somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফাইভ স্টার (কপি পেস্ট)

০৭ ই নভেম্বর, ২০১০ দুপুর ১২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ফাইভ স্টার
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

হঠাৎ করে একদিন অভিকে লোকজন বখাটে বলে গাল দিতে শুরু করল। তাতে অভির খুব রাগ হলো। এমন কী আর করে সে, যে তাকে এই গালটা দিতে হবে? প্রায় সন্ধ্যায় প্রাণগোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে বসে সে আড্ডা মারে মনির, কিসলু আর রতনের সঙ্গে। আড্ডায় সে বিস্তর রাজা-উজির মারে। কিন্তু সে রকম আড্ডা আর রাজা-উজির তো সবাই মারে। সে জন্য কেন তাকে বখাটে বলতে হবে? ঠিক আছে, সে না হয় সিগারেট খায়। একটা সময় ছিল যখন মুরবি্ব দেখলে টেবিলের নিচে লুকিয়ে ফেলত সিগারেট ধরা হাত, এখন না হয় আর লুকায় না, এখন না হয় একটু শিসটিসও মারে সে, অথবা দু-একটি অভব্য কমেন্ট ছুড়ে দেয় কারো দিকে। সে রকম হাবলুও তো করে। হাবলুরও একটা দল আছে, যে দলের নোমান একটা ফাইভ স্টারের মালিক। এই প্রাণগোপালে বসা নিয়েই মারামারি হয়েছে তাদের সঙ্গে। নোমানের ফাইভ স্টারটা তার সঙ্গেই ছিল। তার পরও অভি তাকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। এখন হাবলুরা বসে হোটেল জোনাকিতে, তিন পাড়া দূরত্বে। এই মারামারিটা না হলে অভিদের পাড়ার কেউ ঘরে থাকতে পারত না। এ জন্য তাকে ধন্যবাদই তো দেওয়ার কথা মানুষজনের। অথচ উল্টো তাকে বখাটে বলে। তার যে মোটরসাইকেলটা নিয়ে এত মাথাব্যথা পাড়ার লোকজনের, সে মোটরসাইকেলে তুলে চান মিয়ার ছেলে ধনুকে হাসপাতালে না নিলে সে কী করত? হ্যাঁ, ধনুকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়েছিল কিসলু। কিন্তু তাতে কী? অভি যদি তাকে হাসপাতালে না নিয়ে যেত, ধনু তো মারাও যেতে পারত। হ্যাঁ, হ্যাঁ_ধনু এখন ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটে, একটা পা তার কেটে ফেলতে হয়েছে বলে। তাতে কী, প্রাণটা তো বেঁচেছে। অথচ তার মোটরসাইকেল নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই।
বাবাও গলা মেলান ওই অভিযোগওলাদের সঙ্গে। বাবা বলেছেন তার মাকে, ও তিশার মা, ছেলেটারে সামলাও। বাইরে তো মুখ দেখানো যায় না।
তিশার মা, যাকে ছেলেমেয়ের আড়ালে শাহানা বলে ডাকেন অভির বাবা মুরাদ সাহেব, গলায় ঝাঁঝ তুলে বলেছেন, মুখ না দেখানোর মতো কী হলো?
কী হলো মানে? তুমি শোনো না? জানো না?
না, আমি শুনিও না, জানিও না। আমার ছেলে নিয়ে কেউ কিছু বললে আমি শুনি না। গলার ঝাঁঝ বাড়িয়ে বলেছেন শাহানা, কথা কারা রটায় তুমি জানো না? ছোটলোকের বাচ্চা হাশিম মিয়া আর গুণ্ডা নোমানের বেশরম মা কোহিনূর বেগম। ডাকাতের বাবা আর গুণ্ডার মা। রাস্তার মেয়ে। বদমাশ। তুমি জানো না?
