somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ বৃত্তবন্দী

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

*
আমার বেরসিক বাবার কাছে সাগর মানেই হল পানি। বাথরুমের ট্যাপের জল আর সমুদ্রের জলের মধ্যে তিনি কোন পার্থক্য পান না। তাই আমার মায়ের কখনো সমুদ্র দেখা হয় নি।

একজন মধ্যবিত্ত গৃহিনীর মত তার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে রান্নাঘরে। কাকের কা কা শব্দে কাকের অবস্থান টের পাওয়া যায়। ঠিক তেমনি গরম তেলে মাছ ছাড়ার শব্দে আমরা না দেখেও রান্নাঘরে মায়ের উপস্থিতি টের পাই। আমরা বুঝি সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। যেন রান্নাঘরে মায়ের বন্দীত্ব আমাদের ভাবনাহীনতার প্রতীক।

জীবনে খুব কম সকালেই এমন হয়েছে যে- জেগে উঠে মায়ের মুখ দেখি নি। ভোর ছ'টায় ক্লাস আছে। মা-তো আছে। ঘুম থেকে উঠতে খুব বিরক্ত লাগত। নাস্তা খেয়ে বের হবার সময় কখনো ভুলেও চিন্তায় আসে নি- মা কয়টায় উঠেছিল। যেন এটাই চরম স্বাভাবিকতা। আজ ভাবলে অবাক লাগে যে, আমরা সেইসব দিনে একটুও অবাক হতাম না।

মা-টা এই শহরের তুলনায় যথেষ্ঠ বোকা। তার বান্ধবী গোত্রীয় মহিলারা বাসায় এসে যখন গল্প শুরু করতেন, আমাদের মা বোকার মত হাসত খালি। অন্যঘরে থাকলেও আমাদের মাথা গরম হয়ে যেত। কারন এইসব গল্পের অধিকাংশই গালগল্প- বানানো, ফাঁপানো কাহিনী। আমরা বুঝতাম। কিন্তু মা বুঝত না। গালগল্প করাতো দূরে থাক। গল্প বানানোর জন্য যতটা বুদ্ধির দরকার, আমাদের বোকা মায়ের তা ছিল না।

মায়ের সারাটা জীবন ছিল ছকে বাঁধা। তার চিন্তার জগৎ বড্ড বেশি সরল। খাবারে লবন বেশি হল কি না, যতটুকু তেল আছে তাতে পুরোমাস চলবে কি না, সকালে কখন কাকে জাগাতে হবে- এসব ভাবতে ভাবতেই তার দিনের অধিকাংশ সময় চলে যেত। কখনো একটু বিশ্রাম পেলে আমাদের বোকা মা হয়ত খুঁজে খুঁজে শার্টের ঝুলে পড়া বোতাম সেলাই করত।

চাকরি করলে ছেলেমেয়েকে সময় দিতে পারবেন না, এইসব গুজবে মা রান্নাঘরকেই তার অফিস বানিয়েছিলেন। অথচ তিনি চাইলেই একটা ছোটখাটো চাকরি যোগাড় করতে পারত। বরং এমন জীবন তিনি বেছে নিয়েছিলেন, যেখানে সব ছেড়ে কিছুদিনের জন্য একচিলতে বিশ্রামের ফুসরতও মিলবে না।

আমি, টুপুন, বাবা- এরা সবাই ছুটি পেত। শুক্রবারের ছুটি, ঈদের ছুটি, পূজোর ছুটি, হরতাল-অবরোধের ছুটি, খুচরা ও পাইকারী ছুটি। ছুটি ছিল না শুধু মায়ের। অথচ মায়ের অফিসটা কি ভীষন গরম। চুলার আঁচে, পেঁয়াজের ঝাঁঝে আমরা কখনো সেখানে একমিনিটের বেশি টিকতে পারতাম না। এর বেশি সময় টেকার দরকারও অবশ্য ছিল না কখনো। আমরা রান্নাঘরে শুধুমাত্র বেসিনে এঁটো থালা-বাটি রাখতে যেতাম। কোন এক অদৃশ্য যাদুবলে সেগুলো একটুপরেই ঝকঝকে হয়ে যেত।

মায়ের ছুটি যে একেবারেই ছিল না, কথাটা পুরোপুরি সত্য না। চার-পাঁচ বছরে মা এক-আধবার অসুস্থ হলে ছুটি পেত। হয়ত বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। সেদিন আমরা সারা সংসার অচল ঘোষনা করে মাকে ছুটি দিতাম।


*
সকালে ঘুম থেকে জেগেই মনে পড়ল, আজকে এমনই একটা দিন। মায়ের ছুটির দিন। সাথে সাথেই মনটা বিষন্ন হয়ে গেল। গতকাল রাত থেকে মায়ের শরীরটা বড্ড বেশি খারাপ করেছে। প্রায় হঠাৎ করেই প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল। মা আবার সহজে ঔষধ খেতে চান না। জোর করতে হয়। এদিকে টুপুনের ক্লাস শুরু হওয়ায় সে হোস্টেলে চলে গেছে। বাবা গেছেন গ্রামের বাড়িতে। বাসায় শুধু আমি আর মা।

নিজে নিজে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস নেই বলেই হয়ত আজ একটু বেলা করে ঘুম ভেঙ্গেছে। ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে মায়ের সাড়াশব্দ পেলাম না। তার মানে মায়ের শরীর ঠিক হয় নি। অর্ধেক সুস্থ হলেও মা কাজ করা শুরু করেন। তাকে থামানো যায় না। ভাবলাম মা আরেকটু ঘুমাক। এইফাঁকে আমি চট করে বাইরে থেকে নাস্তা নিয়ে আসি।

