রমজান মাস।তার উপর গ্রীষ্মকাল।গরম তার পূর্ণ যৌবনে পৌঁছে গেল।
আগামী সাপ্তাহে ঈদ।ঈদুল ফিতর! ঈদ মানেইতো ছোট বড় সবার জন্য আনন্দ আর খুশির দিন!
দামেশকের বাজারগুলো ঈদের সাজে সজ্জিত।চারদিক আলোকিত।সবখানে ঈদের প্রস্থুতি চলছে পূর্ণ উদ্দমে।
আমির-উজিরদের বিবি-বাচ্চা,পাড়া-পড়শী সবাই ঈদের কেনাকাটায় ব্যাস্ত।ছোট থেকে বড় প্রত্যেকেই ঈদের নতুন-নতুন জামা ক্রয় করছে।
খালিফাতুল মুসলিমিন উমর ইবনে আব্দুল আযিযের ছোট্ট ছেলে কান্না করতে করতে ঘরে প্রবেশ করল।
নিজের কলিজার টুকরা'র কান্না দেখে খলিফাপত্নী হতবাক হয়ে গেলেন।তাড়াতাড়ি ছেলেকে কোলে নিলেন,আদর করলেন।
চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে আদরের সাথে জিজ্ঞেস করলেন,
"আব্বু!কান্না করছো কেন?তোমাকে কি কেউ মেরেছে?তোমার কোন বন্ধু কিছু বলেছে?"
ছেলে আরো বেশি কান্না শুরু করে দিল।
মা অস্থির হয়ে ছেলেকে নিজের বুকের সাথে আগলে রাখলেন।আর বললেন,
"আমার আব্বুকে আমি কতবারই না বলেছি!এখন প্রচন্ড গরম পড়ছে!!! বড়দের পর্যন্ত গরমের কারণে রোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছে।আর তুমি কিনা এত্ত এল্প বয়সে রোজা রাখা শুরু করেছ! হয়ত তোমার পিপাসা লেগেছে, তাই না আব্বু!?"
ছেলে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,
" না আম্মু!আমার পিপাসাও লাগে নাই,রোজার কারণেও কষ্ট হচ্ছে না।"
তাহলে তুমি কান্না করছো কেন আব্বু!?
বাচ্চাঃ আম্মু আগামী সাপ্তাহে ঈদ।আমার বন্ধুরা সবাই নতুন নতুন জামা ক্রয় করেছে।নতুন জামা পরে তারা সবাই তাদের আব্বুর সাথে ঈদগাহে যাবে।ঈদের নামাজ আদায় করতে।
সবাই নতুন কাপড় পরে ঈদগাহে যাবে আর আমি পুরাতন কাপড় পরে যাবো!আমার লজ্জা লাগবে।আমি ঈদগাহে যাব না আম্মু!।"
এটা বলে বাচ্চা আরো জোরে শোরে কান্না করতে লাগল।
কলিজার টুকরার এমন কথা শুনে মায়ের চোখেও অশ্রু ঝরতে লাগল।
আব্বু কান্না করো না! আম্মু তোমার জন্য নতুন জামার ব্যবস্থা করবো।এখন তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
কিছুক্ষণ পর খিলাফতের কাজ শেষ করে উমর ইবনে আব্দুল আযিয(রহ.) নিজ ঘরে প্রবেশ করলেন।জামা খুলে তিনি বিশ্রাম নিতে যাবেন এমন সময় ভারাক্রান্তহৃদয়ে খলিফাপত্নী এসে বললেন,
"আমিরুল মু'মিনিন!আমার প্রাণ আপনার উপর কুরবান।
আগামি সাপ্তাহে ঈদ, বাচ্চা নতুন জামার জন্য কান্নাকাটি করছে।এই মাত্র সে কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে গেল।
ওমর ইবনে আব্দুল আযিয বললেন,
"ফাতেমা!তোমার তো জানা আছে।রাষ্ট থেকে আমাকে মাত্র একশত দেরহাম দেয়া হয়।যা দিয়ে খাবারের খরচসহ একজন খাদেমের বেতন দিতে হিমশিম খেতে হয়।বাচ্চার জন্য নতুন জামা কীভাবে ক্রয় করবো?"
বায়তুল মাল থেকেও নেয়া সম্ভব না।কারণ সেখানে যা আছে,তা গরিব,দূঃখি,এতিম, বিধবা-মিছকিনদের হক।আর আমি সেগুলোর আমানতদার মাত্র।
বায়তুল মালের খেয়াল করাটাও ভুল হবে।"
ফাতেমাঃ
নিশ্চয়।হে আমার মাথার মুকুট!