মুরাদ সাহেব অস্বস্তিতে পড়েন। ছেলে দাঁড়িয়ে শুনছে। আর মিটিমিটি হাসছে। না, হাশিম টাশিমের কথা আমি শুনি না। মুরাদ সাহেব বলেন, আমাকে যারা বলে তারা পাড়ার ভদ্রলোক।
কারা সেই ভদ্রলোক, বল তো বাবা? এবার অভি জানতে চায়।
আমিও তা-ই বলি। কারা সেই ভদ্রলোক? এবার অভির মা জানতে চান। আর তুমিই বা কেমন মানুষ? ওরা বলবে, আর তুমি শুনবে_কেন, দু-ঘা লাগিয়ে দিতে পারো না?
মুরাদ সাহেব এবার রেগে যান। রেগেই বলেন, ছেলেটার পক্ষ নিয়ে মাথা বিগড়ে দিও না। তোমার কানে যায়নি? ও বিকেল হতেই মেয়েদের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে? মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে? ছিঃ!
অভি দুচোখ কপালে তুলে বলল, বাবা, এসব কে বলেছে তোমাকে? আর ইউ ম্যাড? আমি যাই কিসলুর বাসায়। ওর বাসা ছোট, ভেতরে বসার জায়গা নেই। তাই গেটে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারি।
হলো তো তোমার শিক্ষা? শাহানা পুলকের সঙ্গে স্বামীকে চেপে ধরেন। লোকজন অভিকে সহ্য করতে পারে না। বানিয়ে বানিয়ে কথা বলে।
না, যারা বলেছে তারা না দেখে বলেনি। রেগে বলেছেন মুরাদ সাহেব।
ও, তুমিও ওদের দলে নাম লিখিয়েছ। ঠিক আছে, দিশাকে ডাকি।
দিশা অভির ছোট বোন। ঢাকার ইডেনে পড়ে, ছুটিতে বাড়ি এসেছে। মামা জোর করে ঢাকা নিয়ে গেছেন। বলেছেন, ঢাকায় না পড়লে ভালো চাকরি পাবে না। দিশার আবার খুব শখ চাকরি করবে। বড় চাকরি। হ্যান্ডসাম স্যালারি।
শাহানা জোরে জোরে দিশাকে ডাকলেন। দিশা কাছেই ছিল। 'এত জোরে জোরে ডাকছ কেন মা', বলতে বলতে এসে দাঁড়াল।
ডাকছি, কারণ তোমার গুণধর বাবা নাকি শুনেছেন, অভি মেয়েদের কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে বখাটেপনা করে।
কথাটা শুনে জোরে জোরে হাসল দিশা। ভাইয়া বখাটেপনা করে, তা-ও আবার মেয়েদের কলেজের সামনে? বাবা, তুমি খারাপ মানুষজনের সঙ্গে মিশছ।
তা ছাড়া বাবা, কলেজটা তো আমার। ভাইয়া ওখানে কিছু করলে কি আমি শুনতাম না?
মুরাদ সাহেব ভাবছিলেন কিছু একটা বলবেন। ছেলেকে যে দু-এক রাতে মুখে মদের গন্ধ নিয়ে ফিরতে দেখেছেন; পুলিশের দারোগা মজিবরের বর্ণনা মতে, অভি যে পর্নো সিডির ব্যবসায়ী আরিফ মিয়ার দোকানে বসে আড্ডা দেয়, সময় কাটায়; অথবা আরো মারাত্মক যা, অভির কলেজের সবুজ স্যার যে প্রায় খারিজই করে দিয়েছেন তাকে কলেজের সংঘ থেকে, এসব প্রসঙ্গ তুলবেন। কিন্তু বলতে গিয়ে তিনি থেমে গেলেন। এগুলো লজ্জার কথা। ছেলেমেয়ের সামনে বলা যায় না।
অভির চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন শাহানা, এটা আমার সোনার চাঁদ ছেলে। কোনো খারাপ কাজ করতে পারে না। তুমি বাবা হয়ে ওর বিপক্ষে দাঁড়িও না।
মুরাদ সাহেব দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। তার বিপদটাই যেন বেশি। তিনি জানেন, অভি বখে গেছে। অথচ শাহানা দেখেও না দেখার ভান করছেন। এমনকি তিশাও। আর দিশার কথা তো নিজেও আরেকবার শুনলেন। তিনি ভাবেন, কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করবেন, তার কোনো হদিস করতে পারেন না।

দুই.