নাস্তা নিয়ে এসে দেখি মা এখনো ঘুমাচ্ছে। দেখে মায়া লাগে। বিছানার কাছে গিয়ে আস্তে করে মাকে ডাকলাম। উত্তর আসে না। ডাকটা বোধহয় বেশি আস্তে হয়ে গেছে, মা শুনতে পায় নি। এবার একটু গলা চড়ালাম।
'মা। উঠবা না?'
গলাটা একটু কেঁপে গেল।
জবাব নেই।
মায়ের ঘুমতো এতটা গভীর না। ছোটবেলা থেকেই দেখছি হালকা আওয়াজ পেলেই মায়ের ঘুম চটে যায়। অথচ আজ। প্রায় হঠাৎ করেই মনের অবচেতনে কোনরকম পূর্বপ্রস্ততি ছাড়াই একটা ঝড় আসলো।

পুরো পৃথিবীটা কেমন যেন নাড়া খেয়ে গেল। এর আগে আমি কখনো ভূমিকম্প টের পাই নি। অথচ একটা ভূমিকম্প এখন আমার বুকপকেটে বসে আছে। গলার কাছে কিছু একটা যেন জট পাকিয়ে যায়। বুকটা ফাঁপা লাগে। দুই পা যেন কেউ শক্ত করে মেঝের সাথে আটকে দিয়েছে। তারা মেঝের সাথে আটকে থেকেও দুলছিল। সাথে দুলছিল ঘরের দেয়াল। মনে হচ্ছে এই ঘরের বাইরে আকাশ নেই। এর বাইরে পৃথিবী নেই।

যখন নেশাগ্রস্তের মতো টলতে টলতে আমার ঘরে চেয়ারে এসে বসলাম, তখন আমার পায়ে আর জোর নেই। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। অথচ এই প্রবল তৃষ্ণা পানির জন্য না, সেটা নিশ্চিত। মাথাটা ফাঁকা। অথচ সেখানে কোন দুঃখবোধ নেই। মস্তিষ্ক কিছু ভাবতে পারছে না। এখনো সে প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটে নি।

তার আর কি দোষ। নিজেও এখনো বুঝতে পারছি না। প্রচন্ড কষ্টের কোন অনুভূতি হচ্ছে না। তার বদলে কেমন একটা অপ্রস্ততবোধ ভাসে ঘরের বাতাসে।

ছোটবেলা থেকেই অনেকবার মায়ের মৃত্যুর পরের কথা ভাবতে চেয়েছি। কখনোই খুব একটা লাভ হয় নি। বড়জোর অন্ধকার দেখেছি চোখে। অথচ এই এখন, সেই মুহূর্তটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ভাবি এরচেয়ে অন্ধকারইতো ভালো ছিল বেশি। চারিদিক ঝাপসা হয়ে আসে।

আস্তে আস্তে মাথা পরিষ্কার হয়। এখন থেকে কি প্রতিবেলা খেয়েছি কিনা তা নিয়ে কেউ চিন্তা করবে? কেউ কি ভাত বেড়ে দেবে? বাকীজীবন কি আর আমি ভাত খেতে পারবো? খেতে বসলেইতো চোখ ঝাপসা হয়ে যাবে। কিছুটা সামলে হয়ত চোখের পানি মেশানো ভাত মাখব। মুখে তোলা হবে না। এরকম আরো কত চিন্তা এসে ভীড় জমাতে লাগল বুকের কোণে। এই ভারী বুক নিয়ে নিঃশ্বাস নিতে এক পৃথিবী কষ্ট হয়।

বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ফোনটা হাতে নিলাম। কাকে প্রথম ফোন করব? বাবাকে? টুপুনকে? নাকি আর কাউকে? ফোন করে কি বলব? ভাবতে ভাবতেই চোখ ভারী হয়ে আসে আবার। আমি আর ভাবতে চাই না।


*
আমি মাথা তুলছি না। সাবধানে বসে আছি। মাথা একটু নড়লেই আমার চোখভর্তি পানি টুপ করে কোলের উপর পড়বে। ভীষন লজ্জা পেয়ে যাবো।

'তুই কি ভেবেছিলি মরে গেছি?'
ভেজা কন্ঠটায় হালকা একটা রসের ছাপ।
না তাকিয়েও বুঝতে পারি একটা নারীমূর্তি আমার দরজার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন জানি বোকা বোকা লাগে। আবার খুশিতে বা উত্তেজনায় একটা চিৎকার দিতেও ইচ্ছা করছে। কি বোকা আমি। চোখ ভরা জল নিয়ে আমি অনুমান করি মায়ের আদ্র চোখে কিছুটা কৌতুক চিক চিক করে।

তবু আমি বেশ যত্ন করে চোখের পানি চোখেই রাখি। পড়তে দিই না। মধ্যবিত্ত এমন একটা বৃত্ত, যেখানে প্রচন্ড ভালোবাসা যায়, কিন্তু প্রকাশের অধিকার সীমিত। এখানে চোখের পানি মানে হচ্ছে প্রচন্ড লজ্জা। এইসব নিয়ম প্রথম কে চালু করেছিল জানিনা। তবে আজও আমরা একচোখ ঝাপসা পৃথিবী নিয়ে সেইসব নিষ্ঠার সাথে মেনে চলেছি।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:২১
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×