somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রোহিঙ্গা: অবহেলিত, নির্যাতিত তবু অপরাজিত এক জনপদ

০৭ ই এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৯:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার বেশ কঠোর মনোভাব দেখিয়ে কিছু রোহিঙ্গা শরনার্থীদের মায়ানমার ফেরত পাঠায়। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে যা আলোচিত এবং সমালোচিত হয়েছে। তার সূত্র ধরে এই লেখাটিতে বিদ্যমান রোহিঙ্গা সমস্যার কিছু দিক ফুটিয়ে তোলা আমার উদ্দেশ্য। ]

রোহিঙ্গা ইস্যু: সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ

প্রথমেই আসুন দেখি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযান আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে কিভাবে এসেছে। নীচে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম থেকে অল্প কিছু অংশ দেয়া হল। পুরোটা পড়তে চাইলে সাথের লিংকে ক্লিক করুন।

১। রয়টার্স:

যেসব দেশবিহীন রোহিঙ্গা শরনার্থীরা তাদের নিজের দেশ মায়ানমারের শোষন থেকে মুক্তির জন্য প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়েছিল, তাদেরকে পিটিয়ে সেখান থেকে আবার ফেরত পাঠানো হচ্ছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ আশ্রয়কেন্দ্র ভেংগে দিয়েছে এবং জোরপূর্বক বাসিন্দাদের সরিয়ে দিয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের একজন রিসার্চার ডেভিড ম্যাথিসন বলেন, "গত ত্রিশ বছর ধরে রোহিংগারা বাংলাদেশে নানা রকম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং সরকারের আচরনে এটা স্পষ্ট যে তাদের কাছে রোহিংগারা অনাকাংখিত।" রয়টার্স সংবাদটি প্রকাশ করে "Rohingyas reported beaten, evicted in Bangladesh" ("বাংলাদেশে রোহিংগারা প্রহৃত এবং বহিষ্কৃত") শিরোনামে।
http://www.reuters.com/article/idUSSGE61I066

২। নিউ ইয়র্ক টাইমস:

নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে দুটি আর্টিক্যালের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। প্রথমটি ফেব্রুয়ারী ২০ তারিখের এবং দ্বিতীয়টি মার্চের ১৩ তারিখের।

"বার্মিজ রিফিউজিস পারসেকিউটেড ইন বাংলাদেশ" শিরোনামে ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত লেখায় বাংলাদেশে রোহিংগা শরনার্থীদের উপর নির্যাতনের কিছু চিত্র তুলে ধরা হয়। গত এক মাসে শুধু কক্স বাজারেই শত শত রেজিস্ট্রেশন বিহীন রোহিংগাদের গ্রেপ্তার করে হয় বার্মায় ফেরত পাঠানো হয়, নতুবা ইমিগ্রেশন আইনে জেলে ভরা হয়। রোহিংগাদের উপরে ডাকাতি, হামলা এবং ধর্ষন খুব বেড়ে গিয়েছে। অপুষ্টি এবং মৃত্যুহার সমস্ত সীমা পেরিয়েছে । এই জনবহুল ক্যাম্প রোগের আখড়ায় পরিনত হয়েছে। রোহিংগারা এটা জানে যে, তারা সমাজের সবচেয়ে নীচের স্তরের মানুষ এবং তারা সব জায়গাতেই অনাকাংখিত। সর্বত্রই তারা নিরাপত্তাবিহীন এবং অধিকারহীন বহিরাগত মাত্র। ৬৯ বছরের আবদুল বলেন, "যদি বনের কোন প্রানীকে হত্যা করা হয় তবে তা হয় বেআইনী এবং শাস্তি যোগ্য অপরাধ। কিন্তু মানুষ হয়েও আমরা তার যোগ্য নই। আমরা তো পশুদের চেয়েও নিকৃষ্ট।" Click This Link