অভির রাগটা আরো বেড়েছে, কারণ হাবলুর দলটা এমপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। এমপি শহরে আসেন কালেভদ্রে, এবার এসেছেন তিন মাস পর। হাবলু আর ফাইভ স্টার নোমান তাঁর বাড়ি গিয়ে সকাল থেকে পড়ে থাকল। এমপির ডানহাত কানা সগিরের সঙ্গে ভাব জমাল। তাকে বস বলে ভজতে শুরু করল। একসময় এমপি যখন জনসভায় গেলেন, হাবলুদের দেখা গেল তাঁর খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে। ফলে থানাও গেল হাবলুর পক্ষে। হাবলুরা কিছু বুঝিয়েছিল কি না থানার পুলিশকে কে জানে। এক বিকেলে প্রাণগোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে অভিদের ধরে নিয়ে গেলেন দারোগা মজিবর। সারা রাত হাজতে কাটিয়ে সকালে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারল অভি। তা-ও সম্ভব হলো মজিবর মুরাদ সাহেবের বন্ধু হওয়ায়। মুচলেকায় লিখতে হয়েছে, সে আর বখাটেপনা করবে না, বেগম মুশফিকা আজাদ মহিলা মহাবিদ্যালয়ের সামনে মেয়েদের আর উত্ত্যক্ত করবে না, এইসব।
থানা থেকে অভিকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মুরাদ সাহেব ভাবছিলেন, এবার একটা বিহিত করা যাবে। সারা রাত ঘুমাতে পারেননি শাহানা। তিনি নিশ্চয় এবার বুঝবেন, সমস্যাটা কত দূর গড়িয়েছে। দিশার ঢাকা ফিরে যাওয়ার কথা ছিল, যেতে পারেনি। তারও নিশ্চয় রাগ বাড়বে। তিশারও, কারণ তিশা নিজেই বলেছে, শ্বশুরবাড়িতে অভিকে নিয়ে কথা হয়, সে পড়ে অস্বস্তিতে। তবে শ্বশুরবাড়ি বলে কথা, ভাইয়ের সম্পর্কে কুৎসা রটাতে পারলে তারা আনন্দ পায়। তিশা মোটেও বিশ্বাস করে না অভি খারাপ কিছু করতে পারে।
কিন্তু বাড়ি ফিরে যে হৈচৈ আর আবেগঘন পুনর্মিলনীর মধ্যে পড়লেন মুরাদ সাহেব, তাতে তার সব উদ্দেশ্য হাওয়ায় উড়ে গেল। অভিকে জড়িয়ে ধরে শাহানা কাঁদলেন, দুই বোন কাঁদল, তারপর নরপশু হাশিম আর গণিকাবাড়ির সর্দারণী কোহিনুর বেগমের চৌদ্দগোষ্ঠীর পিণ্ডি চটকালেন শাহানা। তারপর ছেলেকে গোসলে পাঠিয়ে বিশাল নাস্তার আয়োজনে নামলেন।
মুরাদ সাহেব শুধু একবার বলেছিলেন শাহানাকে, এবার ছেলেটাকে ফেরাও। কিন্তু তাতে রাগে আগুন হলেন শাহানা, কাকে ফেরানোর কথা বলছ তুমি? তার রাগের আগুন এবার শিখা মেলল। ওই আবর্জনার ছেলে হাবলু আর গণিকার ছেলে নোমান_তুমি দেখনি ওরা আমার সোনার ছেলেটাকে নিয়ে কী খেলাটা খেলল? আর তোমার বন্ধু ঘুষখোর দারোগা আমার বাপধনটাকে কোমরে দড়ি দিয়ে থানায় নিয়ে গেল? বাজারের মাঝখান দিয়ে? আর তুমি ফেরানোর কথা বলছ আমার সোনার চাঁদ ছেলেকে?
