল বেস্ট। আমার প্রথম দিন থেকে তার শেষ দিন পর্যন্ত আমাকে একই ভাবে লালন পালন এবং পেম্পার করে গেসে।
বাসার কোন কাজ তো না, আমার নিজের পার্সোনাল কোন কাজও আমার করা লাগতো না। আমার সব কাজ, সব মানে সব যেমন, আমার রুমাল, ব্রাশ, রেজার কিনে আনা, আমার জন্য প্রতিদিন টক ফল কিনে আনা, আমার জুতা পলিশ করে আনা, আমার কাপড় আয়রন করা, আমার শরীর খারাপের সময় আমাকে নিয়ে আসা যাওয়া করা, আমার ওষুধ কিনে আনা, আমার জন্য নাস্তা কিনে আনা, আম্মু না থাকলে আমার খাবার গরম করে দেয়া, টাকা ভাংতি করে রাখা, মানে এমন কিছু বাকি নাই যে করতোনা। আমি জাস্ট বলে রাখতাম, দেরীতে হইলেও সব রেডিমেড পাইতাম।
তবে খুব আন্ডারঅয়েল্মিং ইকোনমিক্যাল অবস্থার কারনে, সবসময় সব আশা পূর্ণ করতে পারতো না। কিন্তু এই সীমিত ইঙ্কামের ভিতরে যতটুকু বেস্ট সার্ভিস দেয়া যায় তা করে গেসে আমার জন্য। যদিও, সন্তান হিসেবে খুব কম সময়ই আসে যে আমি ইল্লোজিক্যাল জিনিস চাইসি।
সাধ্যের মধ্যে সব দিতে পারলেও, যেটা দিতে পারতো না, সেটা হচ্ছে ‘সময়’। ছোটবেলা থেকে বেশীর সময় বাসায় এসে দেখত যে আমি ঘুমায় গেসি, আর তার উঠার আগেই আমি রেডি হয়ে স্কুলে দৌড়। সো দেখাই হতো না তেমন একটা। কলেজ-ভার্সিটি আমলে আমি আমার হবি, পড়াশোনা, বন্ধু বান্ধব নিয়ে বিজি থাকতাম সো তখনও তেমন আহামরি কথাবার্তা হত না। আমি কি করতেসি, কি প্ল্যান করতেসি আব্বু সব আম্মুর কাছ থেকে শুনে নিত।
২০১২ আমার প্রচণ্ড অসুস্থতার প্রথম বছর। আব্বুও প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে ঘরে, আমিও অসুস্থতার কারণে জব ছেড়ে দিয়ে ঘরে। ভয়ানক অনিশ্চয়তা কাজ করতেসে ফ্যামিলিতে, কারন ৩জন মানুষের দুইজনই ভয়ানক অসুস্থ সাথে ইকোনমিক্যালি একদম ব্রোক। আম্মুও টেনশনে টেনশনে অসুস্থ প্রায়। যেখানে আমার ফ্যামিলিকে দেখার কথা সেখানে আমি জব টব ছেড়ে বাসায়, এই গিল্টের কারনে আমি তেমন একটা কথাবার্তা বলতাম না কারও সাথেই।
তখন খুব কারেন্ট যাইত। এক ঘন্টা, দুই ঘণ্টা কারেন্ট থাকত না। আমার রুম রান্নাঘরের সাথে হওয়ায়, কারেন্ট গেলে প্রচণ্ড গরম হয়ে যেত। তাই, আমি সামনের রুমে চলে আসতাম কারেন্ট গেলে। ওই রুমেই আব্বু আম্মু থাকে। সো কারেন্ট যাওয়ার কারনেই, আমরা পুরা ফ্যামিলি এক সাথে টাইম স্পেন্ড করা শুরু করি। আমরা সবাই সবার কাহিনী শেয়ার করতে থাকি, আব্বু তার ছোটবেলার কাহিনী বলতো, ঢাকায় এসে ফুটবল দেখার কাহিনী, দামী ইম্পরটেড কাপড় চোপড় কেনা, ফ্যান্সি ফ্যান্সি মজার মজার খাবারের কাহিনী আরও অনেক কত কি কাহিনী! আমিও আস্তে আস্তে আমার শরীরে আসলে কি ঘটতেসে বলা শুরু করলাম। নতুন জেনারেশন কি করতেসে কি ভাবতেসে, পলিটিক্স, খেলা এবং হাজারও জিনিসপাতি নিয়ে আলোচনা। প্রথমবারেরমত দুইজন আসলে কি ফিল করতেসি তা কানেক্ট করা শুরু করলাম বিশেষ করে শারীরিক অবস্থার কথা।
২০১৩ সালের এই সেপ্টেম্বরে আব্বু বিদায় জানায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সুন্দর সৃতিগুলা আর এই টাইম স্পেন্ড আসলে সম্ভব হইসে শুধুমাত্র আমাদের অসুস্থতার কারনে। মোরাল অফ দ্যা স্টোরি হচ্ছে, অসুস্থতারও আসলে একটা পসিটিভ সাইড আসে অন্য সবকিছুর মত। বাবা চলে যাওয়ার ৫ বছর পর এই প্রথম বাবাকে নিয়ে কিছু লেখলাম। অনুভুতি খুব ওভারঅয়েল্মিং হলেও, একদম খারাপও না।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:২১