দ্বিতীয় লেখাটি "মায়ানমার রিফিউজিস ফেস গ্রিম ফিউচার ইন বাংলাদেশ", প্রকাশকাল ১৩ই মার্চ। যাতে আবারও রাহিংগাদের দুরবস্থার প্রতিধ্বনি করা হয়। কুটুপালং এর দিলদার বেগম স্বামীর গ্রেপ্তারের পর থেকে পাচ সন্তান নিয়ে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছেন। "আমার এবং আমার সন্তানদের মৃত্যু হলে ভাল হয়।" - পচিশ বছর বয়েসী এই নারী এভাবেই আক্ষেপ করলেন। মুসলিম হবার কারনে তারা বৌদ্ধ মায়ানমারে অনাকাংখিত। অন্যদিকে বিদেশী হবার কারনে তারা বাংলাদেশে অনাকাংখিত। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশ রোহিংগাদের উপরে বেশ কঠোর হয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করেছে এবং দেশে ফেরত পাঠিয়েছে। সীমান্তে বসিয়েছে অতিরিক্ত প্রহরা। সাথে সাথে এইড গ্রুপগুলোকে খাদ্য সাহায্য বিতরনে সতর্ক করেছে যাতে রোহিংগারা এদেশে আসতে উৎসাহিত না হয়। খাদ্য সাহায্য কমে যাওয়ায় রোহিংগারা অভূক্ত থাকছে। Click This Link rohingyas&st=cse

৩। ইসলাম অনলাইন:

বাংলাদেশে পুলিশ রোহিংগাদের নদী সাতরে মায়ানমারে ফিরতে বাধ্য করছে বলে ইসলাম অনলাইনের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। "রোহিংগা'স টেস্ট বাংলাদেশ এবিউস" লেখাটিতে রোহিংগারা বাংলাদেশে স্থানীয় জনতা ও পুলিশের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলে দাবী করা হয়। বাংলাদেশে ধুকে ধুকে মরাই যেন তাদের নিয়তি।
Click This Link

৪। আল জাজিরা:

"রোহিংগা ক্রাকডাউন ইন বাংলাদেশ" লেখায় বলা হয়, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিংগারা প্রচুর সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে। জাতিসংঘের মতে রোহিংগারা পৃথিবীর সবচাইতে নির্যাতিত সংখ্যালঘু জনপদের একটি। নির্যাতনের ফলে মায়ানমারের উত্তর রাখাইন প্রদেশ থেকে হাজার হাজার রোহিংগা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ২২০,০০০ রোহিংগা বাস করছে। Click This Link

৫। টাইম:

"ফর রোহিঙ্গা ইন বাংলাদেশ, নো প্লেস ইস হোম" শিরোনামের রিপোর্টে বলা হয়, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশে কুটু পালং ক্যাম্পে রোহিংগাদের উপরে নৃশংস ক্রাক ডাউন চলছে। তেইশ বছর বয়েসী জিয়াউর রহমান বলেন, "সীমান্ত রক্ষীরা আমার আংগুল ভেংগে দেয় এবং আমাকে নদীতে ফেলে দেয়। এবং বলে সাতরে ফেরত যেতে।" .....। স্থানীয় বাংলাদেশীদের সাথে রোহিংগাদের সম্পর্ক শীতল। চলছে কাজের প্রতিযোগিতা, যেখানে রোহিংগারা কম মজুরীতে কাজ করতে রাজী। আবার কেউ কেউ আশংকা করছেন জংগী গ্রুপগুলো এই নির্যাতিত এবং নেতাশূন্য জনপদকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দেবে। Click This Link

৬। এএফপি:

"মায়ানমার রিফিউজিস স্টার্ভ টু ডেথ ইন বাংলাদেশ" লেখায় বাংলাদেশে রোহিংগাদের করুন অবস্থা বর্ননা করা হয়। হাইতির বিশাল ভূমিকম্পের পরে যেখানে শিশু অপুষ্টির হার শতকরা ছয় ভাগ, সেখানে রোহিংগা ক্যাম্পে তা ১৮ দশমিক ২ ভাগ। জাতিসংঘ কর্তৃক সবচেয়ে নির্যাতিত হিসেবে চিহ্নিত এই জন গোষ্ঠীর উপরে পুলিশ চড়াও হয়ে জেল বহিষ্কার সহ যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে তা সুষ্পষ্ট মানবাধিকার লংঘন।