শাহানা শেষদিকে কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন। মুরাদ সাহেব পালিয়ে বাঁচলেন।

তিন.

এমপি-দারোগার সমর্থন এক জিনিস, আর কিসলুর নেটওয়ার্ক আর তার জিঘাংসা অন্য জিনিস। ফলে এক রাতে শহরের ছাতিমতলায় একটা দোকানের পেছনে আবর্জনায় পড়ে থাকতে দেখা গেল হাবলুকে। তার গলাটা মস্ত হাঁ করা। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে যাচ্ছে কোটর থেকে। নোমানকে পাওয়া গেল তিন মাথার বিদ্যাপীঠ কোচিং সেন্টারের সামনে। তার হাত-পা বাঁধা, সারা শরীরে আঘাতের নিদর্শন। কিন্তু বেঁচে আছে ছেলেটা। বেঁচে আছে; কিন্তু বোবা হয়ে গেছে। তার কোমরে সব সময় গোঁজা থাকে যে ফাইভাস্টার, সেটি হাওয়া হয়ে গেছে। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা নেই। ছেলেটা এই পিস্তল আর ব্যবহার করতে পারবে, সে রকম মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আরেক দফা হামলা হলো পুলিশের। অভিও ধরা পড়ল। এবার অবশ্য শাহানা নিজেই নামলেন। কিছু গহনা বিক্রি করলেন। উকিল লাগালেন। থানার ওসির সঙ্গে দেখা করলেন।
দেখা করতে যাওয়ার সময় তাঁর হাতে একটা খাম ছিল। বেরোবার সময় খামটা আর দেখা গেল না। হয়তো ভুল করে ওসির রুমে ফেলে এসেছেন।
এমপি আবার ফিরে গেছেন তাঁর ঢাকার ভালুক-ঘুমে। তাঁর সঙ্গে গেছে কানা সগির।
জামিন পাওয়া গেছে আদালতে মামলা গড়াতে না গড়াতে। ওসি বলেছেন শাহানাকে, ম্যাডাম, ভয় নেই। নতুন কিছু ঝামেলা না বাধলে চিন্তার কারণ নেই। তারপর একটু থেমে বলছেন, মজিবরকে লাকসাম পাঠিয়ে দিয়েছি। এ জন্য খরচা হয়েছে বেশ।
শাহানা চোখে হাসি তুলে বলেছেন, আপনি আমার ছেলেটাকে দেখে রাখেন, খরচার ব্যাপারটা আমি দেখব। এ কথা অবশ্য তিনি বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেছেন। আত্মবিশ্বাসের মূল কারণটা এ রকম : অভি আজকাল তাঁকে বেশ টাকা-পয়সা দিচ্ছে। যথেষ্টই। সে একটা ব্যবসা খুলেছে। সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। তাতে প্রচুর আয় হচ্ছে। তবে সাপ্লাইটা কিসের, তা তার কাছে পরিষ্কার হয়নি। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়ে তার জ্ঞান কি আর ছেলের জ্ঞানের সমান হতে পারে?

চার.