কিন্তু বাচ্চা তো অবুঝ!জেদ ধরে আছে।
দেখুন না,বাচ্চার চোখের অশ্রুর দাগ এখনো মুখের উপর ভাসছে।"
উমর ইবনে আব্দুল আযিয তাঁর স্ত্রী ফাতেমাকে বললেন,যদি তোমার কাছে কিছু থাকে,তাহলে সেটা বিক্রি করে বাচ্চার আশা পূরণ করতে পার।
ফাতেমা বললেন,
" আমিরুল মুমিনিন! আমার সব স্বর্ণলঙ্কার তো আপনি বায়তুল মালে জমা করে দিয়েছেন।
এমন কি সেই মূল্যবান গলার হার,যা আমার আব্বা আমাকে স্মৃতিস্বরূপ দিয়েছিলেন, তাও আপনি বায়তুল মালে জমা করে দিয়েছে।
এখন আমার কাছে আপনার ভলবাসা এবং আনুগত্য ছাড়া আর কিছুই নেই।"
আমিরুল মুমিনিন নিচের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে নিলেন।
চিন্তার সাগরে ডুব দিলেন।নিজের অতীতকে চিন্তার-সাগর থেকে খোঁজার চেষ্টা করছেন।নিজের বাঁচপন এবং যৌবনের আরাম-আয়েশির সেই 'অতীত' যামানা স্মরণ করছেন।
এমন একটা সময় ছিল,যখন উমর ইবনে আব্দুল আযিয যে জামাটা একবার পরতেন,দ্বিতীয়বার সেটা আর গায়ে লাগাতেন না।যে রাস্তা দিয়ে তিনি একবার অতিক্রম করতেন,ঘন্টার পর ঘন্টা সেই রাস্তা মিশকের সুঘ্রাণে সুরোভিত হয়ে থাকত।
অগনিত কোবা এবং আবা তার পড়েই থাকত।
চিন্তা করতে করতে আমিরুল মুমিনিনের চোখে পানি এসে গেল।
ফাতেমা নিজের প্রাণপ্রিয় স্বামীর চোখে পানি দেখে আরো অস্থির হয়ে গেলেন।
"আমিরুল মু'মিনিন! আমাকে ক্ষমা করুন,আমার ভুল হয়েগেছে।"
ফাতেমা!এমন বলো না! আমার বাল্যকালের স্মৃতি স্মরণে এসেছিল।তাই....।"
খলিফা বায়তুলমালের দারোগার কাছে চিঠি লিখলেন।
খাদেমকে বললেন চিঠি দেয়ার পর দারোগা যদি কিছু দেয় তাহলে খুব সাবধানতার সাথে নিয়ে আসবে।
চিঠিতে লেখা ছিল,
"আমার একমাসের অগ্রীম বেতন পাঠিয়ে দিন"
কিছুক্ষণ পর খাদেম খালি হাতে ফিরে এল।
খাদেমের হাত খালি দেখে ফাতেমার কলজে মোচড় দিয়ে উঠল।
খাদেম চিঠির প্রতি উত্তরে আরেকটা চিঠি নিয়ে আসল।
উত্তরে লেখা ছিল,
"হে খালিফাতুল মুসলিমিন!আপনার হকুম আমার শিরোধার্য! কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত যে,সামনের মাস আসা পর্যন্ত আপনি জীবিত থাকবেন?আপনার যদি এই নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে আপনি কীভাবে গরিব-মিসকিন এবং বিধবাদের হক অগ্রীম আপনার ঘাড়ে চাপাবেন?"
চিঠির উত্তর পড়ে হযরত উমর ইবনে আব্দুল আযিযের চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগল।
আর বললেন,
"দারোগা!তুমি আমাকে ধংস থেকে বাঁচিয়েছ। "
***
"আগামী সাপ্তাহের" সেই ঈদ এসে গেল।দামেশকে আজ ঈদ।ঈদুল ফিতর।ঈদের আনন্দে দামেশকের আকাশ-বাতাশও আনন্দিত।দামেশকের অলি-গলি দালান-কোটা ঈদের সাজে সজ্জিত।ছোট-বড়,ধনী-গরিব সবাই রঙ বেরঙয়ের নতুন জামা কাপড় পড়ে ঈদগাহপানে ছুটছে।
কিন্তু দামেশকবাসী সেই দিন বিস্মিত নয়নে অবলোকন করেছিল।দামেশকের আকাশ-বাতাশ সেই দিনের ইতিহাসের সাক্ষী হল।
মুসলিম জাহানের খলিফা, উমর ইবনে আব্দুল আযিয নিজ বাচ্চার হাত ধরে ঈদগাহে গিয়েছিলেন।
পরণে তাঁদের ছিল ঈদের 'পুরনো' জামা।
এরপরো!
বাচ্চাদের চেহারা ছিল চাঁদের মত নির্মল,সূর্যের মত উজ্জল।
কেননা আজকে তাঁদের দৃষ্টি অস্থায়ী দুনিয়ার সাময়িক খুশির উপর নয়;বরং জান্নাতের চিরস্থায়ী নিআমত এবং ফারাহাতের অনুভূতি তাঁদেরকে আত্নহারা করে তুলছে।
মুসলিম জাহানের খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযিয নিজের জীবনকে এভাবেই তাকওয়া তাহারাত এবং আল্লাহর ভয়ের বেষ্টনী তে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন।
তিনি আল্লাহর এমন এক প্রিয় বান্দা ছিলেন,মুসলিম উম্মাহ যাঁকে "পঞ্চম খলিফায়ে রাশেদা" হিসেবে স্মরণ করে।।।
রাহিমাহুল্লা.....
-------------
লেখক:
ইসহাক ওমর
ছাত্র: আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:২২