(Click This Link )




ডেইলী স্টার ও ব্যাংকক পোস্টের প্রতিক্রিয়া:

আন্তর্জাতিক পত্র পত্রিকায় বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিংগাদের উপরে নির্যাতনের খবর প্রকাশ হবার পরে এ প্রেক্ষিতে ডেইলী স্টার মার্চের ২৮ তারিখে এই বিষয়ের উপরে একটি লেখা ছাপে [১০]। যেখানে রোহিংগাদের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বিশ্বে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তার কিছু চিত্র স্থান পায়। সৌদি আরব সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গারা কি করে বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষুন্ন করছে, তার কিছু বর্ননা সমৃদ্ধ লেখা। লেখাটিতে যদিও রোহিংগাদের উপর নির্যাতনকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, তবুও তা একপেশে এবং অসম্পূর্ন। রিপোর্টের একটি অংশের সাথেই শুধু একমত হওয়া যায়। তা হল, রোহিংগারা বার্মার সন্তান এবং বার্মাকেই বাধ্য করতে হবে সে দায় নেবার জন্যে। অনেক অংশ, যেমন - রোহিংগারা সৌদি আরবে ক্রাইমের সাথে জড়িত, সে দায় বাংলাদেশ কেন নেবে - সত্য হলেও রোহিংগাদের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের ঠিক সেভাবে দায়ী করা যায় না। একটি জনগোষ্ঠীর সমস্ত অধিকার অস্বীকার করে তাদের কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা আশা করা যায় না। এছাড়া রিফিউজিরা সব দেশেই এরকম সমস্যা তৈরী করে থাকে। বরং সব পক্ষকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানানো উচিত ছিল। খাপছাড়া ভাবে সেসব কথা যে আসেনি তা নয়, তবে সামগ্রিক মূল ভাব সেরকমটি ছিলনা। বরং মূল বক্তব্য হচ্ছে দায় কাটানো। রিপোর্টের যে লাইন গুলো সবচেয়ে বিরক্তিকর তা হল:

Ironically, the MSF report on persecution of Rohingyas in Bangladesh was released on the day when the Prothom Alo carried the report on involvement of Rohingyas in criminal activities in Saudi Arabia. The MSF report has also been uploaded onto some websites in a bid to generate sympathy for Rohingya refugees

লেখকের সার কথা হল, আন্তর্জাতিক বিশ্বের এসব রিপোর্ট উদ্দেশ্য মূলক- রোহিংগাদের প্রতি সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা মাত্র। অথচ, ডেইলী স্টারের রিপোর্টের কোথাও উল্লেখ নেই আন্তর্জাতিক মাধ্যমের এসব রিপোর্ট আসলে "মিথ্যা"। তাহলে, ডেইলী স্টার কি আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম গুলোতে রোহিঙ্গা বিষয়ক সত্য প্রকাশ হোক, তা চায় না?