ফাগুনের দিন। ঢাকা গিয়েছিল অভি, দিশা তাকে যেতে বলেছিল। দিশার এক বন্ধু হয়েছে ঢাকায়, নাম আরমান। জেমসের কনসার্ট দেখতে গিয়ে পরিচয়। তারপর মাসচারেকের মধ্যে বন্ধুত্বটা এমন হয়েছে যে একজন আরেকজনকে ছেড়ে একটা দিন আলাদা কাটাতে পারে না। আরমান পড়ে জগন্নাথে, কিন্তু কিছু দিন ধরে ওর পেছনে লেগেছে সরকারি দলের এক ক্যাডার। আরমান টাকা ধার নিয়েছিল ওর থেকে। সেই টাকা ক্যাডারটা অনেকবার চেয়েও ফেরত পায়নি। শেষে রেগেমেগে বলছে, টাকাটার দ্বিগুণ দিতে হবে, নইলে পৃথিবীকে যেন বিদায় জানাতে প্রস্তুত থাকে আরমান।
অভি গিয়ে দেখা করেছে ক্যাডারের সঙ্গে। তার কোমরে নোমানের ফাইভ স্টার। ক্যাডার এমন ভয় পেয়েছে, টাকার কথাই ভুলে গেছে। অভি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, আরমানের মাথার একটা চুল এদিক-সেদিক হলে ক্যাডার যেন ধরিত্রীকে বিদায় জানিয়ে পশ্চিমের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে।
ফাগুনের দিন। দিশা আর আরমান আধা বেলা এখানে-সেখানে ঘুরেছে, বইমেলায় গিয়েছে, তারপর সায়েদাবাদে গিয়ে বাসে তুলে দিয়েছে অভিকে। অভির মনে ফাগুনের আমেজ। কোমরে ফাইভ স্টারের মৃদু উত্তাপ। সে আবেশে ডুবতে ডুবতে বাড়ি এসেছে। তারপর সোজা গেছে প্রাণগোপাল ভাণ্ডারে। সেখানে কিসলু, রতন ও মনিরকে আজকের ঘটনাটা অনেকক্ষণ ধরে বলবে সে। কিসলুর জন্য ইয়াবা কিনেছে সে কয়েকটা। নিশ্চয় পুলকিত হবে।
কিন্তু প্রাণগোপালে ঢুকতেই কিসলুর প্রথম কথা, ফাইভ স্টারটা দে তো অভি।
অভি আহত হয়। দেব তো, এত তাড়াহুড়া কেন?
কথা বাড়াবি না। কিসলু ঠাণ্ডা গলায় বলে।
কথা অভিও বাড়াল না। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা তার মুখে একটা তেতো স্বাদ ছড়িয়ে দিল।
ইয়াবা বলে কথা। অনেক রাতে যখন বাড়ির পথ ধরল অভি, তার কাঁধে হাত রেখে হা হা করে হাসছে কিসলু। দোস্ত, কিসলু শুধু বলছে, জব্বর দেখাইলি ওই ক্যাডারের বাচ্চারে।
অনেক রাত, কিন্তু তাতে কী। মাকে বলছে অভি, বাসের চাকা ফেটে বিশাল দুর্ঘটনা। প্রাণে যে বেঁচে এসেছে, তা ওপরওলার দয়ায়।
মুরাদ সাহেব অবশ্য ইয়াবা বোঝেন। কিন্তু তিনি যে শাহানাকে কিছু বলবেন, কী করে সম্ভব? শাহানা তো ছেলের গা-মাথায় শুধু হাত বুলাচ্ছেন, আর আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছেন।

পাঁচ.