এখানে উল্লেখ্য, রোহিংগা অনুপ্রবেশকারীদের যে শুধু বাংলাদেশেই প্রতিহত করা হচ্ছে, তা নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের চেয়েও অনেক বেশী নিন্দা ও সমালোচনার মুখোমুখি যে দেশ হয়েছে, তা হল থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ডের নয়টি ক্যাম্পে ১১১,০০০ রোহিংগা রিফিউজি বসবাস করছে। থাইল্যান্ডে গত ২০০৮ এর ডিসেম্বরে প্রায় ১০০০ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিংগাদের সীমান্ত রক্ষীরা শারীরীক নির্যাতন করে এবং সাগরে নৌকা দিয়ে ভাসিয়ে দেয়। অপ্রতুল খাবার দিয়ে তাদের নৌকার ইন্জিন কেটে দেয়। যাদের বেশীর ভাগই সাগরে ভেসে যায় এবং বাকীরা ইন্দোনেশিয়র সুমাত্রায় কিংবা ভারতের আন্দামান দ্বীপে উদ্ধার হয়। ধারনা করা হয় পাচটি নৌকার শুধু একটিই বেচে যায়। এই ঘটনা সারা বিশ্বে "থাই বোট এবিউস" নামে পরিচিতি পায়। [৯] বিশ্বের চাপের মুখে থাইল্যান্ড এই ঘটনায় তদন্তের আশ্বাস দেয়। একজন থাই অফিসার ঘটনাটি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, "ইন্জিন না কাটলে ওরা আবার ফিরে আসত।" [৮] এ বিষয়ে ব্যাংকক পোস্ট তাদের সম্পাদকীয়তে "থাই বোট এবিউস" নিয়ে সীমান্তরক্ষীদের এহেন অমানবিক আচরনের নিন্দা জানায়। সাথে সাথে এও লিখে:

"অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে থাইল্যান্ডের কোন দায়বদ্ধতা নেই। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে এবং ইমিগ্রেশন প্রত্যাশীদের সেসব নীতিমালা অনুসরন করতে হবে। রোহিংগারা দক্ষিনে নিরাপত্তা সমস্যা তৈরী করে থাকে, যেখানে তারা স্থানীয় মুসলিমদের সাথে খুব সহজে মিশে সরকার ও মুসলিমদের মাঝে সম্পর্কের ফাটল তৈরী করে।"

ব্যাংকক পোস্ট রোহিংগাকে আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে সব পক্ষের অংশ গ্রহনে সমাধানের উদ্যোগের প্রতি আহ্বান জানায়। [৭]

বার্মার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মত রোহিংগারা যে বাংলাদেশের জন্যেও একটি বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে, সে বিষয়ে দ্বিমতের কোন অবকাশ নেই। ভারত, থাইল্যান্ড, পাকিস্তানের মত বাংলাদেশও ১৯৫১ এর শরনার্থী কনভেনশনের স্বাক্ষর করা ১৪৭ টি দেশের একটি নয়। যার ফলে শরনার্থীদের বিষয়ে বাংলাদেশের কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। ১৯৯১ সালের পর থেকে তাই ঢাকা একজন রোহিংগাকেও শরনার্থী হিসেবে রেজিস্টার করেনি। [৬] সেজন্যে এসব অনিবন্ধিত রোহিংগারা বাংলাদেশের মানুষের সাথে মিশে যাবার সুযোগ পাচ্ছে। যা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশের জন্য বড় একটি সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।

রোহিংগাদের উপরে বার্মার নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস:

বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশে এত প্রতিকূলতার সম্মূখীন হলেও রোহিংগারা বার্মায় ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। শতকের শতক ধরে চলে আসা নৃশংসতা ও নির্যাতনই এর মূল কারন, যা স্বল্প পরিসরে শেষ হবার নয়। আমি হাজারো ঘটনা থেকে উদাহরন হিসেবে অল্প কয়েকটি ঘটনা ও ইতিহাস তুলে ধরছি।

নবম শতক থেকে আরাকান প্রদেশে (যা এখন রাখাইন নামে পরিচিত) আরব, মোগল, তুর্কী, পর্তুগীজ এবং বাঙ্গালসহ নানান বিদেশী বনিক, সৈন্য প্রমূখ বসতি স্থাপন করে । পনের শতকের দিকে এই বসতি ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে এবং নিজস্ব শিল্প-সংস্কৃতি গড়ে তোলে। এরাই রোহিঙ্গা নামে পরিচিত।


ছবি: ষোল শত শতকের আরাকানের মূদ্রা, যা বাংলার সুলতান শামস আল দীনের নামে নামাংকিত। (উইকি থেকে নেয়া)