ফাগুনের রাত। নরম আর আর্দ্র। শিশিরে অনেকক্ষণ ধরে ভিজতে থাকলে ফুল যেমন হয়। ৯টার মতো বাজে। বাজারের দোকানপাটে ঝাঁপ পড়েছে অনেক আগে। এখন দু-একটা ফার্মেসি আর খাবারের দোকানও বন্ধ হচ্ছে। রাস্তায় মানুষজন কম। রিকশা চলছে ঢিমেতালে। একটা চাঁদের আধখানা ঝুলছে আকাশে। সেদিকে তাকিয়ে ঘেউ ঘেউ করছে নেড়ি কুকুরের একটা দল।
প্রাণগোপাল থেকে বেরিয়ে পশ্চিমে নতুন পাড়ার দিকে রওনা দিল কিসলু আর মনির। রতনের মায়ের ব্লাডপ্রেশারের ওষুধ কিনতে হবে। সে গেল একটা ফার্মেসিতে। অভি দাঁড়াল একটা বাতিহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে। তার ব্লাডার খালি করতে হবে। তোরা যা, আমি আসছি, বলতে বলতে প্যান্টের জিপার খুলল অভি।
একটা হাওয়া উঠছে কোন দিক থেকে। অভির চুল উড়ছে। তার খুব ভালো লাগার একটা অনুভূতি হচ্ছে। মাঝখানে কিসলুর সঙ্গে একটুখানি ঠোকাঠুকি লেগেছিল, আজ সেটা মিটমাট হয়ে গেছে। ফুলে ওঠা ব্লাডারটা খালি হতে সময় নিচ্ছে। তা নিক। আজ মিষ্টির সঙ্গে ইয়াবার দোস্তিটা দারুণ জমেছে। এখন নতুন পাড়ায় মোক্তারের বাসায় যাবে। মোক্তারের কম্পিউটারে এক শ ঘণ্টার আনন্দ। কয় দিন থেকে কিসলুকে এই আনন্দ পেয়ে বসেছে। মনিরকেও। রতন একটা কেরু কম্পানির রামের ব্যবস্থা করে রেখেছে। মোক্তারের ঘরটা পুকুরের পাড়ঘেঁষে। নির্জন। উটকো সমস্যারও সম্ভাবনা নেই।
প্যান্টের জিপার লাগিয়ে রাস্তায় নামল অভি। আজ হাঁটতে খুব ভালো লাগছে। হাঁটছে না, যেন উড়ছে। কিছুদূর এগোলো সে। তারপর শুনল, রতন তাকে ডাকছে। রতনের গলায় উত্তেজনা। উত্তেজনাটা চাপা, এই অভি, জলদি আয়। কোথায় অভি জিজ্ঞেস করে, কেন?
আরে মাল পাওয়া গেছে, জলদি আয়, রতন বলল। তার উত্তেজনা এখন মাথায় চড়েছে।
কোথায়।
আয়, রতন বলল এবং প্রায় দৌড়েই ঢুকল আলেয়া ফটো স্টুডিওর পাশের গলিতে। গলিটার কয়েক পা গেলেই মেসার্স আগুন ট্রেডার্সের গুদাম। গুদামের পাশে একটা দোতলা ইটের দালান। কে কবে শুরু করেছিল দালানটি, কে জানে। কিন্তু খাঁচাটা আর কিছু দেয়াল তুলতেই হয়তো টাকা সব শেষ হয়ে গেছে। এখন দোতলার দুটি ঘর ছাড়া সবই অসম্পূর্ণ। ওই ঘর দুটোর চাবি আবার থাকে রতনের কাছে। রতন আগুন ট্রেডার্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। তবে তাকে কাজ না করলেও চলে। কারণ কিসলু এবং ফাইভ স্টার।
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে বুঝল অভি, একটা মেয়ে জুটিয়েছে কিসলু। তার বেশ খুশিই লাগল। অভিজ্ঞতাটা ঘন ঘন সঞ্চয় করার সুযোগ পায় না। কিসলুর দৌলতে এখন থেকে পাবে।
দোতলার ঘর দুটি অন্ধকার। একটি ঘরে মেয়েটিকে নিয়ে কিসলু আর মনির। অন্য ঘরে রতন আর অভি। দুই ঘরের মাঝখানে একটা দরজা, তাতে একটা পাল্লা। কিন্তু একটা যে জানালা আছে, তাতে কোনো পাল্লা নেই। আলো থাকলে দিবি্ব ওই ঘরের সব কিছু দেখা যেত। মেয়েটিকে মাটিতে শোয়ানো হয়েছে, তার মুখে কাপড় গোঁজা। কিসলু তাকে বলছে, সে যদি চিৎকার না করে তাহলে কাপড় সরাবে। তবে চিৎকার দিয়েও লাভ নেই। কেউ শুনবে না। মেয়েটা শুধু গোঁ গোঁ করছে। এবার কিসলু তার মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে নিল। মেয়েটি কিন্তু চিৎকার দিল না। সে শুধু কেঁদে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। আপনার পায়ে পড়ি। আমি বাড়ি যাব।
মেয়েটির গলা শুনে অভির মাথার সব চুল দাঁড়িয়ে গেল। সে একটা লাফ দিয়ে জানালাটা পার হলো, তারপর সোজা মেয়েটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুহাতে তাকে ধরে বলল, দিশা!
ভাইয়া! বলল দিশা এবং অভির বাড়ানো হাত শক্ত করে ধরে যেন সে চেতনার অন্য পাড়ে চলে গেল। তার গলায় এক জীবনের স্বস্তি, ভয়, ক্লান্তি আর সর্বনাশের খাদ থেকে ফিরে আসার অবিশ্বাস। চল, বাড়ি চল_অভি বলল। দিশাকে হাত ধরে তোলার চেষ্টা করল, কিন্তু দিশা যেন উঠে বসার শক্তি পাচ্ছে না কিছুতেই। শুধু অভির হাতটা জোরে ধরে রেখে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে। যা, তোরা যা এখান থেকে। গেট আউট_চিৎকার করে বলল অভি। তারপর দিশার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, 'ওঠ দিশা, বাড়ি চল। কিন্তু কখন এলি? কেন এলি?
অনেক কষ্টে উঠে বলল দিশা। খুব জোরে নিঃশ্বাস নিল। এই প্রথম দিশার মুখ দেখল অভি। সারা মুখে যেন কেউ কালি মেখে দিয়েছে। চোখের কিনারা যেন পুড়ে গেছে। পানিতে ভেসে যাচ্ছে দুই চোখ।
আরমানকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে_নিচুস্বরে বলল দিশা, অভির না শোনার মতো করে।
কে মেরেছে?
দিশা চুপ করে থাকল।
আমাকে জানাসনি কেন?
আমার মোবাইলটা রেখে দিয়েছে। আমি পালিয়ে এসেছি।
ঠিক আছে চল। বাড়ি চল। দিশার হাত শক্ত করে ধরে মেঝেতে পড়ে থাকা দিশার ওড়নাটা তুলে তার গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল অভি।
উঠতে উঠতে দিশা বলল, তুমি যে আসবে আমি জানতাম ভাইয়া।
দুহাতে দিশাকে টেনে দাঁড় করিয়ে নিজে দাঁড়াতে গিয়ে টের পেল অভি, একটা কঠিন কিছুর সঙ্গে মাথাটা লাগল। অভি বুঝল, নোমানের সেই ফাইভ স্টার। ঘুরে দাঁড়িয়ে ফাইভ স্টারটাকে দেখল অভি। একটা ক্ষিপ্র টানে সেটি ছিনিয়ে নেওয়ার কথা মনে এসেছিল তার, কিন্তু বুঝল, সম্ভব নয়। কিসলু দুই হাতে সেটি তাক করে ধরে দাঁড়িয়ে। দিশার দিকে ইশারা করে বলল, এইটারে আমি পাইছি, এইটা আমার। অহন তুই তফাত যা।
দিশার মুখে যে কাপড়টা গুঁজে দিয়েছিল কিসলু, সেটি এখন মনির গুঁজে দিল অভির মুখে। শালারে বান্ধ। জোরে হুংকার দিল কিসলু। আর এইটারেও। ওড়নাটা খুইল্লা মুখে পেঁচা।
অভি তাকাল কিসলুর দিকে। কিসলুর চোখ-মুখ ভাবলেশহীন। ফাইভ স্টারের শীতল নলটির মতো। ক্ষমাহীন চোখে নলটি তাকিয়ে আছে অভির দিকে। একটা আঙুল টেপা দূরত্বে।

(কালের কন্ঠের শিলালিপিতে প্রকাশিত)
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×