আরাকানের এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপরে বার্মার সৈন্যদের আক্রমন ছিল খুবই সাধারন ঘটনা। ১৭৮৫ সালে প্রায় ৩০০০০ বার্মীজ সৈন্য আরাকান আক্রমন করে লাইব্রেরী, মসজিদ এবং বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে। সাথে সাথে ২০০০০ রোহিঙ্গাকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। রোহিঙ্গাদের উপরে এধরনের বহু ধ্বংস লীলা নিয়মিত বিষয় হয়ে দাড়িয়ে যায়। এরকম একটি আক্রমনে জীবন্ত রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে মারার মত অমানবিক ঘটনাও ঘটে।

বার্মীজদের এ নৃশংসতা ভুলে যাবার নয়। তাই ১৮২৫ সালে বৃটিশদের স্বাগত জানায় রোহিঙ্গারা। বৃটিশ শাসনে তাদের অবস্থা অনুকূলে থাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রোহিঙ্গারা বৃটিশদের অনুগত থাকে। যার জন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হয়। ১৯৪২ সালে ঘটে যায় সবচেয়ে নৃশংস রোহিঙ্গা গনহত্যা। সেখানকার রাখাইন মগদের দ্বারা প্রায় ৫০০০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়। [৫] ২৮শে মার্চে শানবিলি গ্রামে শুরু হয় এই রোহিঙ্গা গনহত্যা। শানবিলির পরে এই ধ্বংস লীলা চলে লমবাইসর, রাইচাউং,পাঙ্খা গ্রামে। ১৯৪২ এর এই গনহত্যা এবং ধ্বংস লীলায় বিলুপ্ত হয় ৩০৭ টি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রাম। কালাদান নদীর পূর্ব তীরে যা ছিল মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকা, তা হয়ে যায় মুসলিম সংখ্যা লঘু এলাকা। পরবর্তী সময়ে বৃটেন আবার দখল করে নেয় বার্মা এবং রোহিঙ্গারা তাদের স্বায়ত্বশাসন ফেরত পায়। কিন্তু তা বেশীদিন টেকেনা, কারন ১৯৪৮ সালে বৃটেন বার্মা ছেড়ে চলে যায়। স্বাধীন বার্মায় রোহিঙ্গাদের নিষিদ্ধ করা হয় সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং সরকারী পদে। রোহিঙ্গারা আবারও অস্ত্র হাতে নেয়। কিন্তু এরকম অবস্থার মধ্যেও সংসদে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি ছিল। ১৯৬২ সালে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল নি উইন, যিনি রোহিঙ্গাদের সর্বাংশে গুড়িয়ে দেন। ১৯৭০ এর পর থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কার্ড প্রদান বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭৪ সালে কেড়ে নেয়া হয় ভোটাধিকার। এরপরে ১৯৭৮ সালে শুরু হয় অপারেশন ড্রাগন কিং। যার প্রেক্ষিতে ২৫০০০০ রোহিঙ্গা তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। আন্তর্জাতিক চাপের ফলে এদের বেশীর ভাগকেই তখন আবার বার্মা ফেরত নেয়। কিন্তু এখানে শেষ হয় না। ১৯৯১-৯২ সালে আরো এক সমুদ্র রোহিঙ্গা এসে হাজির হয় বাংলাদেশে। বর্তমানে বার্মার প্রতিবেশী দেশগুলো এই রোহিঙ্গা সমস্যায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়।[৪]

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত জনপদে সেনা অভিযান নিয়মিত হয়ে দাড়িয়েছে। এমনি এক অভিযানে যখন মংদুতে একটি মসজিদ বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন একজন রোহিঙ্গা বলছিল, "মারাকেশ মসজিদ এক বছর আগে বন্ধ করে দেয়া হয়। আমাদের কেউ কেউ চেয়ে চেয়ে দেখছিলো। পুলিশ তাদের পিটিয়ে বের করে দেয়।" আরেকজন শরনার্থী বলেন, "আমার ২০ একর জমি এবং ৭টি গরু ছিল। সব কেড়ে নেয়া হয়েছে।" [৩]


এতকিছুর পরে রোহিঙ্গাদের উপর আরেকটি বড় আঘাত নেমে আসে ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব আইনে সব নাগরিক সমান সুবিধা ভোগ করত, যা ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনে নেই। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী বার্মান নাগরিক তিন ধরনের হতে পারে: পূর্ন নাগরিক, সহযোগী নাগরিক এবং ন্যাচারালাইজড নাগরিক। পূর্ন নাগরিক হচ্ছে তারা যারা ১৮২৩ সালে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে বার্মায় অবস্থান করছিল। মোট ১৩৫ টি জাতিসত্ত্বা এই নাগরিকত্বের অনুমোদন পায়, যাদের মধ্যে রোহিঙ্গারা নেই। এই পূর্ন নাগরিকরা রাষ্ট্রের সব ধরনের নাগরিক অধিকার পাবেন। সহযোগী নাগরিক এবং ন্যাচারালাইজড নাগরিকদের অধিকার পূর্ন নাগরিক অধিকারের সমকক্ষ নয়। ১৯৮৯ সালে বিভিন্ন বর্নের নাগরিকত্ব কার্ড সবাইকে দেয়া হলেও রোহিঙ্গাদের কোন রকম কার্ড দেয়া হয় না। রোহিঙ্গারা হারায় নাগরিকত্ব, তারা বার্মা কিংবা অন্য কোন দেশের নাগরিক নয়। বার্মা রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গন্য করে। ভ্রমন, বিয়ে, সন্তান সহ অন্যান্য নানা বিষয়ে তাদের উপরে আরোপ করা হয় কড়াকড়ি। শিক্ষার আলো এবং স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভ্রমনে কড়াকড়ি থাকায় অসুস্থ কাউকে হাসপাতালে নেয়া একটি বিশাল সমস্যা হয়ে দাড়ায়। [১] ২০০১ থেকে আরাকানের আকিয়াব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পড়ার সুযোগ সীমিত করা হয়। ফলে তারা অনেকটা অশিক্ষিত হয়ে বাড়ছে। মেডিসিন স্যান ফ্রন্টিয়ার্সের মতে রোহিঙ্গারা বিলুপ্তির হুমকিতে রয়েছে।[২]

শেষ কথা:

রোহিঙ্গাদের উপর দীর্ঘ নির্যাতনের ইতিহাস সত্ত্বেও তারা ঘুরে দাড়িয়েছে এবং বিশ্ব জনমতকে নিজেদের পক্ষে নিতে পেরেছে। আশা করা যায়, খুব দ্রুত বার্মা তাদের নাগরিকত্ব এবং নাগরিক অধিকার প্রদান করবে। তবে সেরকম সমাধান আসার আগ পর্যন্ত সব পক্ষকে ধৈর্যশীল হয়ে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি মানবিক ভাবে বিবেচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হলেও, তাদের কেস অন্য অনুপ্রবেশকারীদের মত নয়। বরং এই রোহিঙ্গাদের এই অনুপ্রবেশকে আমি দেখি বাচার সংগ্রাম হিসেবে, জীবনের প্রতি মমত্ববোধের অংশ হিসেবে। যারা বাচতে চায়, জীবনকে গড়তে চায়।

১। Click This Link
২। Click This Link
৩।http://www.amnesty.org/en/library/asset/ASA16/006/1992/en/30e04c3e-f93d-11dd-92e7-c59f81373cf2/asa160061992en.pdf
৪। Click This Link
৫। http://en.wikipedia.org/wiki/Rohingya_massacre
৬।http://www.weeklyblitz.net/536/rohingya-persecution-in-bangladesh
৭। Click This Link
৮।http://www.bangkokpost.com/news/investigation/136770/rohingya-a-regional-problem

৯। Click This Link
১০। Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১০ রাত ৯:৫৬
৩১টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×